'মা' কে আমার পড়ে যে মনে...
স্বনামধন্য মুক্তিযোদ্ধা রুমি'র মা। বাংলাদেশের মু্িক্তযুদ্ধের সমর্থক এবং সমপ্রদানকারকে তাঁর অবদান আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে। শ্রদ্ধেয় জাহানারা ইমাম, যিনি হারিয়েছেন ছেলে, স্বামী দুই-ই আমাদের মুক্তভূমি উপহার দিতে গিয়ে। মুক্তির স্বাদ ম্লান হয়ে যায় পঁচাত্তর পরবতর্ী সরকারের রাজাকার তোষণ নীতির কারণে। দেশের সেই সন্ধিক্ষণে এই ত্যাগী মা 'নিমর্ূল কমিটি' গঠন করেন, একাত্তরের খুনী এবং পাকিস্তানী দোসর রাজাকারদের সমূলে উৎপাটনের অঙ্গীকার নিয়ে। একজন যোদ্ধার মা যেভাবে সারা বাংলাদেশের মানুষের কাছে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম হয়ে ওঠেন এখানে তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরা হলো।
1978: 11ই জুলাই। যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম, জেনারেল জিয়ার সংবিধান সংশোধনের সুযোগে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। গোলাম আযমের হাতে পাকিস্তানী পাসপোর্ট, দেশে আসার অনুমতি পায় অসুস্থ মাকে দেখার অজুহাতে (লক্ষ মায়ের সন্তান হত্যাকারী, বলাৎকার এর নাটের গুরুর মাতৃভক্তি!)। কথায় আছে সুঁই হয়ে ঢোকা, ফাল হয়ে বের হওয়া। মওকা কাজে লাগিয়ে ফেলে গোলাম আযম। জিয়ার আশীর্বাদে বাংলাদেশেই থেকে যায় সে। নিষিদ্ধ ঘোষিত মৌলবাদী দল জামায়াত ইসলামী দলকে আবার সংগঠিত করে। (যা এখনো চলছে)
1991: 29 শে ডিসেম্বর। গোলাম আযম (যে তখনো পাকিস্তানী নাগরিক) জামায়াতের আমীর নির্বাচিত হয়। সারাদেশের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে গোলাম আযম অফিসিয়ালি রাজনৈতিক দলের প্রধান হওয়াতে। কিন্তু জিয়ার যোগ্য উত্তরসূরী তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সরকার সংবিধানের এমন চরম লংঘন (বিদেশী নাগরিকের দেশের রাজনৈতিক দলের প্রধান হওয়া) একেবারে না দেখার ভান করে এড়িয়ে যায়।
1992: 2রা ফেব্রুয়ারী। জাহানারা ইমাম সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী বিভিন্ন মানুষের সমন্বয়ে গড়ে তোলেন 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি'। শপথ একটাই একাত্তরের অপরাধীদের বিচার ও তাদের বর্তমান কর্মকান্ড রুখে দেয়া। এই কমিটিতে স্বাক্ষর করেন 101জন ব্যক্তি, তারা জামায়াতের কর্মকান্ডকে অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থী বলে ঘোষণা করেন। নতুনভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু করার দাবী উথ্থাপন করেন। এই কমিটি পরবতর্ীতে জানায় জনতার আদালতে এইসব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিচারের রায় ঘোষণা করা হবে 26শে মার্চ এ, যা 21তম স্বাধীনতা দিবস।
1992: 24 শে মার্চ। গোলাম আযমকে গ্রেফতার করে তৎকালীন সরকার জেলে পাঠায়। জেল আর বাড়ী! কোন ফারাক নেই সুযোগ সুবিধার। গোলাম আযম ভিআইপি ট্রিটমেন্ট পায় জেলে। ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এবং তার অন্যান্য সহযাত্রীদের এধরনের আন্দোলন চালানোর পরিণতি সম্পর্কে সাবধান করে দেয়। প্রশাসন থেকে এও বলা হয় জনতার আদালত, সেখানে গোলাম আযমসহ অন্যান্য মুখ্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চালানো আসলে দেশের প্রচলিত আইন ও সংবিধান পরিপন্থী। এধরনের কর্মকান্ড আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার মতো অপরাধ এবং রাষ্ট্রদ্রোহীতার সামিল। দেশে নৈরাজ্য ও অরাজকাতা সৃষ্টির হোতা হিসেবে এসব বিদ্রোহীদের কোর্টে বিচার হতে পারে। খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রুমি'র মা জাহানারা ইমাম ও তার আরও 24জন সহযাত্রীর বিরুদ্ধে 'রাষ্ট্রদ্রোহীতা'র মামলা করে। জাহানারা ইমাম ও তাঁর সতীর্থরা প্রত্যেকে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে উপস্থিত হয়ে জামিন নেন।
1992: 26শে মার্চ। সোহ্রাওয়াদর্ী উদ্যানে লাখো মানুষের সামনে জাহানারা ইমাম জনতার আদালতের সব বিচারকের পক্ষে রায় পড়ে শোনান।
1993: 4ঠা এপ্রিল জাহানারা ইমাম ক্যান্সারের চিকিৎসার্থে আমেরিকা গমন করেন।
1994: 7ই জুলাই। রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা মাথা নিয়ে শহীদ জননী তাঁর শহীদ ছেলে রুমির কাছে চলে যান আমাদের ছেড়ে।
রেখে যান এই অভাগা জাতির প্রতি তাঁর শেষ চিঠি-
আমার সতীর্থ যোদ্ধারা,
আপনারা গোলাম আযম ও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী দুষ্ট শক্তির বিরুদ্ধে লড়ছেন, সেইসাথে গত তিনবছর লড়াই করছেন মুক্ত বাংলাদেশে চলমান স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধেও। বাঙ্গালী জাতি হিসেবে, আপনাদের একতা ও সাহস অতুলনীয়। আমাদের লড়াই এর শুরু থেকে আমি আপনাদের সাথে ছিলাম। লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধরত থাকা ছিল আমাদের ঐক্যবদ্ধ বিশ্বাস। ক্যান্সার আমাকে আমার চূড়ান্ত সময়ের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমি লড়াই বন্ধ করিনি। কিন্তু ক্যান্সার আমার সশরীরে আপনাদের মাঝে উপস্থিত থাকার পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে। অমোঘ নিয়তি মৃতু্যর দিকে যাত্রা বন্ধ করার কোন উপায় আমার নেই। সেজন্যই আমি আবার আমাদের প্রতিজ্ঞা লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত লড়াই করবার কথা আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। আপনারা অবশ্যই আপনাদের প্রতিজ্ঞা পূরণ করবেন। আপনারা একতাবদ্ধ থাকবেন ্এবং এর শেষ না দেখে লড়াই থামাবেন না। আমি আপনাদের মাঝে থাকবো না, কিন্তু আমি জানব আমার লক্ষ বাঙ্গালী সন্তান আগামীতে মুক্ত সোনার বাংলায় তাদের সন্তান সন্ততি নিয়ে বসবাস করছে।
আমাদের সামনে এখনো লম্বা এবং বন্ধুর পথ। সমাজের সর্বস্তর থেকে মানুষ এই লড়াইয়ে যোগ দিয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী ব্যক্তি, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন, মুক্তিযোদ্ধা, নারী, ছাত্র-ছাত্রী, তরুণ সবাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে এই লড়াই চালিয়ে নেবার জন্যে। আমি জানি, জনগণের চাইতে বড় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ শক্তি আর কিছু হতে পারে না। জনগণই শক্তি। আমি এই বিশ্বাসে বাংলাদেশের মানুষের হাতে গোলাম আযম ও তার দোসর অন্যান্য রাজাকার আলবদর, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ভার ছাড়লাম। মুক্তিযুদ্ধের সেই অনবদ্য শক্তিতে বলীয়ান হয়ে বাংলাদেশের মানুষকে সামনে এগোনোর কথা বললাম। নিশ্চিত, জয় আমাদের।
জাহানারা ইমাম
পাদটীকা: আমি জানি না আমার এই সাহসী 'মা' আজ কি ভাবছেন দূর আকাশে বসে! হাসি পায় যখন খালেদা-নিজামী-মুজাহিদীরা সংবিধান রার জন্যে কুম্ভিরাশ্রু বর্ষণ করে। আমি শুধু জানি আমরা মা'কে দেয়া প্রতিশ্রুতি একটুও রক্ষা করতে পারিনি। পারিনি তাঁর সেই বিশ্বাস এর এতটুকু মর্যাদা রাখতে। তাই আমাদের 16ই ডিসেম্বরগুলো শুধু আলোকসজ্জারই দিন, অথচ মনে এখনো গহন অন্ধকার...
প্সপ্পঙ্; আফসানা কিশোয়ার
সূত্র: ইন্টারনেট। ভাবানুবাদের কারণে কোথাও কোন অসামঞ্জস্য থাকলে তার জন্যে পাঠকের কাছে অগ্রিম মাপ্রাথর্ী

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


