somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প : নবীন লেখকের প্রথম উপন্যাস - রহস্যপত্রিকা, জুলাই, ২০১৩

১২ ই জুলাই, ২০১৩ রাত ৯:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মাথার উপর সূর্যটা মধ্য গগণ পার হয়েছে অনেক আগেই। পশ্চিমের আকাশে হেলেও পড়েছে খানিকটা। তবু তেজ কমেনি যেন এতটুকুও। বিকেলের সোনা রোদ যে মাঝ-চৈত্রের এই সূর্য ঝরাবে না, সে লক্ষণ পরিষ্কার। পথ-চলতি মানুষের গায়ে অবিরাম ঘাম ঝরানোই যেন তার কৃতিত্ব। শরীর বেয়ে টপ টপ করে ঘাম ঝরছে শাকিলেরও। তবুও ছায়া খোঁজে না সে। খর রোদে ফুটপাত ধরে হেঁটে চলে। যেন সূর্যের তাপে ঝরিয়ে দিতে চায় ভেতরে ভেতরে ফেনিয়ে ওঠা অসহ্য রাগ আর অসহায়ত্বের অনুভূতিটুকুও। ঘাম ঝরলেও ক্রোধের অনুভূতিটুকু ছাড়ে না তাকে। ক্রোধটা প্রকাশ করার কোন উপলক্ষ্য না পেয়ে নিজেকেই যেন শাস্তি দিচ্ছে শাকিল।

ভুলতে পারছে না ‘নবীন-কাঁচা’ প্রকাশনীর কর্ণধার মাহবুব চৌধুরীর কথাগুলো। বার বারই মনের পর্দায় ভেসে উঠছে তার চোখের সামনে তারই স্বহস্তে লেখা পান্ডুলিপিটা ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে ছুঁড়ে ফেলার দৃশ্যটা। যতবারই মনে পড়ছে ততবারই ক্রোধে দিশাহারা হচ্ছে শাকিল। নিজের অসহায়ত্ব সেই ক্রোধকে অশ্রুজলে রূপান্তর করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নিরন্তর। বহিঃপ্রকাশটুকু প্রাণপণে ঠেকিয়ে রেখেছে সে।

অনেক আশা নিয়ে গিয়েছিল সে নতুন-কাঁচা প্রকাশনীর অফিসে। আজ প্রথম নয়, সপ্তাহখানেক আগেও পা রেখেছিল ঐ অফিসে। আজকে দ্বিতীয়বারের মতো যাওয়া। প্রকাশনীটি গড়ে উঠেছে বছরখানেক হলো। এরই মধ্যে পাঠকদের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছে এই প্রকাশনীর বেশ কয়েকটি বই। বিশেষত সর্বশেষ একুশের বইমেলায় নতুন লেখকদের এক গুচ্ছ গল্প-কবিতা-উপন্যাস বের করে খ্যাত হয়ে উঠেছে প্রকাশনীটি। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন, সাক্ষাৎকারে প্রকাশক জানিয়েছিলেন, নবীন লেখকদের সুযোগ করে দেয়াই প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য। সেই কথার উপর ভরসা করেই শাকিল গিয়েছিল ঐ অফিসে। খুব ছোটবেলা থেকেই যে শাকিলের লেখালেখির শখ- তা নয়। তবে, পড়ার অভ্যাস ছিল তার। বলা যায়, বইয়ের পোকা ছিল। ছোটবেলা থেকেই। পাঠ্য বইয়ের বাইরের বই। খুব ছোটবেলায় কমিকস দিয়ে শুরু। বিশেষত মুসলমানী হওয়ার পর। সাতদিন ধরে বিছানায় শোয়া। কোন কাজকর্ম নেই। তখন ডিশলাইন-ইন্টারনেট এসবের রমরমা সময় ছিল না। বাবা পাড়ার লাইব্রেরী থেকে এনে দিতেন কমিকসের বই- নন্টে-ফন্টে, হাঁদাভোদা, বাটুল দ্যা গ্রেট, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, সিরাজদ্দৌলা- আরও কত কি! আরেকটু বড় হয়ে সেবা প্রকাশনীর তিন গোয়েন্দা, রেজা-সুজা, গোয়েন্দা রাজু, পরবর্তীতে মাসুদ রানা, ওয়েস্টার্ন, সেবা রোমান্টিক - সবই গোগ্রাসে গিলত। ক্লাস নাইনে ওঠার পর থেকে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, সুকুমার রায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পড়া শুরু করে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ শামসুল হক, হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ুন আহমেদ, জাফর ইকবাল, ইমদাদুল হক মিলন, মইনুল আহসান সাবের, আনিসুল হক, মোহিত কামাল - সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সব লেখকের প্রায় সব বই-ই পড়া তার। সব বই কিনে পড়ার মতো সচ্ছলতা পরিবারের ছিল না, কিন্তু এর-ওর কাছ থেকে ধার করে, পাড়ার লাইব্রেরী, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমান লাইব্রেরী থেকে এনে পড়তো সে। ক্লাস টেনে ওঠার পর হঠাৎ করেই লেখক হওয়ার ইচ্ছে জাগে শাকিলের। লিখতে শুরু করে টুকটাক। পত্রিকা-ম্যাগাজিন-লিটল ম্যাগে না, লেখাগুলো থাকে নিজের কাছেই। শুধু লেখক হওয়ার বাসনাতেই এসএসসির পর সায়েন্স ছেড়ে দেয় সে। স্বল্প আয়ের বেসরকারী চাকুরে বাবা আর গৃহিনী মায়ের আশার পাতে ছাই দিয়ে এইচএসসিতে মানবিক বিভাগ বেছে নেয়। পাঠ্যবইয়ের সাথে যোগাযোগ কমতে থাকে। প্রভাব পড়ে পরীক্ষার ফলাফলেও। এইচএসসির পর ভর্তি হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিষয় বেছে নেয় বাংলা।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকে লেখক হিসেবে নিজেকে পরিচিত করানোর বাসনাটা জেগে ওঠে মনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়াল পত্রিকা, স্মরণিকা, দু-একটা লিটল ম্যাগ এ লেখা ছাপা হয়। ছাপা হয় সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকার বিশেষ পাঠক সংখ্যাগুলোতে। কিন্তু ৭০০-৮০০ শব্দের সীমাবদ্ধতায় লিখে ভাল লাগে না তার। আরো বড় পরিসরে, বড় ক্যানভাসে লেখার তাগিদটা ভেতর থেকে অবিরাম খোঁচাতে থাকে। ঝটপট লেখা নয়- সময় নিয়ে , মনোযোগ দিয়ে, তথ্য-উপাত্তের গবেষণা আর ভাষাশৈলীর উৎকর্ষতার সম্মিলনে সরাসরি উপন্যাস লেখায় মন দেয় শাকিল। এক বছরের পরিশ্রমে দাঁড় করায় একটি উপন্যাস।

ইভ-টিজিং নিয়ে লেখা উপন্যাসটিকে নিজের কাছে অসাধারণই লাগে তার। কিন্তু লেখাই তো শেষ কথা নয়। লেখা ছাপাবে কোথায়?

তিনটি দৈনিক ও দুটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকের সাথে দেখা করে শাকিল। ঈদ সংখ্যা ছাড়া এতো বড় উপন্যাস ছাপা হওয়ার কোন জায়গা তো নেই। সবাই সরাসরিই বলে দেয় - নতুন কোন লেখকের এতো বড় উপন্যাস ছাপানোর ঝুঁকি তারা নেবেন না। পারলে ছোট কোন গল্প লিখে নিয়ে আসুক শাকিল, তা বিবেচনার জন্য পড়ে দেখা যেতে পারে। কেউ তার উপন্যাসটা পড়ে দেখতেও রাজী হয় না।

কিন্তু ছোট গল্প লেখায় কোন উৎসাহ বা মনোযোগ পায় না শাকিল। দুটি প্রকাশনীর সাথেও যোগাযোগ করে সে। তারাও প্রথমেই বাতিল করে দেয় তাকে নতুন লেখক, উপরন্তু কোন দৈনিক-সাপ্তাহিকের সাহিত্য সাময়িকীতে কোন গল্পও কখনো ছাপা হয়নি বলে। এরই মাঝে ‘নতুন-কাঁচা’ প্রকাশনীর নাম শোনে সে, পড়ে প্রকাশকের সাক্ষাৎকার। নতুন আশা জাগে মনে।
প্রথম দিন প্রকাশনীর অফিসে এসেও আশান্বিত হয় শাকিল। অন্যরা যেখানে তার উপন্যাসটি ছুঁয়ে দেখতেও রাজী ছিল না, সেখানে এরা তার পান্ডুলিপিটি রাখে। যদিও প্রকাশনীর মালিক মাহবুব চৌধুরীর সাথে দেখা হয়নি বলে সে কিছুটা ইতস্তত করে। তবু রেখে আসে পান্ডুলিপিটা মাহবুব চৌধুরীর সহকারী প্রদীপ কুমার বসুর কাছেই। কথা অনুযায়ী এক সপ্তাহ পর আবার যায় শাকিল। এবার প্রদীপ বাবু সরাসরিই বলেন, ‘এক লাখ লাগবে।’

‘এক লাখ কি?’ - বুঝতে পারে না শাকিল।

‘এক লাখ টাকা।’- শাকিল বুঝতে পারছে না বলে যেন অবাক হয় লোকটা।

‘এক লাখ টাকা!’ অবাক হয় শাকিল। ‘কেন?’

‘বাহ রে। আপনি বই ছাপাবেন না?’

‘বই তো ছাপাবেন আপনারা। প্রকাশক তো আপনারা। এ জন্য আমার টাকা দিতে হবে কেন?’

পরিহাসের হাসি হাসে লোকটা- ‘হাসালেন। আপনি টাকা না দিলে তো বই ছাপা হবে না।’

‘আপনারা না নতুন লেখকের বই প্রকাশ করেন বলে বিজ্ঞাপনে দাবী করেন?’
‘অবশ্যই আমরা নতুন লেখকের বই প্রকাশ করি। কিন্তু এর খরচটাতো আপনাকে দিতে হবে। এটাই নিয়ম।’

নিয়ম! গায়ে জ্বালা ধরে শাকিলের। তার মনে হয়, লোকটা মাঝখানে বসে লেখকদের কাছ থেকে টাকা কামিয়ে নেয়। নিশ্চয়ই প্রকাশক মাহবুব চৌধুরী তার সহকারীর এ মধ্যসত্ত্বভোগের কথা জানেন না। তার যে সাক্ষাৎকার পড়েছে, তাতে উনাকে অমন চরিত্রের মনে হয় না। শাকিল কঠোর স্বরে বলে- ‘আমি আপনাদের প্রকাশকের সাথে কথা বলতে চাই।’

তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে লোকটা - ‘টাকা দিতে না পারলে উনার সাথে কথা বলে লাভ নাই। উনি কথা বলার জন্য আবার আমার কাছেই পাঠিয়ে দেবেন। তাছাড়া এখন উনি ব্যস্ত আছেন। উনার অ্যাপয়েন্টমেন্টও নিতে হবে আমার মাধ্যমেই।’

‘ঠিক আছে। আমার পান্ডুলিপিটা ফেরত দিন। আপনাদের মাধ্যমে বই প্রকাশ করা লাগবে না আমার।’

পান্ডুলিপিটা আলমারী থেকে বের করে ফেরত দেয় লোকটা। শাকিলের মাথায় ঝট করে একটা মতলব খেলে যায়। পান্ডুলিপিটা হাতে নিয়ে চলে যাচ্ছে এই ভান করে সে দ্রুত ঢুকে পড়ে মাহবুব চৌধুরীর কক্ষে। সহকারী হা হা করে ছুটে আসতে আসতেই গিয়ে দাঁড়ায় মাহবুব চৌধুরীর সামনে।

মাহবুব চৌধুরী চোখ তুলে তাকান- ‘কি চাই?’

ততক্ষণে প্রদীপ বাবুও ঢুকে পড়েছেন ঐ রুমে। শাকিল কিছু বলার আগেই তিনি বলেন - ‘স্যার , আমি ওনাকে বলেছি আপনি ব্যস্ত। তারপরও জোর করে ঢুকে পড়েছেন।’

শাকিল দ্রুত মুখ খোলে- ‘স্যার আমি একজন লেখক। একটা পান্ডুলিপি নিয়ে এসেছিলাম। আপনারা নতুন লেখকদের লেখা প্রকাশ করেন জেনে খুব আশা নিয়ে এসেছি।’

‘উনি আপনার সাথে কথা বলেনি?’- সহকারীর দিকে ইঙ্গিত করে বলেন তিনি।

‘হু, বলেছেন। কিন্তু উনি যা বললেন, তা তো আমার পক্ষে সম্ভব নয় স্যার। আমি এখনও ছাত্র, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি।’

‘উনি তোমাকে বলেননি যে আমি ব্যস্ত এবং অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া আমি যার তার সাথে দেখা করি না।’ ছাত্র শুনে সম্বোধনের ধরণ পাল্টে ফেলেন মাহবুব চৌধুরী।

‘যার-তার’ কথাটা কানে লাগে শাকিলের। কিছুটা নিষ্প্রভ হয়। তবুও হাল ছাড়ে না- ‘আপনি যদি অনুগ্রহ করে পান্ডুলিপিটা পড়েন স্যার, আশা করি আপনার ভাল লাগবে। আমি এক বছর ধরে খেটেখুটে লিখেছি উপন্যাসটা.. বিষয়টাও সাম্প্রতিক..... ইভ-টিজিং নিয়ে।’

‘কিসে পড়ো তুমি?’ কিছুটা বিরক্ত কন্ঠে বলেন মাহবুব চৌধুরী।

‘অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ি। জগন্নাথে।’

‘আগে লেখা ছাপা হয়েছে কোথায়?’

‘ইউনিভার্সিটির ম্যাগাজিনে আর দুটো লিটল ম্যাগে। সাপ্তাহিক ২০০০ আর মৌচাকে ঢিল-এর পাঠক সংখ্যায় চারটা লেখা ছাপা হয়েছে।’

‘দৈনিক বা সাপ্তাহিক পত্রিকার সাহিত্য পাতায়?’

‘না স্যার।’

‘তাহলে তুমি নিজেকে লেখক হিসেবে দাবী করো কোন মুখে? দেখ ইয়াং ম্যান, তোমার মতো দু-চার লাইন লিখেই বই ছাপাতে উঠে-পড়ে লাগে বহু মানুষ। তাদেরকে লেখক বলা হয় না। লেখালেখি শখের জিনিস না। প্রতিভা লাগে, শ্রম লাগে। বহুত সময় নষ্ট করেছো আমার, এখন যাও।’

তবু মরিয়া শাকিল - ‘স্যার, দয়া করে যদি একবার পড়ে দেখেন। ভাল না লাগলে না-ই ছাপালেন। আর ছাপালেও আমি কোন লেখক-সম্মানী দাবী করবো না। লাভ যা হবে তা তো আপনাদেরই।’

‘লেখক-সম্মানী? লাভ?’ মাহবুব চৌধুরীর চেহারায় একই সাথে বিস্ময় ও বিরক্তি। ভ্রƒ কুঁচকে তীব্র দৃষ্টিতে তিনি তাকান শাকিলের দিকে- ‘তোমার কি মনে হয়? তোমার বই বিক্রি হবে? তোমার লেখা কে পড়বে? কে তুমি? হুমায়ুন আহমেদ? মোহিত কামাল? প্রচ্ছদে তোমার নাম দেখেই লোকে বই কিনতে আসবে?’

সামনে রাখা পান্ডুলিপিটা হাতে নিয়ে সহকারীর দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলেন - ‘এ ধরণের ছাইপাশ আমার সামনে যেন আর কখনো না আসে।’ বলে পান্ডুলিপিটা ছুঁড়ে মারেন তিনি ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট বরাবর। ঠিক ঠিক বাস্কেটে গিয়েই পড়ে ওটা, অন্যান্য বাতিল কাগজপত্রের সাথে জায়গা করে নেয়।

বুকের ভেতরটায় যেন ছুরির ঘা বসে শাকিলের। তার নিজের হাতে লেখা পান্ডুলিপি। তার এতদিনের পরিশ্রম। পান্ডুলিপিটা ওখান থেকে তুলে আনার রুচি হয় না। তাতে সমস্যা নেই। ফটোকপি আছে তার কাছে। কিন্তু মাহবুব চৌধুরী লোকটার মুখের উপর কিছু বলা উচিত বলে মনে হতে থাকে। কিন্তু মুখে কোন কথা ফোটে না।

নবীন-কাঁচার অফিস থেকে বেরিয়ে উদ্দেশ্যবিহীন পথ চলতে থাকে শাকিল। কোথায় যাচ্ছে, কেন- তা জানা নেই। চারপাশের কোন কিছু যেন চোখে পড়ে না। পা চালিয়ে চলে কিছুক্ষণ। গরমে, ঘামে ক্লান্ত হয় খানিকটা। কিন্তু ভেতরের রাগ পড়ে না। চলার গতি কিছুটা ধীর হয়।

‘এই যে ভাই, একটু শুনুন তো।’ - পাশ থেকে হঠাৎ তরুণী কন্ঠের আহ্বানে থমকে যায় শাকিল। যেন বাস্তবে ফিরে আসে। চারদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে না কোথায় আছে সে। গলির ডানে-বামে চার-পাঁচ তলা উঁচু অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের সারি, গলির দু প্রান্ত দুটো রাস্তার সাথে মিশেছে। গলিটাতে এ মুহূর্তে লোক চলাচল তেমন নেই। কিছুটা দূরে দুটো মুদী দোকান। তবে দোকানের মানুষগুলো দৃষ্টিসীমার ভেতরেই।

তরুণীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে তিন যুবক। তরুণীর ডাক শুনে শাকিল দাঁড়িয়ে পড়তেই এক যুবক বলে ওঠে- ‘যান ভাই, এখানে খাড়ায়েন না।’
আরেক যুবক মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে- ‘ঐ ব্যাটায় কি করবো? তোমার নাগর লাগে নাকি?’

প্রথমে এড়িয়ে যাবে ভেবেছিল শাকিল। তবে ‘নাগর’ শব্দটা কানে বাজে। চোয়াল শক্ত হয়। মেয়েটির দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলে- ‘বলুন।’

‘এরা আমার রাস্তা আটকে ডিস্টার্ব করছে। আপনি আমাকে একটু এগিয়ে দেবেন?’- মেয়েটি কাতর কন্ঠে অনুরোধ করে।

এক যুবক বলে ওঠে - ‘কেন? আমগো পছন্দ হইলো না? আমরা কিন্তু বেশী আনন্দ দিবার পারতাম।’

মেয়েটিকে দেখে ভদ্র ঘরের কলেজ বা ভার্সিটি পড়–য়া বলেই মনে হচ্ছে।

শাকিল বুঝতে পারে, ছেলেগুলো বখাটে, মেয়েটির রাস্তা আটকে আজে-বাজে কথা বলছে।

এমনিতেই রাগে সারা গা চিড়বিড় করছে শাকিলের। তার উপরে বখাটে ছেলেদের কথায় যেন আগুনে ঘি ঢালে। কড়া চোখে তাকায় সে ছেলেগুলোর দিকে। মেয়েটির দিকে না তাকিয়েই বলে- ‘আসুন।’

‘যার লগে যাইতাছ, হের যেই বডি, দেইখা তো মনে হয় না, খাড়াইলে দুই ইঞ্চির বেশী হইবো। আরাম পাইবা না।’ মন্তব্য করে খিক খিক করে হাসতে থাকে এক যুবক।

চট করে হাত উঠে যায় শাকিলের। কষে চড় লাগায় যুবকের গালে।
প্রতি-আক্রমণ করে ছেলেগুলোও। শাকিলের হালকা-পাতলা গড়ন, মারামারিতে অভ্যস্ত নয় সে। পেটানো শরীরের তিন যুবক মিলে পিটাতে থাকে তাকে। শাকিলও ছেড়ে দেয় না। সে-ও এলোপাতাড়ি হাত-পা ছুঁড়তে থাকে। এদিকে মেয়েটির চিৎকারে আশপাশের ফ্ল্যাটের বারান্দায় উৎসুক কিছু মানুষের উপস্থিতি দেখা যায়, দু-একজন করে লোক ছুটেও আসতে থাকে। লোকজন আসতে দেখে এক যুবক তাড়া দেয় অন্য দুজনকে। চড় খাওয়া যুবকটি ঝট করে পেছনের পকেট থেকে একটা ছুরি বের করে। অন্য দুই যুবক ‘না, না’ বলতে বলতেই শাকিলের গলা বরাবর পোচ দেয় যুবকটি। কাটা কলাগাছের মতো রাস্তায় আছড়ে পড়ে শাকিল। তিন যুবক দৌড়ে পালায়। মেয়েটির চিৎকারে ছুটে আসা লোকগুলো ওদের পিছু ধাওয়া করে না। শাকিলকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে। নানা মন্তব্য-আলোচনায় সরব হয়। শেষ শ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত ডাঙায় তোলা মাছের মতো রাস্তায় তড়পায় শাকিল - তবে খুব বেশীক্ষণ নয়। আরো মানুষ জড়ো হয়।

........

পত্রিকায় ছাপা হওয়া মৃত যুবকটির চেহারা চেনা চেনা লাগে মাহবুব চৌধুরীর। কোথায় যেন দেখেছেন তাকে। মনে করতে পারেন না। মনোযোগ দিয়ে খবরটা পড়েন তিনি। শিরোনাম - ইভ-টিজিংয়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে যুবক খুন। বিস্তারিত সংবাদে লেখা আছে - পুলিশ গতকাল বিকেলে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকা থেকে অজ্ঞাত পরিচয় যুবকের লাশ উদ্ধার করেছে। তার বয়স আনুমানিক ২১-২২ বছর। যুবকের গলা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কাটা ছিল। সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন ও কাপড় ছেঁড়া ছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা পুলিশকে জানিয়েছে, গতকাল বিকেলে ঐ এলাকায় তিন বখাটে যুবক বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া এক তরুণীকে উত্যক্ত করছিল। এর প্রতিবাদ করায় বখাটেরা যুবকটিকে মারধর করে। মারামারির ঘটনা দেখে পথচারী ও আশপাশের দোকানের কর্মচারীরা এগিয়ে এলে বখাটেরা তার গলায় ছুরি চালিয়ে পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই যুবকের মৃত্যু ঘটে। ঘটনার শিকার তরুণী পথচারী ও দোকান-কর্মচারীদের কাছে ঘটনার বিবরণ দেন। পরে পুলিশ খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ উদ্ধার করে সন্ধ্যায় ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল মর্গে প্রেরণ করে। পুলিশ দোকান কর্মচারীদের কাছ থেকে ঘটনার বিবরণ জানতে পারে। তবে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছার পর ঘটনার শিকার তরুণীটিকে পাওয়া যায় নি। গত রাতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত নিহত যুবকের পরিচয় পাওয়া যায়নি। নিহতের কাছে কোন ফোন, পরিচয়পত্র বা টাকা-পয়সা পাওয়া যায়নি।

সহকারী প্রদীপ কুমার রুমে ঢোকেন। পত্রিকাটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে মাহবুব চৌধুরী বলেন- ‘ছেলেটিকে চেনা চেনা লাগছে।’

ভাল করে দেখে চিনে ফেলেন প্রদীপ- ‘আরে, এ তো কালকের ঐ ছেলেটা! আপনার সাথে বেয়াদবী করলো। না বলে রুমে ঢুকে পড়েছিল যে।’

মনে পড়ে মাহবুব চৌধুরীরও। ‘ভেরি স্যাড’ বলে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ বসে থাকেন তিনি। তারপর প্রদীপকে বলেন- ‘ওর পান্ডুলিপিটা কই? বিক্রি করে দেন নি তো।’

‘না স্যার। বাতিল কাগজের সাথেই আছে। স্টোর রুমে। কাগজওয়ালা তো সপ্তাহে একদিন আসে, কালকে আসার কথা। কেন?’

কন্ঠে উত্তেজনা দেখা দেয় মাহবুব চৌধুরীর- ‘এখুনি পান্ডুলিপিটা নিয়ে আসুন। যতজনকে লাগে, কম্পোজে বসিয়ে দিন। প্রয়োজনে অন্য সব কাজ বন্ধ রাখুন। কিন্তু আজকের মধ্যে এটার কম্পোজ শেষ করা চাই। পরশুর মধ্যে প্রেসে যাবে এই উপন্যাস।’

‘কিন্তু স্যার, ওটা তো কেউ পড়িই নি আমরা। লেখা ভাল না খারাপ তা-ই তো জানি না।’

‘পড়ার কোন দরকার নাই। ভাল হওয়ারও দরকার নাই। আপনি ঘটনা বুঝতে পারতেছেন না? কোন যেন ইউনিভার্সিটির ছাত্র না ছেলেটা? আজকের মধ্যে পরিচয় বের হয়ে যাবে। এতক্ষণে হয়তো হয়েও গেছে। ইভ-টিজিংয়ের ঘটনা। ইউনিভার্সিটিতে এই নিয়ে হৈ চৈ হবে, আন্দোলন তো মাস্ট। কি পরিমাণ কাভারেজ হবে চিন্তা করেন! এর মধ্যে ইভ-টিজিং-এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিহত লেখকের ইভ-টিজিং নিয়ে উপন্যাস। কি মার মার কাট কাট কাটতি হবে বইয়ের ভেবে দেখেছেন? একজনকে মর্গে পাঠান.... না না আপনি নিজেই যান। বাসার ঠিকানা বের করুন। ওর পরিবারের লোকজনের সাথে দেখা করুন। ওদের জানান, তাদের ছেলের উপন্যাস সে আমাদেরকে দিয়েছে ছাপানোর জন্য, প্রয়োজনে কিছু টাকাও দিয়ে আসুন। এর মধ্যে একটা কন্ট্রাক্ট পেপার তৈরী করুন। ঐ ছেলের স্বাক্ষরের নমুনা কৌশলে আনতে পারলে ভাল। না আনলেও সমস্যা নাই। যে কোন স্বাক্ষর দিলেই চলবে। ওর ভালো একটা ছবি নিয়ে আসবেন অবশ্যই।... আজকেই প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেয়ার ব্যবস্থা করুন। ওতে লেখা থাকবে, ইভ-টিজিংয়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিহত নবীন লেখকের ইভ-টিজিং নিয়ে লেখা একমাত্র উপন্যাস প্রকাশ করছে নতুন-কাঁচা প্রকাশনী। কুইক কুইক। তাড়াতাড়ি করুন। অনেক কাজ।’

অবশ্যম্ভাবী মুনাফার প্রত্যাশায় চক চক করে ওঠে মাহবুব চৌধুরীর চোখ।
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সমাধান দিন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৩১




সকালে কন্যা বলল তার কলিগরা ছবি দিচ্ছে রিকশাবিহীন রাস্তায় শিশু আর গার্জেনরা পায়ে হেটে যাচ্ছে । একটু বাদেই আবাসিক মোড় থেকে মিছিলের আওয়াজ । আজ রিকশাযাত্রীদের বেশ দুর্ভোগ পোয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নিছক স্বপ্ন=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৮



©কাজী ফাতেমা ছবি
তারপর তুমি আমি ঘুম থেকে জেগে উঠব
চোখ খুলে স্মিত হাসি তোমার ঠোঁটে
তুমি ভুলেই যাবে পিছনে ফেলে আসা সব গল্প,
সাদা পথে হেঁটে যাব আমরা কত সভ্যতা পিছনে ফেলে
কত সহজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

একদম চুপ. দেশে আওয়ামী উন্নয়ন হচ্ছে তো?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৯



টাকার দাম কমবে যতো ততোই এটিএম বুথে গ্রাহকরা বেশি টাকা তোলার লিমিট পাবে।
এরপর দেখা যাবে দু তিন জন গ্রাহক‍কেই চাহিদা মতো টাকা দিতে গেলে এটিএম খালি। সকলেই লাখ টাকা তুলবে।
তখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে গরু দুধ দেয় সেই গরু লাথি মারলেও ভাল।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১২:১৮


০,০,০,২,৩,৫,১৬, ৭,৮,৮,০,৩,৭,৮ কি ভাবছেন? এগুলো কিসের সংখ্যা জানেন কি? দু:খজনক হলেও সত্য যে, এগুলো আজকে ব্লগে আসা প্রথম পাতার ১৪ টি পোস্টের মন্তব্য। ৮,২৭,৯,১২,২২,৪০,৭১,৭১,১২১,৬৭,৯৪,১৯,৬৮, ৯৫,৯৯ এগুলো বিগত ২৪ ঘণ্টায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরানের প্রেসিডেন্ট কি ইসরায়েলি হামলার শিকার? নাকি এর পিছে অতৃপ্ত আত্মা?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯


ইরানের প্রেসিডেন্ট হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত!?

বাঙালি মুমিনরা যেমন সারাদিন ইহুদিদের গালি দেয়, তাও আবার ইহুদির ফেসবুকে এসেই! ইসরায়েল আর।আমেরিকাকে হুমকি দেয়া ইরানের প্রেসিডেন্টও তেমন ৪৫+ বছরের পুরাতন আমেরিকান হেলিকপ্টারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×