স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায়? উত্তর খুবই সহজ। কেউ না। পরাধীনতার লাঞ্চনা আর যন্ত্রণা মাথা পেতে নেয়ার মানসিকতা কারোরই থাকে না।
আমরা …জাতির তরুনরা ..কতনা সৌভাগ্যবান যে, সৃষ্টিকর্তার অসীম করুণায় আমরা একটি স্বাধীন ভূখণ্ডে জন্মগ্রহন করেছি। মাতৃজঠর থেকে বরিয়ে সূতীক্ষ্ম চিৎকার করে যে মাটিতে প্রথম আমরা আমাদের আগমনবার্তা ঘোষণা করতে পেরেছি সেটি ছিল নিতান্তই আমাদের। জীবনের প্রভাত বেলা থেকে যে আলো-বাতাস গায়ে মেখে, যে ধূলি-মাটিতে গড়াগড়ি করে আমরা বেড়ে উঠেছি তা আমাদেরই দেশ…আমাদেরই মাতৃভূমি। আমরা আজন্ম স্বাধীন। আমাদের উপলব্ধি করতে হয়নি "পরাধীনতা কি?"
তারপর…সময়ের সাথে সাথে আমরা বেড়ে উঠেছি। এই দেশেরই আলো-বাতাস, কাদা-মাটি, নদী-নালা আর শিক্ষা-সংস্কৃতিকে সাথী করে। আমরা পড়েছি- ধন-ধান্যে পুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা, তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা, সে যে স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।… পড়েছি…"কোন দেশেতে তরুলতা সকল দেশের চাইতে শ্যামল, কোন দেশেতে চলতে গেলেই দলতে হয়রে দূর্বা কোমল।" কিংবা- "আমাদের দেশটারে কত ভালবাসি, সবুজ ঘাসের বুকে শেফালীর হাসি।" এমনি আরো কত…। আমরা শুনেছি- সোনা সোনা সোনা, লোকে বলে সোনা, সোনা নয় তত খাঁটি…যত বল খাঁটি, তার চেয়ে খাঁটি বাংলাদেশের মাটি, আমার বাংলাদেশের মাটি।" কিংবা – এ আমার দেশ, এ আমার প্রেম কত আনন্দ-বেদনায় মিলন-বিরহ সংকটে।" আমরা এখনো হয়তো পড়ি, এখনো হয়তো শুনি। কিন্তু দেশপ্রেম আর মাতৃভূমিকে ভালবাসার যে প্রেরণা এগুলো থেকে নেওয়া যেত, নেয়ার প্রয়োজন ছিল…ক'জন আমরা তা নিয়েছি বা নিতে পেরেছি।
"স্বাধীনতা অমূল্য ধন।" হয়তো মুফতে পেয়েছি বলেই আমরা সেটার মূল্য দিতে পারছি না। আজ যখন ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা বোঝার বয়সে পৌঁছেছি তখন চোখ মেলে চারিদিকে তাকিয়ে কোথাও স্বাধীনতার কোন প্রাপ্তি দেখি না। যে স্বাধীনতার জন্য দিতে হয়েছে অগুনতি প্রাণ, এক নদী রক্ত…যে স্বাধীনতা সংগ্রামকে কেন্দ্র করে বিভক্ত হয়ে যাওয়া জাতি আজো জোড়া লাগতে পারেনি। সে স্বাধীনতার অর্জন কি এই যে আমরা দূর্নীতিতে টানা চ্যাম্পিয়ন হব? ভূখা-নাঙ্গা, টোকাই শিশুরা ডাস্টবিন থেকে খাবার কুড়িয়ে খাবে? ৬বছরের শিশু থেকে ৬০বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত দ্বিপদ পশুর দ্বারা নির্যাতিত হবে? বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদবে? আর অপরাধী বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে? এই যদি হয় স্বাধীনতার ফল, তবে ছোট্ট একটা প্রশ্ন, "এমন স্বাধীনতা কে কবে চেয়েছিল?''
দুঃশাসন-নিপীড়ন, অভাব,দ্রব্যমূল্যের ভয়ংকর ঊর্ধগতি আর প্রাকৃতিক নানান দূর্যোগে আজ বিপর্যস্ত দেশ ও জাতি। স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ…এসব এখন হয়ে গেছে তিন বেলা পেট পুরে খেতে পারা মানুষদের বহুল ব্যবহৃত অর্থহীন কিংবা অর্থবোধক(!) পরিভাষা। পেটে যার এক কণা খাদ্য নেই, পেট গিয়ে যার পিঠে মিশেছে সে কি করবে স্বাধীনতা দিয়ে? দেশপ্রেম তার মনে কোথা থেকে আসবে? তারতো "ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়…পূর্ণিমার চাঁদ যেন জলসানো রুটি।" দেশ ও জাতির তথাকথিত ভাগ্য বিধাতারা (!) ১৪কোটি মানুষের ভবিষ্যত নিয়ে কি ভাবেন? কখন ভাবেন?...বুভুক্ষ মানুষ এখন আর তা জানতে চায় না। তারা শুধু চায় একমুঠো খাবার। তারা জানে-ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়া শিশুর দিকে অশ্রুসজল নয়নে তাকিয়ে থাকা অক্ষম পিতা-মাতার বেদনার্ত মুখ এসব দেশপ্রেমিক নেতাদের হৃদয়ে দাগকাটতে পারে না। আহা স্বাধীনতা! আমরা তোমাকে পেয়েছি, কিন্তু কাজে লাগাতে পারেনি। আর তাই গণতন্ত্র আজ নির্বাসিত। মানবাধিকার কেবল মুখের বুলি আর পত্র-পত্রিকা কনফারেন্স-মিটিং এ বহুল ব্যবহৃত শব্দ। যাকাতের কাপড় আনতে গিয়ে পদপিষ্ট হয়ে মরতে হয় যাদেরকে স্বাধীনতার কোন সুফলটা আমরা তাদের দিতে পেরেছি? উত্তর কি খুব সহজ?
"দেশের স্বাধীনতা বিপন্ন!" দেশ কোন পথে!" এমন কথা আমাদের বিদগ্ধজনেরা যখন-তখন বলেন। কেন বলেন? আমের ভেতরের পোকা নাকি আমের মূল্য বোঝে না। আমরা না হয় স্বাধীন দেশে জন্মেছি বলে স্বাধীনতার মূল্য বুঝি না। কিন্তু আমাদের বুদ্ধিজীবিরা, রাজনীতিবিদরা…পরাধীনতার স্বাদ ভালোভাবে জানা থাকার কারণে, স্বাধীনতার মূল্যও তেমনি খুব ভালোভাবেই তাদের বোঝার কথা ছিল। তারা কি বুঝেছেন? যদি বুঝে থাকেন তবে জোরে-সোরে একথা প্রমাণ করতে চান কেন যে, "বাংলাদেশ একটি অকার্যকর রাষ্ট্র।" দেশপ্রেম আর স্বাধীনতা নিয়ে লেখা-গাওয়া এত শত কবিতা আর গান তাদের মনে কেন জাগাতে পারেনি দেশপ্রেম? তারা জবাবদিহি করবেন কার কাছে? স্বাধীনতা আনতে গিয়ে কতলক্ষ-প্রাণ ঝরে গেছে, সে হিসাব নিয়ে চায়ের পেয়ালায় তুফান তুলে কি লাভ, যদি শহীদদের স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়? স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি প্রমাণের ফায়দাটা কি, যদি পক্ষের লোক হয়েও দেশের জন্য, জাতির জন্য একটুখানি অবদান রাখা না যায়? আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা কি এজন্য প্রাণ দিয়েছেন যে, ৪০ বছর পরও প্রজন্ম ব্যস্ত থাকবে কেবল তাদের সংখ্যা নির্ধারণ নিয়ে? ৪০ বছর পরও স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ নির্ধারণের জন্য আইন-আদালত আর পত্র-পত্রিকায় গলা ফাটানোই হবে স্বাধীনতা উত্তর প্রজন্মগুলোর একমাত্র কাজ? বীরশ্রেষ্ঠদের দেহাবশেষ ফিরিয়ে এনে আমরা মহাসমারোহে সমাহিত করেছি; ভালো কথা। কিন্তু আজ যদি তারা বেঁচে থাকতেন, তাহলে জিজ্ঞেস করে জানা যেতো এমন স্বাধীনতা আর এমন স্বাধীন দেশের জন্যই কি তারা অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছিলেন…? কেবল "আমরা তোমাদের ভুলবো না" আর "তোমাদের ঋণ শোধ হবে না" গেয়ে গেলেই কি তাদের সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময় দেয়া হয়ে যাবে? ঋণ শোধ হবে না বলে কি শোধ করার কোন চেষ্টাও আমাদের থাকবে না?
স্বাধীনতার পর কতগুলো সরকার এলো-গেলো। ক্ষমতার পট পরিবর্তন হয়েছে কতবার। কিন্তু আমাদের ভাগ্যাকাশের ঘোর অমানিশা কখনোই কমেনি। জাতির সুখ ও সমৃদ্ধির স্বপ্নগুলো শত পাখি হয়ে সূদূরে পাড়ি দিয়েছে। স্বাধীন দেশের মাটিতে গণতন্ত্র বিপন্ন হয়েছে বারবার। শিক্ষাঙ্গনগুলোর সবুজ মাটি শিক্ষার্থীদের রক্তে ভিজেছে। বহির্বিশ্বের চোখ রাঙ্গানি আর ঋণদাতা সংস্থাগুলোর হুমকি ধমকি প্রতিনিয়ত সহ্য করতে আমরা বাধ্য হচ্ছি। মাথার উপর বিশাল ঋণের বোঝা নিয়ে জন্ম নিচ্ছে প্রতিটি শিশু। অরক্ষিত স্বাধীনতাই যদি পরাধীনতা হয়, তাহলে আমাদের এতসব অর্জনকে আর কি নামে ভূষিত করব? বাস্তবিকই "স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে তা রক্ষা করা বড় কঠিন।"
সৃষ্টিকর্তার কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, যে পরাধীনতার স্বাদ আমাদের পেতে হয়নি কখনো যেন তা পেতে না হয়। লাল-সবুজের এই পতাকার মর্যাদা কখনো যেন ভূলুন্ঠিত হতে না হয়। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মগুলো যেন আমাদেরই মতো স্বাধীন বাতাসে শ্বাস নিতে পারে।
প্রার্থনা ছাড়া আমরা আর কি করতে পারি?

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



