২০১২ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার পদের লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। শিল্পকলার একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আমাকে বলেছিল, ‘ভাই, টাকা না দিলে চাকরি হবে না। ৮ লাখ দিলে নিশ্চিত চাকরি হবে।’
আমি ৮ লাখ টাকা দিইনি। ভাইভায় সব প্রশ্নের উত্তরই দিয়েছি। আরণ্যকের মতো প্রথম সারির নাট্যদলে রাঢ়াঙ, সংক্রান্তি, কবর, এবং বিদ্যাসাগর নাটকে অভিনয় করেছি। ভাইভার কিছুদিন আগেই দল থেকে আমার লেখা নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে- ‘পুতুলকথন।’ আবৃত্তি সংগঠনে কাজ করেছি। লেখিলেখি তো ছিলই। না, আমার চাকরি হয়নি।
কালচারাল অফিসার পদে নিয়োগ হয় ২০১৩ সালে, শিল্পকলার মহাপরিচালকের নাটকের দলের একাধিক নাট্যকর্মীর চাকরি হয়। একজনের নাম এখনও বলতে পারি- চাকলাদার মোস্তফা আল মাসউদ, শিল্পকলার ওয়েবসাইটে গেলেই দেখতে পাবেন। ২০১৩ সালের শিল্পকলার সব নিয়োগ বিতর্কিত। হ্যাঁ, ২০১৩ সালের শিল্পকলার প্রায় সব নিয়োগ অবৈধ। প্রতিটি পদের জন্য ৮-১০ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা একটু খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন যে শিল্পকলার মহামহিম কাদেরকে নিয়োগ দিয়েছিলেন, তারা কতটা যোগ্য কালচারাল অফিসার পদের জন্য।
একটা ঘটনা বলি- একবার জাতীয় নাট্য উৎসবের আর্থিক বিষয় দেখাশোনার দায়িত্ব পড়ে আমাদের আরণ্যকের এক বড় ভাইয়ের। নাট্য উৎসবের পরে ছোটখাটো কোনো একটা অনুষ্ঠান হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে খরচ হয়েছিল পঁচিশ হাজার টাকা। মহাপরিচালক বড়ভাইকে বলেন সেটা বাড়িয়ে তিন লাখ করার জন্য। বড় ভাই পড়লেন মহা ফাঁপড়ে! পঁচিশ হাজার থেকে বাড়িয়ে না হয় পঞ্চাশ হাজার করা যায়, না হয় আরেকটু বাড়িয়ে পঁচাত্তর করা যায়! তাই বলে তিন লাখ! বড়ভাই ভালো অভিনেতা, কিন্তু এই ধরনের ক্রিয়েটিভিটি তো তার নেই। বড়ভাই মহাপরিচালকের পিছনে ঘোরেন আর বলেন- ‘ভাই কেমনে কী করবো?’
শেষে একদিন মহাপরিচালক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে কাগজ-কলম নিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে তিনলাখ ব্যয় দেখিয়ে দিলেন! কী সাংঘাতিক ক্রিয়েটিভ মহাপরিচালক আমরা পেয়েছি!
এই মহাপরিচালক এহেন অপকর্ম নেই যা করেছেন, তার বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ হয়েছে। আর্থিক দুর্নীতির কারণে তার নাটকের দলও ভেঙে যায়। বাংলা ট্রিবিউন ধারাবাহিকভাবে তার দুর্নীতির খবর প্রকাশ করেছে। সেই খবরের সূত্র ধরে আমাদের টেলিভিশন প্রোগ্রামে আলোচনাও হয়েছে। এই প্রোগ্রামে অংশ নেবার জন্য আমি তখনকার সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির একজন সদস্যকে ফোন করেছিলাম। তিনি সব শুনে আমাকে বলেছিলেন, ‘আমারে মাফ করো ভাই, এই বিষয়ে আমার কথা বলা উচিত হবে না। উনি আমাদের ছাত্রলীগের বড় ভাই। বোঝো তো ব্যাপারটা।’
কী দারুণ, না? ছাত্রলীগ করলেই দুর্নীতি করে পার পাওয়া যায়!
আমি ঢাকার মঞ্চের বেশ কয়েকজন নাট্যব্যক্তিত্বকে ফোন করেছিলাম মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে কথা বলার জন্য, নানা অজুহাত দেখিয়ে তারা কথা বলতে রাজি হননি। শিল্পী, কবি-লেখকদের মৌনতার জমিনেই বেড়ে ওঠে দুবৃত্ত!
শেষে স্বয়ং মহাপরিচালক আমাদের প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন। আলোচনার জন্য আরও যুক্ত করেছিলাম আমাদের আরণ্যকের একসময়ের কর্মী দীপক সুমনদাকে। সুমনদা আমাদের দল থেকে বের হয়ে পরে তীরন্দাজ নামে একটি নাটকের দল গড়েন। তীরন্দাজের নাটকের আগে বাহাসের আয়োজন করেছিলেন মিলনায়তনে। বাহাসে বিষয়বস্তু সরকারের বিরুদ্ধে যায় দেখে সেই বাহাস করতে দেননি মহাপরিচালক। মহাপরিচালকের বক্তব্য ছিল- মিলনায়তন শুধু নাটক মঞ্চস্থ করার জায়গা, বাহাস বা আলোচনার জায়গা নয়।
ডাঁহা মিথ্যা কথা। আমরা প্রতি বছর মে দিবসে রাঢ়াঙ নাটকের আগে এক্সপেরিমেন্টাল হলে আলোচনার আয়োজন করেছি। বাহাসের ঘটনার পর থেকে মহাপরিচালক দীর্ঘদিন যাবৎ তীরন্দাজকে শিল্পকলায় নাটক করতে দেন না, শিল্পকলাকে তিনি বাপের জমিদারি বানিয়েছেন।
যাইহোক, টেলিভিশন প্রোগ্রামের আলোচনা একটু এগোতে না এগোতেই মহাপরিচালক সুমনদার বিরুদ্ধে মিথ্যার আশ্রয় নেন। সুমনদা নাকি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বাজে কথা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে পোস্টার সেঁটেছেন। ব্যাপারটা খারাপের দিকে যাচ্ছে এবং সুমনদা অহেতুক বিতের্কের মধ্যে পড়তে পারেন ভেবে আমরা আলোচনায় দ্রুত ইতি টানি।
আমি নিজে সাক্ষী বাহাসের ঘটনায় সুমনদা কখনোই প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কথা বলেননি, প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো পোস্টার সাঁটাননি। তাদের বক্তব্য ছিল সরকারের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে, ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে নয়। দুর্নীতিবাজ মহাপরিচালক নিজে বাঁচার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
মহাপরিচালকের দুর্নীতি নিয়ে এত সংবাদ প্রকাশের পরও তার কিছুই হয়নি, দীর্ঘ বছর ধরে তিনি পদে আছেন! তিনি এতটাই মহাশক্তিশালী মহামহিম মহাপরিচালক!