somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

মাসউদুর রহমান রাজন
আমি মাসউদুর রহমান, আব্বা আম্মা ডাকেন রাজন নামে। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পারফর্মিং আর্টস-এর শিক্ষক। ফিল্মমেকিং, অভিনয়, পাবলিক স্পিকিং, প্যান্টোমাইম- এইসব বিষয় পড়াই। এর আগে স্কুলে মাস্টারি করতাম। শিক্ষকতা আমার খুব ভালোবাসার কাজ।

দাসবালিকার শৈশব (প্রথম কিস্তি)

২০ শে মে, ২০২১ রাত ৯:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
লিন্ডা ব্রেন্ট, অনুবাদ: মাসউদুর রহমান রাজন



লেখাটি লিন্ডা ব্রেন্টের লেখা Incidents in the Life of a Slave Girl নামের বই থেকে নেয়া হয়েছে। আমেরিকার দাসব্যবস্থার নির্মমতার উল্লেখযোগ্য দলিল বইটি। লেখিকা নিজেও জন্মগতভাবে একজন দাস ছিলেন। বইটি তার সেই অভিজ্ঞতার বয়ান।

আমি দাস হয়ে জন্মেছিলাম। তবে হাসি-খুশি শৈশবের ছয় বছর পার করে দেয়ার আগ পর্যন্ত অবশ্য এ খবর আমি জানতাম না। আমার বাবা ছিলেন একজন কাঠমিস্ত্রি আর এই কাজে তিনি এতটাই বুদ্ধিমত্তা আর দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন যে, যখন দূরে কোথাও দালান নির্মাণ হতো, তাকে অনেক দূর-দূরান্তে পাঠানো হতো, প্রধান কারিগর হিসেবে। তার মালকিনকে বছরে দুইশ’ ডলার আদায়ের শর্তে, এবং নিজের প্রয়োজন মেটানোর পর, তাকে তার এই ব্যবসা ও তার একান্ত কাজগুলো করার সুযোগ দেয়া হতো। তার জীবনের সবচে’ বড় লক্ষ্য ও আকাঙ্ক্ষা ছিলো- তার সন্তানদের ক্রয় করা। যদিও বেশ কয়েকবার সে তার বহু কষ্টের উপার্জন এই উদ্দেশ্যে ব্যয় করতে চেয়েছিল, কিন্তু কখনোই সে সফল হয়নি। আমার মা-বাবা দু’জনেরই চামড়ার রঙ ছিলো হালকা বাদামী, আর তাদেরকে মুলাটো (শেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গের মিলনে যাদের জন্ম) বলে ডাকা হতো। একটা আরামদায়ক ঘরে তারা দু’জনেই একসাথে থাকতেন। আর যদিও আমরা সবাই ছিলাম দাস, আমাকে এতটা আদর স্নেহে লালন পালন করা হয়েছিল যে, আমি কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি, আমি ব্যবসার একটি পন্যদ্রব্য ছাড়া আর কিছুই ছিলাম না, তাদের কাছে আমাকে জমা রাখা হয়েছিল যাতে আমি নিরাপদে থাকি, এবং যে কোন মুহুর্তে আমাকে তাদের কাছ থেকে দাবি করা হতে পারে।

আমার আর এক ভাই ছিলো, উইলিয়াম, যে আমার চাইতে দুই বছরের ছোট ছিলো। সুন্দর ও আদুরে একটা ছেলে। আমার একটা গোপন বড় ভাণ্ডারও ছিলো- আমার নানী, অনেকগুলো কারণে যিনি ছিলেন আমার কাছে একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি। তিনি ছিলেন সাউথ ক্যারোলিনায় ঊপনিবেশ স্থাপনকারী জনৈক ব্যক্তির কন্যা, যিনি, তার মৃত্যুর সময়, আমার নানীর মাকে ও তার তিন সন্তানকে মুক্ত করে দেন, সঙ্গে কিছু অর্থও প্রদান করেন যাতে তারা সেন্ট অগাস্টিনে চলে যেতে পারে, যেখানে তাদের আত্মীয়-স্বজনেরা বসবাস করতো। এটা ছিলো রেভুলুশনারি যুদ্ধকালীন সময়ের কথা; যাবার পথে তাদেরকে বন্দী করা হলো, ফিরিয়ে আনা হলো, আর অন্য একজন ক্রেতার কাছে বিক্রি করে দেয়া হলো। এ ধরণের একটা গল্পই আমার নানী আমাকে বলতেন, তবে হুবুহু সবগুলো ঘটনা আমি মনে করতে পারি না। যখন তাকে বন্দী করা হয়েছিল তখন তিনি ছিলেন খুব ছোট একটা বালিকা এবং তাকে বিশাল এক হোটেলের মালিকের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। আমি প্রায়ই তাকে বলতে শুনতাম, কতটা কষ্টের মধ্য দিয়ে কেটেছে তার শৈশব। তবে বড় হওয়ার পর, দিনে দিনে তার বুদ্ধিমত্তা প্রকাশ পেতে লাগলো। পাশাপাশি তিনি এতটাই বিশ্বস্ত ছিলেন যে, তার মালিক ও মালিকের স্ত্রীর, তাদের নিজেদের প্রয়োজনের খাতিরেই এমন একটা মূল্যবান সম্পত্তির যথাযথ যত্ন না নিয়ে উপায় ছিলো না। গৃহস্থালি কাজকর্মের জন্য তিনি হয়ে উঠেছিলেন অপরিহার্য ব্যক্তি- রান্না করা, বাচ্চা-কাচ্চার দেখাশোনা থেকে জামা-কাপড় সেলানো পর্যন্ত, সব কাজ নিজের সামর্থমতো তিনি তদারকি করতেন। তিনি সব থেকে বেশি প্রশংসিত হয়েছিলেন তার হাতের রান্নার জন্য। আর তার হাতে বানানো বিস্কুট আশে পাশে এতটাই বিখ্যাত হয়েছিল যে, অনেকেই তা খেতে চাইতো। তাই, এমন অসংখ্য অনুরোধের কারণে, তিনি তার মালকিনের কাছ থেকে রাতের বেলা, ঘরের সব কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর, বিস্কুট বানানোর অনুমতি চাইলেন। যা লাভ হবে তা থেকে নিজের এবং নিজের সন্তানদের জামা-কাপড়ের খরচ বহন করার শর্তে তিনি এ কাজ করার অনুমতি পেলেন। এই শর্ত মেনে নিয়ে, সারাদিন তার মালকিনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করার পর, মাঝরাতে তিনি তার বড় দুই সন্তানের সহযোগিতায় বিস্কুট বানানোর কাজটি শুরু করতেন। কিছুদিনের মধ্যেই এ ব্যবসা লাভজনক বলে প্রমাণিত হলো। আর প্রত্যেক বছরই তিনি অল্প কিছু করে অর্থ সঞ্চয় করতে শুরু করলেন, যা তার নিজের সন্তানদের ক্রয় করবার তহবিলে জমা হতে থাকলো।



ইতিমধ্যে তার মালিক মৃত্যুবরণ করলেন এবং তার সমস্ত সম্পত্তি তার উত্তরাধিকারদের মধ্যে ভাগ হয়ে গেলো। মালিকের বিধবা স্ত্রী স্বামীর হোটেলটি ভাগে পেলেন যা তিনি চালিয়ে যেতে থাকলেন। আমার নানী দাসী হিসেবে তার ভাগেই পড়লেন কিন্তু তার সন্তানরা ভাগ হয়ে গেলো তার মালিকের সন্তানদের মধ্যে। যেহেতু তার ছিলো পাঁচজন সন্তান, তাদের মধ্যে সবার ছোট বেনজামিনকে বিক্রি করে দেয়া হলো, যাতে প্রত্যেক উত্তরাধিকারিরা ডলার ও সেন্টের ভাগ সমানে সমান পেতে পারে। আমাদের দু’জনের বয়সের পার্থক্য এতই কম ছিলো যে, তাকে আমার আংকেল না বলে ভাই বললেই বেশি মানাতো। সে ছিলো উজ্জ্বল, সুঠাম দেহের একটা ছেলে। ওর গায়ের রঙ প্রায় ফর্সাই ছিলো। গায়ের এই রঙ সে পেয়েছিলো আমার নানীর অ্যাংলো-সেক্সন পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে। যদিও তার বয়স ছিলো মাত্র ১০, তার দাম উঠেছিলো ৭২০ ডলার!

বেনজামিনের বিক্রি হয়ে যাওয়া আমার নানীর জন্য বিরাট একটা আঘাত ছিলো। কিন্তু তিনি আশাবাদী প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তাই তিনি আবার নবউদ্যমে কাজে ফিরে গেলেন, এই বিশ্বাসে- কোন এক সময় তিনি তার কয়েকজন সন্তানকে কিনতে সক্ষম হবেন। তিনি ৩০০ ডলার জমা করলেন, যা তার মালকিন একদিন তার কাছ থেকে খুব শিগগীরই ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিয়ে গেলেন। পাঠক হয়তো জানেন, দাস-দাসীকে দেয়া কোন মৌখিক বা লিখিত প্রতিশ্রুতির কোন আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। কারণ, দক্ষিণাঞ্চলের আইন অনুসারে, একজন দাস কোন সম্পত্তির মালিক হতে পারে না, যেহেতু সে নিজেই একটা সম্পত্তি। যখন আমার নানী তার রক্ত পানি করে উপার্জন করা অর্থ তার মালকিনকে ধার দেন, তিনি শুধুমাত্র তার মালকিনের সম্মানের উপরেই বিশ্বাস রেখেছিলেন- একজন দাসের কাছে একজন দাসমালিকের সম্মান!


সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মে, ২০২১ রাত ৯:৩১
১৩টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=আকাশে তাকিয়ে ডাকি আল্লাহকে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০১


জীবনে দুঃখ... আসলে নেমে
শান্তি গেলে থেমে;
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে হই উর্ধ্বমুখী,
আল্লাহকে বলি সব খুলে, কমে যায় কষ্টের ঝুঁকি।

আমি আল্লাহকে বলি আকাশে চেয়ে,
জীবন নাজেহাল প্রভু দুনিয়ায় কিঞ্চিত কষ্ট পেয়ে;
দূর করে দাও সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

"ছাত্র-জনতার বেপ্লবের" ১৮ মাস পরে, আপনার ভাবনাচিন্তা ঠিক আগের মতোই আছে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৭



২০২৪ সালের পহেলা জুলাই "ছাত্র-জনতার বেপ্লব শুরু হয়, "৩৬শে জুলাই" উহা বাংলাদেশে "নতুন বাংলাদেশ" আনে; তখন আপনি ইহাকে ব্যাখ্যা করেছেন, ইহার উপর পোষ্ট লিখেছেন, কমেন্ট করেছেন; আপনার... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

টাঙ্গাইল শাড়িঃ অবশেষে মিললো ইউনস্কর স্বীকৃতি

লিখেছেন কিরকুট, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৭



চারিদিকে যে পরিমান দুঃসংবাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর মধ্যে নতুন এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হলো বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের তাতের শাড়ি এর জন্য, ইউনেস্কো এই প্রাচীন হ্যান্ডলুম বুননের শিল্পকে Intangible Cultural... ...বাকিটুকু পড়ুন

×