কিরপিনের থাইল্যান্ড ভ্রমন (তৃতীয় পর্ব)
কিরপিনের থাইল্যান্ড ভ্রমন (প্রথম পর্ব)
কোয়াই ব্রিজ স্টেশনের লোকেশনটা এমন যে ব্যাংকক থেকে আসার সময় আগে পড়বে স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম এরপরে ব্রিজ-- আর নাম টক থেকে আসার সময় আগে ব্রিজ পরে স্টেশন। বিষয়টা মাথায় রাখিনি বলে ট্রেনে ওঠার সময় একটা ভুল করেছিলাম, পিছনের দিকের ডাব্বাতে উঠেছিলাম। তো ট্রেনের ইঞ্জিন টা যেখানে থামে, সেখানে থেকে ব্রিজ এর দূরত্ব দু-তিনশ গজের মতো। ট্রেন থামতেই গেল গেল সব গেল এই ভঙ্গিতে ব্রিজের দিকে দৌড় দিলাম।
লোকে সাপ-বাঘ-সিংহের সঙ্গে সেলফি তোলে; আমার সেরকম চলন্ত ইঞ্জিনের সঙ্গে সেলফি তোলার ইচ্ছা না। আমার ইচ্ছা ছিল ব্রিজের উপরে উঠে ট্রেনের যাওয়া দেখব। স্কুলের জুনিয়র ক্লাসের থাকার সময় পুনর্ভবা নদীর উপরের কাঞ্চন ব্রিজে এই কান্ড করার স্মৃতি মনে গেঁথে আছে। আমার মত অনেকেরই হয়তো একই রকমের ইচ্ছে ছিল; তবে ব্রিজের এই মাথা থেকে ভেতরে দাঁড়ানোর জায়গাটা একটু দূরে বলে খুব সামান্য কয়েকজনই এই সুযোগ পেয়েছে।
স্টেশন এলাকার ম্যাপ (স্কেল ঠিক রাখা হয় নি)
ভিড় ঠেলে ব্রিজের এ মাথা পর্যন্ত আসতে আসতেই ট্রেন ছেড়ে দিল, এখন আর ব্রিজে ওঠা যাবে না। এসময় পাশ থেকে একজন বলে উঠল ইউ মিসড ইট টু। উচ্চারণ শুনে জিজ্ঞাসা করলাম ব্রিটিশ? এভাবেই এলা আর ওর পরিবারের সাথে পরিচয় হয়ে গেল। এলা আর্কিটেকচারের ছাত্রী। বাবা-মা দুজনেই ওয়েলসের। থাকে লন্ডন থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরের একটা শহরে। বাবা মায়ের সাথে থাইল্যান্ড এসেছে প্রায় তিন সপ্তাহ, আরো দু সপ্তাহ থাকবে। এ বয়সের ব্রিটিশ ছেলেমেয়েরা বাবা-মায়ের সাথে ঘুরবে এমন ঘটনা ব্রিটেনে কম, তবে ওয়েলসের লোকদের পারিবারিক বন্ধন মনে হয় ইংলিশদের চেয়ে একটু বেশি। এলার বাবা একাউন্ট্যান্ট , নাম রবার্ট। মা এমিলি।
হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে বলতে ব্রিজের অপর মাথার দিকে এগোচ্ছিলাম। আমার নাম আর দেশ শুনে রবার্ট জিজ্ঞাসা করলো আমার নাম ভুয়া হাসান কিনা। আমার চোখে জিজ্ঞাসা দেখে রবার্ট বলল তার এক প্রতিবেশী আছে, নাম ভুয়া। আমি বিনয়ের সাথে রবার্টকে বুঝিয়ে দিলাম ভুয়া আসলে উচু খান্দানের লোক, বিলাতে যেরকম লর্ড। আমি অত্যন্ত সাধারণ ঘরের লোক। রবার্ট স্বীকার করল যে, হ্যাঁ তার প্রতিবেশীর আচরণ আসলে রাজা-বাদশাদের মতো, সাধারণ লোকের মত না, এই লোকের লর্ড হওয়াই স্বাভাবিক।
এলা বললো তারা একটা গাড়ি ভাড়া করে আশেপাশের জায়গা গুলো দেখতে যাবে। আমি চাইলে তাদের সঙ্গী হতে পারি। আমি চিন্তাভাবনার জন্য কয়েক মিনিট সময় নিলাম। বউকে ফোন করে ঘটনা বলতেই। সে বলল ব্যাপারটা বিয়ে-শাদী পর্যন্ত গড়ালেই শুধু তার পারমিশন এর দরকার হবে, এর আগে পারমিশন এর দরকার নেই । আর আমার মত চাঁদ মুখকে কেউ বিয়ে করতে চাইলে সে খুশি মনেই পার্মিশন তো বটেই, টাকা পয়সা সব দিয়ে দেবে। ল্যাও ঠ্যালা। কাজী ফাতেমা ছবি আপার মত বাল্যবিবাহ হলে আমার এই বয়সের একটা মেয়ে থাকতে পারত।
ক্যাম্প বার
ব্রিজের এই মাথাটা তে নতুন কিছু কনস্ট্রাকশন হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার প্রিজন ক্যাম্পের আদলে একটা এলাকা গড়ে তুলেছে। এখানে ওয়াচ টাওয়ার, ব্যারাক, কিছু পুরাতন গাড়ি, এরোপ্লেন এসব রাখা আছে। মূলত জায়গাটা মদের দোকান। সন্ধ্যের পরে জমে উঠবে, এখন বেচা-বিক্রি নেই। ফটো খিঁচতে খিঁচতে বিনয়ের সঙ্গে এলা-এমিলি-রবার্টকে আমি বললাম তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাদের যাত্রার ছন্দ পতন করাতে চাইনা। দুই ভদ্রমহিলাকে নড করে আর রবার্টের সাথে হাত মিলিয়ে ব্রিজের উপর দিয়ে হেঁটে স্টেশনে ফিরে আসলাম। ফেরার টিকিট সংগ্রহ করার জন্য টিকিট কাউন্টারে যোগাযোগ করতেই বলল ফেরার টিকিট ট্রেন ছাড়ার সময়ের আধাঘন্টা আগে দেয়া হবে।
ক্যাম্প বার এলাকায় গাড়ির সামনে এমিলি
কোয়াই ব্রিজ স্টেশন একটা ছোট্ট স্টেশন। ট্যুরিস্টরা না থাকলে মনে হয় এই স্টেশন গড়ে উঠত না। টুরিস্টের চাহিদার কথা চিন্তা করে কিছু স্যুভেনির শপ এবং নদীতে ভাসমান কয়েকটা রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে। থাকার একটা হোটেলও আছে। হোটেলের ঠিক পাশেই একটা ওয়ার মিউজিয়াম। মিউজিয়ামের উল্টো দিকে কার পার্ক এবং বিভিন্ন রেন্ট-এ-কার এর অফিস। স্টেশনের সঙ্গে ৯০ ডিগ্রি কোণে একটা রাস্তা ভেতরে শহরের দিকে চলে গিয়েছে আর একটা রাস্তা স্টেশনে সঙ্গে প্যারালাল হয়ে কাঞ্চনাবুরির দিকে গিয়েছে।
নারকেলের মালায় করে নেয়া নারকেল দুধ (জমানো), স্টিকি রাইস, লিচু, কোরানো নারকেল আর বাদাম দেয়া খাবার
দোকান থেকে ১৫ বাথ দিয়ে পানি কিনে বের হয়ে দেখি দুই রাস্তার ঠিক জাংশানেই একটা ভ্যান গাড়িতে মাঝ বয়সী এক মহিলা খাবার বিক্রি করছে। কাছে যেয়ে দেখি নারকেলের দুধ(আইসক্রিমের মতো জমানো), নারকেলের নরম শাস, স্টিকি রাইস সাথে লিচু জাতীয় একটা ফল (শুধু শাস কোন বিচি নেই-- লিচু বা রামবুটান হবে, খোসা না থাকায় বোঝা যায় নি)। খাবার সার্ভ করা হচ্ছে নারকোলের মালায়। একটা মালা নিলাম। উপরে চিনা বাদাম ছিটিয়ে দেয়া। দাম ৩০ বাথ। এটা ছিল থাইল্যান্ডে আমার খাওয়া সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার।
JEATH মিউজিয়াম
দুশ মিটার হাঁটতেই পৌছে গেলাম JEATH ওয়ার মিউজিয়ামে। JEATH আসলে জাপান-ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া-থাইল্যান্ড-হল্যান্ডের অ্যাক্রোনিম। ওয়ার মিউজিয়ামে টিকেট লাগে না তবে ডোনেশন নিচ্ছে। লজ্জার দাম ৫০ বাথ চুকিয়ে ভিতরে ঢুকলাম।
মিউজিয়ামে রাখা পুরাতন রেল লাইনের ধ্বংসাবশেষ
মিউজিয়াম থেকে দেখা ব্রিজ
হেলমেট
জাপানিদের ফেলে যাওয়া মোটরসাইকেল, স্কুটার, অস্ত্রশস্ত্র, হেলমেট, এসব রাখা আছে। পুরাতন দিনের একটা ট্রেনের নমুনা রাখা আছে, একটা পুরাতন হেলিকপ্টার রাখা আছে ।
আমাদের দেশের মালগাড়ির মত খয়েরি রঙের মালগাড়িতে করে যুদ্ধবন্দীদের কে গাদাগাদি করে তুলে দিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে দেওয়া হতো। এরপরে ট্রেনে করে তাদেরকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া হতো। কোন রকম খাবার বা পানি এ ছাড়াই এই গরমের দেশে বদ্ধ জায়গায় যুদ্ধবন্দীদের কে কখনো কখনো ৩৬ ঘণ্টার বেশি সময়ও থাকতে হতো। ফলশ্রুতিতে পরিবহনের সময়েই বন্দীদের মারা যাওয়ার ঘটনা খুব স্বাভাবিক ছিল। যেসব জায়গায় ট্রেন-ট্রাক ছিলনা ঐ সমস্ত জায়গায় মার্চ করিয়েও সৈন্যদেরকে পাঠানো হয়।
পিয়েরে বুল বন্দি ছিল হ্যানয়েের প্রিজন ক্যাম্পে। অন্যান্য বন্ধুদের কাছে কাঞ্চনাবুরী ব্রিজের কথা শুনে নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে কল্পনা মিশিয়ে বইটি দি ব্রিজ অন দা রিভার কোয়াই বইটি লিখেছিল। এই পথে মোট ৬৬৮ টা ব্রিজ তৈরি করা হয়েছিল যার মধ্যে মাত্র ৮টা ছিল স্টিল এবং কংক্রিটের তৈরি, এগুলো এখনো টিকে আছে।
কাঞ্চনবুরিতে প্রিজন ক্যাম্প ছিল তামারকান নামের একটা গ্রামে । কিন্তু গুগল ম্যাপে তামারকান গ্রাম খুঁজে পেলাম না, দেখাচ্ছে তামারকান গ্রাম বার্মাতে (বার্মা এখান থেকে ৭০ কিলোমিটার)। আশেপাশের দর্শনীয় জায়গার মধ্যে মাটির নিচের একটা লাইম স্টোনের গুহাতে রাখা বুদ্ধ মূর্তী ও মন্দির আছে, যুদ্ধে নিহত সৈনিকদের দুটা কবরস্থান আছে, কমনওয়েলথ স্থাপিত। একটা জলপ্রপাত আছে, তবে একটু দূরে, আমার ফেরার তাড়া আছে বলে জলপ্রপাত দেখা হবে না।
এই লাইনের শেষ স্টেশন, নাম টাকের কাছেই বিখ্যাত হেলফায়ার পাস। এখানে যুদ্ধবন্দিদের দিয়ে পাহাড় কেটে রাস্তা বানানো হয়েছিল। বন্দিদের মধ্যে শুধু প্রচন্ড শারীরিক নির্যাতনের কারনেই ৬৯ জন মারা যায়। যুদ্ধ বন্দিদের দিয়ে এভাবে ফিজিক্যাল লেবারের কাজ করানো জেনেভা কনভেনশন অনুসারে নিষিদ্ধ থাকলেও যুদ্ধবন্দিদের নিরাপদ হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি বা এরকম কিছু বলে জাপান ব্রিটিশদের সাথে চুক্তি করেছিল। স্থানীয় (মালয়ী)দের মূলত ভালো চাকরীর মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে পটিয়ে পরে লেবারের কাজে ব্যবহার করে। তবে স্থানীয়রা গরীব, সিভিলিয়ান, এজন্য মিউজিয়াম বা অন্য কোথাও তাদের কোন উল্লেখ নেই
মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে খোঁজ নিলাম, কোন পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নেই। যাদের পয়সা আছে তারা গাড়ি ভাড়া করছে। কেউ হাত নাড়ছে মনে হলো। তাকিয়ে দেখলাম গাড়ি চালিয়ে এলা তার বাবা-মা নিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি এক মিনিট হেঁটে স্টেশন চত্ত্বরে ফিরে আসলাম, এখানে একটা খাম্বার মধ্যে টাউন কর্পোরেশন ছবি এবং মোবাইল নম্বরসহ বৈধ অনুমোদিত মোটরসাইকেল ড্রাইভারদের তালিকা টাঙিয়ে দিয়েছে। তবে এই মুহূর্তে ওখানে দাঁড়িয়ে আছে মাত্র একজন ড্রাইভার। ওর সঙ্গে দরাদরি করে নিলাম, লাইমস্টোন গুহা এবং কাঞ্চনাবুরি গোরস্থান যাওয়া এবং ফিরে আসার ভাড়া বাবদ ৩০০ বাথ দিতে হবে, কোন রোড টোল লাগার কথা না, তবে লাগলে তা মটরসাইকেল চালক দেবে।
ড্রাইভার প্রথমে নিয়ে গেল 'খাও পান' লাইমস্টোন গুহাতে। স্থানীয় দর্শনার্থীদের জন্য কোন প্রবেশ ফি লাগেনা, টুরিস্টদের জন্য ৩০ বাথ দিয়ে টিকিট কাটতে হয়। গুহাতে ঢুকতে একট ভ্যাপসা গন্ধ পেলাম, বাংলাদেশের পুরাতন মন্দির গুলোতে যেরকম পাওয়া যায়। এখানে বুদ্ধের একটা শায়িত মূর্তি আছে। বিশেষ কিছু দেখার নেই। গুহার বাহিরে একটা দৃষ্টি নন্দন মন্দির আছে।
বের হয়ে দেখি মোটরসাইকেল ওয়ালা নেই। এক মিনিট খুঁজতে দেখি পাশে অন্য মূর্তির সামনে নমঃ করছে। আগেই বলেছি এদের ধর্মীয় অনুভূতত খুব গভীর, ধর্ম হৃদয়ে ধারণ করার জন্য এদের টুপি পাঞ্জাবি গায়ে দিতে হয় না।
গুগল ম্যাপ অনুসারে এখান থেকে মাত্র কয়েকশো মিটারের মধ্যে একটা প্যাগোডা আছে এবং এ বুদ্ধমূর্তি সহ একটা ভিউ পয়েন্ট আছে যেটাকে মুসিস ভিউ পয়েন্ট বলা হয়। কিন্তু আমার হাতে সময় নেই। এখান থেকে রওনা হলাম কাঞ্চনাবুরির কবরস্থানের পথে। রাস্তায় যেতে পড়ল আরেকটা কবরস্থান, চুংকাই ওয়ার সিমেট্রি।
ড্রাইভারকে বলায় সে বলল এটার মধ্যে দেখার কিছু নেই । তারপরেও অনুরোধ করায় থামল। আমি ২-৩ মিনিটের মধ্যে কয়েকটা ছবি তুলে বের হয়ে পড়লাম। অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন একটা কবরস্থান, টুরিস্ট দেখিনি, কোন মানুষও দেখিনি। যদিও সারা বছর বৃষ্টি হয়, তবুও স্প্রিংকলার দিয়ে ঠিকমতো পানি ছিটানো হচ্ছে। গোটা জায়গায় সবুজের সমারোহ।
এখানে মোট ১৬৯০ টা কবর আছে, যার মধ্যে ১৪৭৩ জন ব্রিটিশ সৈন্যের। এদের প্রত্যেকের বিবরণ কমনওয়েলথ ওয়ার সিমেট্রির ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়। গোটা কবরস্থান মোট বারোটা প্লটে ভাগ করা, প্রত্যেক প্লটে কয়েকটা করে রো, A-Z লেটার দিয়ে রো গুলো দাগাঙ্কিত করা। প্রত্যেক রো এ অনেক গুলো কবর, প্রতি কবরে একটা নম্বর দেয়া। প্লট নাম্বার, রো নাম্বার এবং কবর নাম্বার দিয়ে প্রত্যেক কবরকে চিহ্নিত করা যায়।
( https://www.cwgc.org/ ওয়েব সাইট থেকে কপি করা। কবরের পাশের ফলকে প্লট নাম্বার থাকে না, শুধু রো নম্বর আর ঐ রোতে এটা কত নম্বর কবর তা লেখা থাকে।)
এখান থেকে রওনা হয়ে গেলাম কাঞ্চনাবুরি কবরস্থানে দিকে। এটি বিশাল কবরস্থান । এখানে প্রায় সাত হাজার সৈনিকের কবর আছে। সংখ্যা নিয়ে উইকিপিডিয়া আর কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভসের ওয়েব সাইটে দেয়া তথ্যে সামান্য কিছু অমিল আছে। যতটুকু বুঝতে পেরেছি এখানে থাকা প্রায় দেড়শটা নাম বিহীন কবরই এই পার্থক্যের কারন। ৭০০০ কবরের বেশির ভাগই ব্রিটিশ, ডাচ এবং অস্ট্রেলিয়ান সৈন্যের। যুদ্ধে নিহত ১১ জন মুসলিম সৈন্যের কবর অন্য জায়গায় মুসলিম গোরস্থানে দাফন করা হয়েছে। আমেরিকানরা তাদের সৈনিকদের মৃতদেহ আমেরিকাতে ফিরিয়ে নিয়েছে। কয়েকটা কবর ফলক দেখে বুঝলাম ইহুদিদেরও এই কবরস্থানেই দাফন করা হয়েছে। এই কবরস্থের ঠিক সাথেই একটা চাইনিজ কবরস্থান আছে। কবরস্থান প্রাঙ্গনে কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিটির একটা রেস্ট হাউজও আছে দেখলাম।
(2A মানে হলো A বা প্রথম রো এর দুই নম্বর কবর। প্লট নাম্বার এই ফলকে লেখা থাকে না। cwgc ওয়েব সাইটে মৃতের নাম বা অন্য আইডেন্টিফিকেশন দিয়ে সব তথ্য পাওয়া সম্ভব।)
এখানকার কবরেও চুংকাইয়ের মতো নাম্বারিঙ সিস্টেম। সবচেয়ে বড় রোটা আমি গুনে দেখেছি, ওখানে এক সারিতে ৭৮টা কবর আছে।
এই কবরস্থানে অনেক দর্শনার্থী দেখতে পেলাম। অনেক এসেছে টুরিস্ট হিসাবে , দুই-একজনকে দেখে মনে হলো তাদের পূর্বপুরুষদের কবর ভিজিট করতে এসেছে।
কবরস্থানের পাশে একটি মিউজিয়াম। এন্ট্রি ফি ২০০ বাথ, সাথে চা বা কফির একটি কুপন ফ্রি। আমার কাছে এটি একটি অসাধারন মিউজিয়াম মনে হয়েছে। ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই সিনেমাটি যুদ্ধের নির্মমতা সেভাবে তুলে ধরতে পারে নি। এখানে বিভিন্ন ভাবে যুদ্ধের ভয়াবহ নির্মমতার চিহ্ন তুলে ধরা হয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের চেয়ে এই জাদুঘরটি আমার কাছে বেশী গোছানো মনে হয়েছে।
-গোক্ডেন স্পাইক-- দুইদিকে থেকে আসা রেলপথ যেখাে মিলেছে সেখানে রেলপথ উদ্বোধনের সময় এই গোল্ডেন স্পাইক গেঁথে সেলিব্রেট করা হয়।
এই মিউজিয়ামের তথ্য অনুসারে, কোয়াই ব্রিজ স্টেশনের এখানে যে রেলপথ স্থাপন করা হয়েছে তাতে প্রতিটি স্লিপারের পিছনে একজন প্রাণ হারিয়েছে। এই রেলপথে এমনও সেকশন আছে , যেখানে কাজ শুরু করেছিল ১০০০ জন, কাজ শেষ করার পরে দেখা গেল মাত্র ১০০ জন বেঁচে আছে। যুদ্ধ শেষের পরে ক্যাম্পে বন্দি ছিল এমন কিছু সৈন্যের ছবি এখানে আছে। এগুলো এতো ভয়াবহ যে দেখে ইথিওপিয়ার দুর্ভিক্ষ পীড়িত লোকজনের ছবি দেখছি বলে ভুল হতে পারে।
এই মিউজিয়ামটি ভালো করে দেখার জন্য ন্যূনতম এক ঘন্টা সময় হাতে রাখা উচিত। আমার ট্রেন ধরার তাড়া আছে। আমি তাড়াহুড়োর মধ্যে ৪৫ মিনিটে শেষ করলাম। ফ্রি চায়ের কুপনের ব্যাপারটা ভন্ডামি। লোকে ক্যান্টিনে শুধু চা খেতে যাবে এমন তো আর না, চায়ের সাথে আরো কিছু কিনবে এটাই এদের ব্যবসা। তবে আমি শুধু চা নিলাম, সেলস গার্ল আমার কাছে কিছু বিক্রি করতে ব্যর্থ হয়ে পাশের জনের কাছে চলে গেলো । আমি এক গ্লাস গরম পানির মধ্যে টি ব্যাগ চুবাতে চুবাতে ক্যান্টিনে কি আছে দেখতে লাগলাম। ২০০ বাথ শোধ করার উপায় খুঁজে না পেয়ে অবশেষে ওয়াশরুম ব্যবহার করে চলে আসলাম, বাইরে ওয়াশরুম ব্যবহারের জন্য ১০ বাথ লাগে, এটাতো বাঁচলো।
নিচে এসে দেখি মোটরসাইকেল ড্রাইভারের উদ্ভ্রান্ত দশা, আমি কোথায় চলে গেলাম বুঝে উঠতে পারছে না। অবাঙালি চেহারা যেরকম আমরা সহজে আলাদা করতে পারিনা, এদের মনে হয় সেরকম অমঙ্গলয়েড চেহারা আলাদা করতে না পারার সমস্যা আছে। পৌনে দুইটার দিকে আমাকে ব্যাটা স্টেশনে নামিয়ে দিল।
কোয়াই ব্রিজ তৈরি করার সময় নদীশাসনের জন্য মূল ব্রিজের দু'পাশে দুটো কাঠের ব্রিজ তৈরি করা হয়েছিল যার ধ্বংসাবশেষ এখনো থাকার কথা। মোটর সাইকেল ওয়ালাকে বলতে সে বলে দিল যে ওখানে নিয়ে যেতে পারবে না, মটর সাইকেল নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। তবে জায়গাটা ব্রিজের ওপারে, একটু এগুলেই। ব্রিজের এপাশটাতে এসে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করেও এরকম কোন জায়গা না পেয়ে বেশ খানিকটা ভেতরের দিকে এগুলাম।
আশেপাশে মানুষজন-গাড়িঘোড়া কিছুই নেই। আরেকটু এগুতে একটা বাড়ি চোখে পড়ল, বাড়ির আঙিনায় একজন বয়স্ক মহিলা এবং একজন মাঝবয়সী মহিলা কলাগাছ কাটছেন। আমি গুগল ট্রান্সলেটর বের করে জিজ্ঞেস করতে একজন পরিষ্কার বোধগম্য ইংরেজিতে বুঝিয়ে দিলেন ভাঙ্গা ব্রিজের অবস্থান নদীর ধারে জঙ্গলের আছে। ক্যাম্প বার এলাকাটা পার হলে ছোট একটা মাঠ। এর পর বড় একটা জায়গা জুড়ে জঙ্গল। আমার হেলথ ইন্সুরেন্স করা নেই, জঙ্গলে ঢুকে সাপের কামড় খেলে নিজের খরচে চিকিৎসা করাতে হবে। নদীর ধারে অজু করে নিয়ে মাঠে জোহরের নামাজ পড়ে ফেরার ট্রেন ধরার জন্য স্টেশনের দিকে রওনা দিলাম।
স্টেশনে এসে জিজ্ঞাসা করলাম দাদা আড়াইটার গাড়ি কটায় আসবে। টিকেট মাস্টারবাবু গম্ভীর মুখে বললেন আড়াইটায় কোনো গাড়ি নেই২:৪০ এর গাড়ি কুড়ি মিনিট লেট আছে। হাতে আধাঘন্টা সময়। নারকেল দুধের আর স্টিকি রাইস ওয়ালাকে গিয়ে ধরলাম। মা, আর একটা মালা, মিনতি করি মা দুটো ভাত বাড়িয়ে দিস। কি বুঝলো কে জানে, ঝাঁপি খুলে ভেতর থেকে ভাতের ট্রে টা বের করে আনল। মনটা খারাপ হয়ে গেল। যা ভাত আছে তা আমার এক বেলার খাওয়ার চেয়ে কম। বেটিকে আবার নারকেল দুধ বেচতে হবে। তাই চা চামচের এক চামচ এর জায়গায় দু চামচ ভাত নিয়ে নারকেল দুধের আইসক্রিম দিয়ে খেতে থাকলাম।
ঠিক এই সময় দেখলাম এলাদের পরিবার ফিরে আসছে। ওরা প্রায় পুরোটা সময় বড় গোরস্থান আর এর পাশের মিউজিয়ামে কাটিয়েছে। এলার বাবার দাদা বিশ্বযুদ্ধে মারা গিয়েছিল, এখানে কবর। ফেরার পথে কয়েকটা ছোট জায়গায় থেমে ছিল ওরা, মিউজিয়াম যাবার পথে দুপুরের খাবার সেরে নিয়েছে।
ওরা এখানে আগেও এসেছে। বেশির ভাগ স্পট চেনা, তবে লাইমস্টোনের গুহা না। রবার্টের ক্যামেরাটা অনেক দামি। এলার হাতে একটা কম দামি মটোরোলা (আমার ফোনের চেয়ে দামি)। আমার তোলা গুহা আর বৌদ্ধ মন্দিরের ছবি দেখাতে দেখাতে ট্রেন চলে আসলো। আমি লাফ দিয়ে একটা অপেক্ষাকৃত ফাঁকা কামরায় উঠে ট্রাটের ট্রেনের সিডিউল চেক করতে লাগলাম।
ব্যাংকক থেকে ট্রাটের ট্রেন সন্ধা ৬-৩০ এ। থন বুরি স্টেশন থেকে হোটেল হয়েও হুয়া লামফং স্টেশনে যেয়ে ট্রাটের ট্রেন ধরতে আমার ২৫ মিনিটের মত সময় লাগবে। ট্রেন যদি বাকি পথ সময় মতো চলে, তবে কুড়ি মিনিট লেটের জন্য সমস্যা হবে না। এমনকি যদি আরো ৫-৭ মিনিট দেরি হয় তবেও সমস্যা হওয়ার কথা না।
ট্রাটের ট্রেন টিকেট ঢাকা থাকতেই করে নিয়েছিলাম। থাই রেলের ওয়েবসাইটের একটা ইংলিশ ভার্সন আছে, ক্রেডিট কার্ড দিয়ে টিকিট কাটা সহজ। তবে অনলাইন টিকেট স্টেশনে কাউন্টারে জমা দিয়ে প্রপার টিকেট নিয়ে তবেই ট্রাভেল করতে হবে। বিকেল সোয়া চারটায় যখন ফোনের জিপিএসে দেখলাম নাখন পাথম আরো প্রায় এক ঘন্টা দূরে, বুঝলাম আজকে আর ট্রাটের ট্রেন ধরা সম্ভব হবে না। টিকেট ন্যূনতম দুই ঘণ্টা আগে ক্যানসেল করতে হয়। অনলাইনে টিকিট ক্যান্সেল করলাম কিন্তু। রিফান্ড পাব মাত্র ফিফটি পার্সেন্ট, সার্ভিস চার্জ ফেরৎ নেই, ৫২০ বাথ ভাড়ার মধ্যে ২৬০ বাথ গচ্চা , সাথে ৩০ বাথ সার্ভিস চার্জও গেল।
ট্রেন যথেষ্ট ফাঁকা ছিল। ট্রেনে আসর -মাগরিব সেরে নিতে পারলাম। সোয়া ছটা নাগাদ ব্যাংকক এসে পৌছালাম। ব্যাংকক ঢোকার একটু আগে থেকেই লক্ষ্য করলাম স্টেশনের দু'ধারে অনেক বস্তি। অনেকটাই বাংলাদেশের বস্তির মত। ৩০০ বাথের শোক সামলাতে সিদ্ধান্ত নিলাম স্টেশন থেকে হোটেল হেঁটে যাবো, মাত্র চার কিলোমিটারের মতো রাস্তা। কপাল গুগুল দেখাচ্ছে হাটার কোন রাস্তা নেই । আমাকে ফেরিতে করে নদীর ওপারে যেতে হবে। গুগুল কে ইমেইল করলাম মামা সড়কপথে যেরকম হাঁটার রাস্তা দেখাও নদীপথে সে রকম সাঁতার কাটার অপশন রাখলেও তো পারো। গুগুল জবাব দিল কেডা রে, কিরপিন নাকি?
বাধ্য হয়ে গ্রাব ডাটাবেসে ক্রেডিট কার্ড অ্যাড করে গ্রাব ডেকে হোটেলে ফিরলাম--৬০ বাথ লাগলো, ক্যাশ দিতে হলো না, কার্ড থেকে কেটে নিলো। আমার রুম বুকিং ছিল একদিনের; কিন্তু এটা ডাল সিজন। রুম ফাঁকা থাকার কথা। রিসিপশনিস্ট কে বলতেই বললো রুম ফাঁকা আছে। খাতা বের করে বলল ১৭০ বাথ দাও। আমি জানি booking.com এদের কাছ থেকে চার পারসেন্ট কমিশন নেয়। কাজেই আমি সাত বাথ ডিসকাউন্ট চাইলে কোনো কথা না বলে মেয়েটা কাউন্টারের পাশ থেকে লেবেঞ্চুস এর বৈয়াম বের করে আমার হাতে একটা ধরিয়ে দিল। আমি বৈয়ম থেকে আরো দুটো বের করে পকেটের ঢুকিয়ে ১৭০ বাথ বের করে দিলাম। এর ইনগ্রেডিয়েন্ট কী জানা নেই, খেতে পারবো না, কিন্তু কখন কি কাজে লেগে যায় কে জানে।
রাত এগারোটার দিকে এরা হোটেলে ঢোকার দরজা লাগিয়ে দেয়। চাবির জন্য সিকিউরিটি ডিপোজিট দিতে হবে ২০০ বাথ, চাবি না থাকলে সকালে দরজা খোলা পর্যন্ত বাহিরে থাকতে হবে। আমি সিকিউরিটি ডিপোজিটের ঝামেলায় না যেয়ে রিসিপশনিস্টের ফোন নম্বর নিয়ে রাখলাম, আটকা পড়লে ফোন দেব।
রুমে ব্যাগ রেখে চান ফান সেরে বেরিয়ে পড়লাম। এই হোটেলের ঠিক নিচে একটা সেভেন-ইলেভেন আছে। এ সময়টায় দোকান মোটামুটি ফাঁকা। ক্যাশ কাউন্টারে দাড়ানো মেয়েটাকে জিজ্ঞাসা করলাম চামড়ার কালো রং সাদা করার জন্য কি ক্রিম আছে। মেয়েটা বলল ব্লিচ ট্রাই করেছি কিনা । এবার গুগল ট্রান্সলেটর দিয়ে বলার চেষ্টা করলাম আমার চামড়ার রং পরিষ্কার করতে চাই। মেয়েটা কি বুঝলো কে জানে, টয়লেট ক্লিনিং সেকশনটা দেখিয়ে দিল। বাধ্য হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম তুমি কি ক্রিম মাখো। মেয়েটা এবার লজ্জা পেয়ে কাউন্টার থেকে বেরিয়ে আমাকে স্কিন ক্রিম সেকশনে নিয়ে গেল। ক্রিমের নাম স্নেল হোয়াইট। ছোট্ট এক কৌটা। ভিতরে কোয়েল পাখির ডিমের পরিমান (ফিফটি এমএল) ক্রিম। দাম তেরোশো বাথ।
দাম দেখে, ক্রিম মাখার আগেই আমার চেহারা ফ্যাকাশে সাদা হয়ে গেছে। মেয়েটাকে বললাম এর বদলে সাদা ফেস পেইন্ট মুখে লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবো, সস্তা পড়বে। মেয়েটা বলল ডোনাল্ড ট্রাম্প মাখে, দাম হবে না কেন । যাহোক আমার অবস্থা দেখে সে কম দামের একটা ক্রিম বেছে দিল-- হোয়াইট রোজ ১৪০ বাথ।
মুখে ক্রিম ঘষতে ঘষতে দোকান থেকে বেরিয়ে খাওসান রোডে খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম। মনকে বললাম - ট্রেন ভাড়ায় ধরা খাইছো, এবার সংযমী হও। ৫০ বাথে একটা ডিম পরোটা এবং এরপরে ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে স্টিকি রাইস এবং আম খেয়ে নিলাম। গতকাল নিয়েছিল ৬০ বাথ, আজ চাইলো ৭৫। বললো আজকের বক্স বড় ছিল। খাবার খাবার আগে দাম কনফার্ম করে নিতে হবে এখন থেকে। রাতে খিদা লাগলে জরুরি বিপদ মোকাবেলায় এখানকার সেভেন ইলেভেন থেকে ৩০ বাথ দিয়ে দুটো পাউরুটি রুটি কিনে রেখে দিলাম, সাথে ১৫ বাথের পানি।
হোটেলে ফিরে আমার পরবর্তি গন্তব্য দেখতে বসলাম। আমার যাবার কথা ট্রাং, সেখান থেকে কোহ হামুই হয়ে ফেরিতে করে ট্রাট। ট্রাঙে আমার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল পেনিনসুলার বোটানিকাল গার্ডেন। এখানে অনেক উপরে মাটি থেকে অনেক উপরে একটা ওয়াক ওয়ে আছে। কি মিস করেছি তার নমুনা ছবি দিয়ে দিলাম।
পেনিনসুলার বোটানিকাল গার্ডেনের মাটির ওপরের ওয়াকওয়ে
কোহ সামুই
(কোহ সামুই আর মাটির উপরের ওয়াকওয়ের ছবি চোরাই মাল)
কোহ সামুই বাদ। সাথে লোনলি প্ল্যানেট থাইল্যান্ড ছিল। দেখে নিয়ে ঠিক করলাম, কাল যাচ্ছি ট্রাট।
পরের পর্বঃ কিরপিনের থাইল্যান্ড ভ্রমন (পঞ্চম পর্ব)
**ছবি বড় করার টিপসের জন্য কাজি ফাতেমা ছবিকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ওনার সাহায্যেই ছবিগুলো একটু বড় করতে পেরেছি।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:৫১