somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দ্যা লাস্ট ডেইজ অফ মিস্টার হাসান (একজন ব্যর্থ মানুষের শেষ জীবন এবং একটি সত্য-কঠিন বাস্তবতা)

৩০ শে জানুয়ারি, ২০১১ রাত ২:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


গল্পের প্রথম পর্বে সুস্পষ্ট পটভূমি...

হাসান সাহেব এখনো বারান্দার ঝকঝকে রোদের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি মনের ইচ্ছাটাকে দমাতে পারছেন না। এটা ঠিক না। বুড়ো বয়সে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মনের ইচ্ছেকে দমাতে না পারার কোন মানে হয় না। এটা রীতিমতো লজ্জাজনক। তিনি মনের ইচ্ছেটাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন। পারছেন না। ঝকঝকে শুভ্র রোদ তাকে চুম্বকের মতো টানছে।
হাসান সাহেব শেষ পর্যন্ত বারান্দা থেকে চোখ সরালেন। নিজের বেডরুমটা দেখতে লাগলেন মনোযোগ দিয়ে। তার লেন্সযুক্ত ঘোলাটে চোখ দুটোতে আগ্রহের ঝিলিক দেখা গেল। তিনি আগ্রহের সাথে নিজ রুমটা দেখতে লাগলেন।
তার সামনে একটা ছোট টেবিল। সেখানে একটা নেবুলাইজার রাখা। নেবুলাইজারের পাশে কতগুলো শিশি। এগুলো নেবুলাইজারের সল্যুশন। নির্দিষ্ট সময় পরপর নেবুলাইজারে নতুন করে সল্যুশন যোগ করতে হয়। তার স্ত্রী এজন্য অনেকগুলো শিশি কিনে রেখে দিয়েছেন। পারভিন আক্তার এসব ব্যাপারে অতিমাত্রায় যত্নশীল। এজন্য তিনি স্ত্রীর উপরে খানিকটা বিরক্ত।
ছোট টেবিলের পেছনে একটা বড় টেবিল। সেখানে নানা ধরনের ওষুধের ছড়াছড়ি। হাসান সাহেব ওষুধের প্যাকেটগুলোর রং দেখে অবাক হলেন। আজকাল ওষুধের প্যাকেটগুলো বেশ সুন্দর হয়। কেন কে জানে। হয়তো কোম্পানিগুলোর কোন কৌশল এটা। বড় টেবিলের পাশে একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখা। দড়ি দিয়ে জানালার গ্রিেলর সাথে শক্ত করে সিলিন্ডারটিকে বেঁধে রাখা হয়েছে।

বেশ কয়েক বছর আগে যখন স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারতেন, তখন তিনি আর তাঁর একমাত্র ছেলে এই সিলিন্ডারটি কিনে এনেছিলেন। সিলিন্ডারটি কোত্থেকে, কত টাকা দিয়ে কিনেছিলেন তাঁর কিছুই মনে পড়ছে না। অথচ এটা ভুলে যাওয়ার মতো কিছু না। বাসায় অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে আনা তার জীবনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আগে মনে করতেন এ ধরনের যন্ত্র হাসপাতালে জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীদের জন্যই শুধু প্রযোজ্য। তাকে যখন ডাক্তার এই যন্ত্রটা কিনতে বলল, তিনি প্রথমে মনে করেছিলেন ডাক্তার তার সাথে মজা করছে। পরে অবশ্য সিলিন্ডার থেকে নিয়ম করে অক্সিজেন নেওয়াতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন সহজেই।
মানুষের জীবনটাই এরকম। হাসান সাহেব কর্মক্ষমতা হারিয়ে পুরোপুরি বেকার হয়ে যাওয়ার কথা দু:স্বপ্নেও ভাবেন নি কখনো। অথচ আজ এই নিষ্ক্রিয় জীবনে খুব ভালভাবেই মানিয়ে গেছেন। জীবনের প্রতি তার খুব একটা বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হয় নি। একটা মায়ার শক্ত বাঁধনে তিনি আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। তার ছেলের মায়া। একমাত্র ছেলের মায়া।

তার চিন্তা এখন ছেলের দিকে চলে গেল। পাঁচ পাঁচটি মেয়ের পর এই ছেলেটিকে রাব্বুল আলামীন তার কাছে পাঠিয়েছেন। পাঁচ মেয়ে নিয়ে হাসান সাহেবের কখনোই বিন্দুমাত্র হতাশা ছিল না। তিনি এজন্য কখনো মন খারাপ করেন নি। কিন্তু ছেলের প্রতি অস্বাভাবিক টানকেও তিনি অস্বীকার করতে পারেন না। তার মনে পড়ে গেল, ছেলেটার জন্ম যেদিন হয়েছিল সেদিন ছিল বুধবার। বাইরে তখন প্রচণ্ড বৃষ্টি। প্রবল বৃষ্টিতে ছাতা মাথায় ফজরের নামায পড়তে গেলেন। নামায পড়ার সময় তিনি শুধু দোয়া করলেন- "রাব্বুল আলামিন, আমার স্ত্রী আর নতুন সন্তানটিকে সুস্থ রেখো...।"

বাসায় এসে দেখলেন তার একটি পুত্র সন্তান জন্ম নিয়েছে। তিনি তখনও নির্লিপ্ত। চুপচাপ কিছুক্ষণ বারান্দায় বসে থাকলেন। এরপর জায়নামায নিয়ে নামাযে বসলেন। দুই রাকাআত নফল নামায পড়লেন। মোনাজাত করার সময় তার চোখ দিয়ে হু হু করে পানি পড়তে লাগল। সেদিন তার বাঁধ ভাঙা কান্না আত্মীয়স্বজন সবাই দেখেছিল। আত্মীয়স্বজনের কাছে তিনি কঠিন হৃদয়ের মানুষ। হাসান সাহেবের চোখে পানি দেখার জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না। পাথরের বুক চিরে হঠাৎ ঝর্ণার প্রবাহে তারা বেশ বিস্মিত হল।
তিনি নিজেও পরে কান্নাকাটির কথা চিন্তা করে অনেকখানি বিব্রত। অবশ্য ছেলের মুখটা দেখার পর তার আর কিছুই মনে রইল না।
হাসান সাহেব অতীত স্মৃতিচারণ থেকে বাস্তবে ফিের এলেন। এবং বিচিত্র বিস্ময়ের সাথে দেখলেন, তার লেন্সযুক্ত- ঝাপসা- ঘোলাটে চোখ দুটো থেকে ঝর ঝর করে পানি পড়ছে। তিনি পানি আটকে রাখতে পারছেন না। হাত দিয়ে চোখের পানি মুছলেন। পানি আরো বেশি করে পড়তে লাগল।

হাসান সাহেবের কেন জানি নিজ ছেলের মুখ দেখতে ইচ্ছে করছে। তিনি দেয়ালের দিকে তাকালেন। সেখানে একটা বড়সড় ছবি টাঙানো। তার আর তার ছেলের ছবি। ছবিটা অনেক আগের তোলা।
আচ্ছা, ছেলেটা কি ঘরে আছে? নাকি বাইরে? হাসান সাহেব মনে করতে পারছেন না। তিনি কি ডেকে দেখবেন?

চোখের পানি মুছে এক মুহুর্ত দ্বিধা করে হাসান সাহেব তার ছেলেকে ডাকলেন।

-সাইফ, ও সাইফ।

কোন জবাব নেই।

তিনি আবার ডাকলেন।

-সাইফ।

তার রুমের দরজার সামনে তার ছেলে, সাইফ এসে দাঁড়ালো। হাসান সাহেব ছেলের মুখখানি দেখলেন ঘোলাটে দৃষ্টিতে। তার মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল। আর অবাক বিস্ময়ের সাথে তিনি দেখলেন, তার চোখ দিয়ে আবার পানি পড়ছে। তিনি কাঁদছেন। খুব বিচ্ছিরিভাবে কাঁদছেন।
পিতার এ কান্না দেখে তার এস এস সি পরিক্ষার্থী সন্তানের বুক ভেঙে গেল। তার চারপাশের পৃথিবী হঠাৎ দুলে উঠল। সে বাবার সামনে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। চুপচাপ ফিরে গেল নিজ রুমে।

হাসান সাহেব নিজের উপর বিতৃষ্ণা চলে এসেছে। নিজ ছেলের সামনে বাচ্চার মতো কান্নাকাটি করার মতো লজ্জার কাজ আর কি হতে পারে?




....And nothing quite so least as truth
I say though hate were why men breathe--
Because my Father lived his soul
Love is the whole and more than all....

-My Father Moved Through Dooms of Love
E E Cummings




চলবে......
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১১ রাত ১০:০৫
১৭টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×