
লেখাটি লিন্ডা ব্রেন্টের লেখা Incidents in the Life of a Slave Girl নামের বই থেকে নেয়া হয়েছে। আমেরিকার দাসব্যবস্থার নির্মমতার উল্লেখযোগ্য দলিল বইটি। লেখিকা নিজেও জন্মগতভাবে একজন দাস ছিলেন। বইটি তার সেই অভিজ্ঞতার বয়ান।
আমি দাস হয়ে জন্মেছিলাম। তবে হাসি-খুশি শৈশবের ছয় বছর পার করে দেয়ার আগ পর্যন্ত অবশ্য এ খবর আমি জানতাম না। আমার বাবা ছিলেন একজন কাঠমিস্ত্রি আর এই কাজে তিনি এতটাই বুদ্ধিমত্তা আর দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন যে, যখন দূরে কোথাও দালান নির্মাণ হতো, তাকে অনেক দূর-দূরান্তে পাঠানো হতো, প্রধান কারিগর হিসেবে। তার মালকিনকে বছরে দুইশ’ ডলার আদায়ের শর্তে, এবং নিজের প্রয়োজন মেটানোর পর, তাকে তার এই ব্যবসা ও তার একান্ত কাজগুলো করার সুযোগ দেয়া হতো। তার জীবনের সবচে’ বড় লক্ষ্য ও আকাঙ্ক্ষা ছিলো- তার সন্তানদের ক্রয় করা। যদিও বেশ কয়েকবার সে তার বহু কষ্টের উপার্জন এই উদ্দেশ্যে ব্যয় করতে চেয়েছিল, কিন্তু কখনোই সে সফল হয়নি। আমার মা-বাবা দু’জনেরই চামড়ার রঙ ছিলো হালকা বাদামী, আর তাদেরকে মুলাটো (শেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গের মিলনে যাদের জন্ম) বলে ডাকা হতো। একটা আরামদায়ক ঘরে তারা দু’জনেই একসাথে থাকতেন। আর যদিও আমরা সবাই ছিলাম দাস, আমাকে এতটা আদর স্নেহে লালন পালন করা হয়েছিল যে, আমি কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি, আমি ব্যবসার একটি পন্যদ্রব্য ছাড়া আর কিছুই ছিলাম না, তাদের কাছে আমাকে জমা রাখা হয়েছিল যাতে আমি নিরাপদে থাকি, এবং যে কোন মুহুর্তে আমাকে তাদের কাছ থেকে দাবি করা হতে পারে।
আমার আর এক ভাই ছিলো, উইলিয়াম, যে আমার চাইতে দুই বছরের ছোট ছিলো। সুন্দর ও আদুরে একটা ছেলে। আমার একটা গোপন বড় ভাণ্ডারও ছিলো- আমার নানী, অনেকগুলো কারণে যিনি ছিলেন আমার কাছে একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি। তিনি ছিলেন সাউথ ক্যারোলিনায় ঊপনিবেশ স্থাপনকারী জনৈক ব্যক্তির কন্যা, যিনি, তার মৃত্যুর সময়, আমার নানীর মাকে ও তার তিন সন্তানকে মুক্ত করে দেন, সঙ্গে কিছু অর্থও প্রদান করেন যাতে তারা সেন্ট অগাস্টিনে চলে যেতে পারে, যেখানে তাদের আত্মীয়-স্বজনেরা বসবাস করতো। এটা ছিলো রেভুলুশনারি যুদ্ধকালীন সময়ের কথা; যাবার পথে তাদেরকে বন্দী করা হলো, ফিরিয়ে আনা হলো, আর অন্য একজন ক্রেতার কাছে বিক্রি করে দেয়া হলো। এ ধরণের একটা গল্পই আমার নানী আমাকে বলতেন, তবে হুবুহু সবগুলো ঘটনা আমি মনে করতে পারি না। যখন তাকে বন্দী করা হয়েছিল তখন তিনি ছিলেন খুব ছোট একটা বালিকা এবং তাকে বিশাল এক হোটেলের মালিকের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। আমি প্রায়ই তাকে বলতে শুনতাম, কতটা কষ্টের মধ্য দিয়ে কেটেছে তার শৈশব। তবে বড় হওয়ার পর, দিনে দিনে তার বুদ্ধিমত্তা প্রকাশ পেতে লাগলো। পাশাপাশি তিনি এতটাই বিশ্বস্ত ছিলেন যে, তার মালিক ও মালিকের স্ত্রীর, তাদের নিজেদের প্রয়োজনের খাতিরেই এমন একটা মূল্যবান সম্পত্তির যথাযথ যত্ন না নিয়ে উপায় ছিলো না। গৃহস্থালি কাজকর্মের জন্য তিনি হয়ে উঠেছিলেন অপরিহার্য ব্যক্তি- রান্না করা, বাচ্চা-কাচ্চার দেখাশোনা থেকে জামা-কাপড় সেলানো পর্যন্ত, সব কাজ নিজের সামর্থমতো তিনি তদারকি করতেন। তিনি সব থেকে বেশি প্রশংসিত হয়েছিলেন তার হাতের রান্নার জন্য। আর তার হাতে বানানো বিস্কুট আশে পাশে এতটাই বিখ্যাত হয়েছিল যে, অনেকেই তা খেতে চাইতো। তাই, এমন অসংখ্য অনুরোধের কারণে, তিনি তার মালকিনের কাছ থেকে রাতের বেলা, ঘরের সব কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর, বিস্কুট বানানোর অনুমতি চাইলেন। যা লাভ হবে তা থেকে নিজের এবং নিজের সন্তানদের জামা-কাপড়ের খরচ বহন করার শর্তে তিনি এ কাজ করার অনুমতি পেলেন। এই শর্ত মেনে নিয়ে, সারাদিন তার মালকিনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করার পর, মাঝরাতে তিনি তার বড় দুই সন্তানের সহযোগিতায় বিস্কুট বানানোর কাজটি শুরু করতেন। কিছুদিনের মধ্যেই এ ব্যবসা লাভজনক বলে প্রমাণিত হলো। আর প্রত্যেক বছরই তিনি অল্প কিছু করে অর্থ সঞ্চয় করতে শুরু করলেন, যা তার নিজের সন্তানদের ক্রয় করবার তহবিলে জমা হতে থাকলো।

ইতিমধ্যে তার মালিক মৃত্যুবরণ করলেন এবং তার সমস্ত সম্পত্তি তার উত্তরাধিকারদের মধ্যে ভাগ হয়ে গেলো। মালিকের বিধবা স্ত্রী স্বামীর হোটেলটি ভাগে পেলেন যা তিনি চালিয়ে যেতে থাকলেন। আমার নানী দাসী হিসেবে তার ভাগেই পড়লেন কিন্তু তার সন্তানরা ভাগ হয়ে গেলো তার মালিকের সন্তানদের মধ্যে। যেহেতু তার ছিলো পাঁচজন সন্তান, তাদের মধ্যে সবার ছোট বেনজামিনকে বিক্রি করে দেয়া হলো, যাতে প্রত্যেক উত্তরাধিকারিরা ডলার ও সেন্টের ভাগ সমানে সমান পেতে পারে। আমাদের দু’জনের বয়সের পার্থক্য এতই কম ছিলো যে, তাকে আমার আংকেল না বলে ভাই বললেই বেশি মানাতো। সে ছিলো উজ্জ্বল, সুঠাম দেহের একটা ছেলে। ওর গায়ের রঙ প্রায় ফর্সাই ছিলো। গায়ের এই রঙ সে পেয়েছিলো আমার নানীর অ্যাংলো-সেক্সন পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে। যদিও তার বয়স ছিলো মাত্র ১০, তার দাম উঠেছিলো ৭২০ ডলার!
বেনজামিনের বিক্রি হয়ে যাওয়া আমার নানীর জন্য বিরাট একটা আঘাত ছিলো। কিন্তু তিনি আশাবাদী প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তাই তিনি আবার নবউদ্যমে কাজে ফিরে গেলেন, এই বিশ্বাসে- কোন এক সময় তিনি তার কয়েকজন সন্তানকে কিনতে সক্ষম হবেন। তিনি ৩০০ ডলার জমা করলেন, যা তার মালকিন একদিন তার কাছ থেকে খুব শিগগীরই ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিয়ে গেলেন। পাঠক হয়তো জানেন, দাস-দাসীকে দেয়া কোন মৌখিক বা লিখিত প্রতিশ্রুতির কোন আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। কারণ, দক্ষিণাঞ্চলের আইন অনুসারে, একজন দাস কোন সম্পত্তির মালিক হতে পারে না, যেহেতু সে নিজেই একটা সম্পত্তি। যখন আমার নানী তার রক্ত পানি করে উপার্জন করা অর্থ তার মালকিনকে ধার দেন, তিনি শুধুমাত্র তার মালকিনের সম্মানের উপরেই বিশ্বাস রেখেছিলেন- একজন দাসের কাছে একজন দাসমালিকের সম্মান!
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মে, ২০২১ রাত ৯:৩১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





