somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মেঘপঞ্জিকা - সিনেমাকথন ৩৫

০৭ ই আগস্ট, ২০১১ ভোর ৫:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


একটা তীব্র ক্রোধ, আক্রোশ, ঘৃণা, ক্ষোভ আর অপমানে ছেয়ে আছে সমস্ত ভেতরটা। রাগে সমস্ত গা জ্বলে যাচ্ছে। সেই সাথে আবার একটা গর্ববোধও কাজ করছে। এই মিশ্র অনুভূতিগুলোয় হচ্ছে "গেরিলা" মুভিটা দেখে উঠার পর আমার নিজের প্রতিক্রিয়া।

একটা গান বাজছে এখন হেডফোনে। "জয় সত্যেরও জয়"। ছবিতে আলতাফ মাহমুদের মেয়ে গাইছিল গানটা। দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে থেকে থেকে একটা একটা করে।



নির্বিচারে মানুষহত্যার দৃশ্যগুলো, নির্মম নির্যাতনের দৃশ্যগুলো, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাশের দৃশ্য, গেরিলাদের সুকৌশলে অতর্কিত আক্রমণের, শরণার্থীদের অসহায় অবস্থার, বিলকিসের করুণ মুখ, আর শেষ দৃশ্যের তার সেই হাসিটা। ভেবে দেখলে "গেরিলার" সাফল্য এইখানেই। এই বাঙ্গালী চেতনাকে উদ্দীপ্ত করতে পারাটা। এই মুভির মানুষগুলোর সাথে নিজের অনুভূতি দিয়ে অনুভব করতে পারাটা।

এই কথা মানতেই হয়, গেরিলা মুভিটা মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মুভিগুলোর জন্য একটা বড়সর মাইলফলক। এমন না যে এর আগে এমন গা শিউওরে উঠা দৃশ্যগুলো, সময়গুলো উঠে আসেনি। এসেছে কিন্তু গেরিলার মত এমন করে চামড়ার ভেতরের প্রাণটাকে এমন করে নাড়া দিয়ে যায় নি। এমন কিছু মুহূর্ত আছে ছবিটাতে যেখানে আমার মত অনেকেরও হয়তো হাত নিশপিশ করেছে রাজাকার, আলবদরদের মুখে একটা ঘুঁসি হাকিয়ে দিতে। কখনো কখনো হয়তো চোখদুটো আদ্র হয়ে উঠেছে। আবার হয়তোবা গর্বে বুকটা ফুলে উঠেছে যখন দেখি ঘরছাড়া বীর মুক্তিযুদ্ধারা নিজের জীবনটাকে নির্ভয়ে বিলিয়ে দিচ্ছে দেশের স্বাধীনতার জন্য, মুক্তির জন্য। জয়ের, আনন্দের স্বাদ পাই যখন দেখি তারা গেরিলা অপারশনে বিজয় ছিনিয়ে আনছে।

স্বাধীনতা বিরোধীদের এমন বাস্তব, সাহসিক উপস্থাপনা আমি এর আগে কোন মুভিতে দেখিনি। কচি খন্দকার তার দারুণ অভিনয় দিয়ে রাজাকারের ভূমিকা যথাযত ভাবে পালন করেছেন। মুভিটাতে একটা উর্দু সংলাপ শুনে আমার মাথায় যেন দপ করে আগুন জ্বলে উঠেছিল। যখন পাকিস্থানী অফিসাররূপী শতাব্দী ওয়াদুদ বলে, বেঈমানের দেশ এইটা, কেও না কেও তো খোকন কমান্ডারের খবর এনে দিবেই। মুভিটা কিছুক্ষণ পওসে দিয়ে রেখেছিলাম। রাগে, অপমানে শরীরটা জ্বলে যাচ্ছিল। মনে জাগছিল, এই সব স্বাধীনতা বিরোধীদের মন্ত্রীত্ব, বীর দর্পে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা রক্ষার দায়িত্ব পালনের কথাগুলো। কেমন করে পারি আমরা এই সব পা-ছাটা মানুষগুলোকে আমাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে। আমার ক্ষোভ, আক্রোশের হেতু এইখানেই।

ধর্মকে, ধর্মীয় বিশ্বাসকে কাজে লাগানো এইসব স্বার্থসিদ্ধির মানুষগুলোর চিত্রায়ন যখন মুভিতে দেখি, এবং যখন জানি যে বাস্তবের এই মানুষগুলো এখনো বহাল তবিয়তে আছে এবং এখনো সেই একি কাজগুলো করে যাচ্ছে তখন নিজেদের অসহায়ত্বের কথা ভেবে অপমান লাগে। ধর্মব্যাবসায়ী দের নিয়ে বঙ্কিম চন্দ্র চ্যাটার্জীর লেখা একটা আর্টিকেলের কথা মনে পড়ছিল। তিনি লিখছিলেন -

"আমরা এমন একজন ভূস্বামী কে জানি যিনি বাক্ষ্মণ এবং কড়া হিন্দু। শীতকালে বা গরমে তিনি খুব প্রত্যুষে উঠে গোসল সারতেন। তারপর কয়েক ঘন্টা ধরে কঠোর নিয়মকানুনের সাথে তার রোজকার প্রার্থনা চলতো। সামান্য ব্যাঘাতেও তার মনে হত যেন শরীরে হুল ফুটেছে। তিনি দিনে কেবল একবার নিরামিষ দিয়ে আহরাদি সারতেন এবং সেটি দুপুরে। এরপর তিনি তার জায়গাজমির নানা বিষয়াদি কাজ নিয়ে বসতেন। সেই সময়টাতে তার ধ্যান পুরোপুরি যেত কিভাবে তার প্রজাদের সর্বনাশ ঘটানো যায়, কেমন করে কোন গরীব বিধবাকে ঠকিয়ে তার সহায় সম্পত্তি হরণ করা যায়, তার অংশীদারদের কিভাবে ধোঁকা দেয়া যায়, মিথ্যা সাক্ষী দিইয়ে কিভাবে কোন সৎ লোককে জেলে পাঠানো যায়, বা কিভাবে নথীপত্র জাল করে মামলা জেতা যায়। এবং সবদিক দিয়েই তিনি তার এই সমস্ত কার্যাদিতে সফল হতেন। যদিও আমরা এও জানি যে তিনি তার ভগবানের প্রার্থনায় পুরোপুরি নিবেদিত এবং একজন নিখাদ ব্রাক্ষ্মণ। এমনকি তিনি যখন নথিপত্র জাল করতেন তখনও হরির নাম নিয়ে করতেন এই ভেবে যে এতে তার ধোঁকা দেওয়াটা ফলফস্রু হবে।"

উপরের কথাগুলো যেন ব্যঙ্গ করে বলছে যে দেখো প্রায় দেড়শো বছর পরেও এই সমস্ত ধর্মব্যাবসায়ীদের কার্যকলাপের কোন প্রতিবাদ আমরা করতে পারছিনা। কি নির্মম পরিহাস!

অভিনয়ের প্রসঙ্গে আসি। একটা কথা মনে আসছিল জয়া আহসানের অভিনয় দেখতে দেখতে। এমন অনেক চলচিত্র পুরষ্কার অনুষ্টানে মাঝে মধ্যে দেখা যায়, নতুন একটা ক্যাটাগরীতে এমন কিছু মুভিকে বা অভিনেতা অভিনেত্রীদের পুরষ্কৃত করতে যার মান অসাধারণের অনেক উচুঁতে। এমন কিছু চরিত্র বা মুভি যেগুলো মানুষ হয়তো জীবনে একবারই চিত্রায়িত বা নির্মাণ করতে পারে, যা বাধ্য করে নতুন কোন ক্যাটাগরী দিয়ে সেইসব মানুষগুলোকে তাদের কাজের জন্য সম্মান প্রদর্শনের। তেমন কিছু আমার মতে বিলক্ষণ করা যায় এই মুভিতে জয়া আহসানের অভিনয়ের জন্য। মনে ভাবছিলাম সেই পুরষ্কারের নামটা কি হতে পারে। "গেরিলা" নামটা মন্দ শোনায় না... প্রণতি জয়া আহসানকে, প্রণতি তার অভিনয় প্রতিভাকে।



লেখাটা বোধহয় বেশ বড় হয়ে যাচ্ছে। শেষ করার আগে মুভিটার ছোটখাট আর কিছু বিষয় নিয়ে কিছু বলি, যেগুলো আমার দৃষ্টি কেড়েছে। মুভিটার প্রথম ত্রিশ-চল্লিশ মিনিট দেখে আমি চরম হতাশ হয়েছিলাম। ভেবে পাচ্ছিলাম না কেন এই মুভিটা নিয়ে মানুষের এত উচ্ছ্বাস। এমন অসংলগ্ন, কাঁচা হাতের প্রদর্শনী। চূড়ান্তরকমের বাজে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক (যেটি অবশ্য পরের দিকে অনেক ভালো হয়েছিল)। গান নির্বাচন, এক জয় সত্যের জয় ছাড়া বাকী সব গানই আমার কাছে বেখাপ্পা, বেমানান ঠেকেছে। আর গানের কন্ঠগুলোও অনেক সাধারণ মানের। বাজে এডিটিং, ডাবিং এর সমস্যা, যুদ্ধের দৃশ্যগুলোর দুর্বল উপস্থাপনা, অতিরিক্ত নাটকীয়তা আর দুর্বল চিত্রনাট্য। যেগুলো ভুজবাজির মত পরের দিকে কেমন শিল্পিত হয়ে উঠেছিল। পরিচালকই ভালো উত্তর দিতে পারবেন কেন এমন পরিণতি হল শুরুর দিকে। এমন মুভিতো আর অহরহ করা যায়না। আরেকটু সময় নিয়ে কি প্রথম দিকের অংশগুলো ভালোভাবে করা যেতনা!

অবশ্য গুরত্বপূর্ণ হচ্ছে মুভিটা দেখে উঠে মনের ভেতর কি রেশ থেকে যাচ্ছে, মুভিটা ভাবতে বাধ্য করছে কিনা সেটার উপর, উপরে যার স্তুতি আমি ইতিমধ্যেই করেছি। তারপরেও আরো কিছু কীর্তন বোধহয় গাওয়া যায়। বেশ অনেক নতুন অভিনয় প্রতিভাকে পেলাম আমরা এই মুভির বদৌলতে, যার জন্য পরিচালক বাহ্‌বা পাবেন। খাসা সিনেমাটোগ্রাফী এবং দারুণ একটা মুক্তিযুদ্ধের গল্পকে মুভিতে উপস্থাপন করতে পারাটাও পরিচালকের আরেকটি সাফল্য।

মুভিটার IMDB রেটিং ৮/১০। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মুহূর্তগুলোর একটা কাছাকাছি ধারণা পেতে নিঃদ্বিধায় মুভিটা দেখা যেতে পারে।

http://www.imdb.com/title/tt1907679/

ট্রেইলার



আমার যত সিনেমাকথন গুলো...
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে আগস্ট, ২০১১ রাত ১১:০৮
১৯টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার মায়ের চৌহদ্দি

লিখেছেন শাওন আহমাদ, ১২ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩৫



আমার মা ভীষণ রকমের বকবকিয়ে ছিলেন। কারণে-অকারণে অনেক কথা বলতেন। যেন মন খুলে কথা বলতে পারলেই তিনি প্রাণে বাঁচতেন। অবশ্য কথা বলার জন্য যুতসই কারণও ছিল ঢের। কে খায়নি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছেলেবেলার অকৃত্রিম বন্ধু

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৯

খুব ছোটবেলার এক বন্ধুর গল্প বলি আজ। শৈশবে তার সাথে আছে দুর্দান্ত সব স্মৃতি। বন্ধু খুবই ডানপিটে ধরনের ছিল। মফস্বল শহরে থাকতো। বাবার চাকুরির সুবাদে সেই শহরে ছিলাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণা!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:১৭



নীচে, আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণাকে ( পেশগত দক্ষতা ও আভিজ্ঞতার সারমর্ম ) আমি হুবহু তুলে দিচ্ছি। পড়ে ইহার উপর মন্তব্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

মোজো ইদানীং কম পাওয়া যাচ্ছে কেন?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৭


শুনলাম বাজারে নাকি বয়কটিদের প্রিয় মোজোর সাপ্লাই কমে গেছে! কিন্তু কেন? যে হারে আল্লামা পিনাকী ভাট ভাঁওতাবাজিদেরকে টাকা দিয়ে 'কোকের বিকল্প'-এর নামে 'অখাদ্য' খাওয়ানো হচ্ছিলো, আর কোককেই বয়কটের ডাক... ...বাকিটুকু পড়ুন

জমিদার বাড়ি দর্শন : ০০৮ : পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:২৪


পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি

বিশেষ ঘোষণা : এই পোস্টে ৪৪টি ছবি সংযুক্ত হয়েছে যার অল্প কিছু ছবি আমার বন্ধু ইশ্রাফীল তুলেছে, বাকিগুলি আমার তোলা। ৪৪টি ছবির সাইজ ছোট করে ১৮ মেগাবাইটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×