“পাঠকের একটি চিন্তাশীল মন্তব্যকে আমি নিজের লেখার চেয়েও বেশি মূল্যায়ন করি। পাঠকের মন্তব্য দেখে আমি বারবার ফিরে যাই নিজের লেখায়। নিজেকে অন্যের চোখে দেখে ভীষণভাবে প্রভাবিত হই। একেকটি মন্তব্য যেন নিজেকে দেখার একেকটি আয়না।” একজন বিখ্যাত অনলাইন একটিভিস্টের মন্তব্য। অন্য একজন অনলাইন লেখক অকপটে বললেন, “মন্তব্য ছাড়া নিজের লেখাকে নিজেই আমি চিনতে পারি না। কম বা হালকা মন্তব্যের লেখাগুলোকে যেন অন্যের সন্তানের মতো অচেনা লাগে!” আমি মনে করি, লেখা এবং মন্তব্য দু’টিই মৌলিক হতে পারে। যদি প্রশ্ন করা হয়, লেখা এবং মন্তব্যের মধ্যে কোনটিকে বেশি মনযোগ এবং গভীরভাবে দেখা হয়? আমি বলবো, মন্তব্য। একটি মৌলিক মন্তব্য দিয়ে সংশ্লিষ্ট পোস্টদাতাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারেন। একটি লেখা লেখকের আত্মা – মন্তব্য দেওয়া মানে হলো, তার আত্মায় প্রবেশ করা। সংখ্যা কম হলেও তাৎপর্য অনেক!
নিজের পোস্ট প্রকাশ করা এবং অন্যের পোস্টে মন্তব্য দেওয়া – মাত্র দু’টি কাজ করেই ইন্টারনেটের ভারচুয়াল সমাজে আমরা নিজেদের অস্তিত্বকে ধরে রেখেছি। ফেইসবুক হোক আর ব্লগ হোক, প্রক্রিয়াটি প্রায় একই রকম। ভালো পোস্ট দিতে না পারলে তাতে কারও সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয় না, কিন্তু ভালো মন্তব্য না্ করতে পারলে সম্পর্কে তো চির ধরেই, ভারচুয়াল ভাবমূর্তিও নষ্ট হয়। ভালো লেখক মানেই হলো ভালো পাঠক। কিন্তু ইন্টারনেটে ‘ভালো মন্তব্যকারী’ না হলে ভালো পাঠক হবার হবার কোন মূল্য নেই। ভালো পাঠক হওয়া সত্ত্বেও ‘ভালো মন্তব্য’ করা হয়ে ওঠে না এরকম অনেক লেখক, গল্পকার ও ছড়াকার আমি দেখেছি। পড়েছেন বুঝেছেন কিন্তু কীভাবে এর ‘প্রতিক্রিয়া’ প্রকাশ করবেন, সেটি নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যান। ‘ভালো হয়েছে’, ‘দারুণ’ অথবা শুধু ‘ধন্যবাদ’ দিয়েই শেষ করেন। তাতে পোস্টদাতা মনে করতে পারে, আপনি তার লেখাই পড়েন নি।
ভালো মন্তব্য করতে ‘না পারার পেছনে’ অনেক কারণ আছে, কিন্তু ‘পারার পেছনে’ কী কী উপায় আছে - সেটি নিয়েই এখানে কথা বলতে চাই।
(১) আপনার ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রতি গুরুত্ব দিন:
পোস্ট/লেখাটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে? কিছু পোস্ট আছে আপনাকে হাসাবে, কিছু বিষয় আপনাকে বিষাদাক্রান্ত করবে, কিছু লেখা আপনাকে নতুন তথ্য জানাবে, কিছু বিষয় আপনার হৃদয়কে স্পর্শ করবে, কিছু বিষয় আপনার প্রিয়জনের কথা মনে করিয়ে দেবে, অথবা আপনাকে স্মৃতিকাতর করে তুলবে, আপনাকে ঈশ্বরপ্রেমে মগ্ন করবে, আপনাকে কাঁদাবে অথবা আপনার দীর্ঘদিনের বিশ্বাসকে দেবে নাড়া। এরকম যদি হয়, তবে কেন তা হলো, মন্তব্যে প্রকাশ করুন।
(২) আপনার প্রতিক্রিয়া/মনোভাবটি বুঝে নিন:
প্রকাশিত পোস্টের বিষয়ে কি আপনি একমত? লেখক বা পোস্টদাতা একটি বিষয় তুলে ধরেছেন, যাতে আপনি একমত অথবা দ্বিমত। দ্বিমত হলে ‘অব্যক্তিকভাবে’ অর্থাৎ ব্যক্তিগত আক্রমণ না করে আপনার কারণটি তুলে ধরুন। একমত হলেও সেখানে কিছু অতিরিক্ত মতামত তুলে ধরতে পারেন।
(৩) লেখার আলোকে আপনার অভিজ্ঞতাকে পর্যবেক্ষণ করুন:
আপনারও কি একই অভিজ্ঞতা হয়েছে কখনও? যদি হয়ে থাকে, তবে যতটুকু বলা যায় সংক্ষেপে তুলে ধরতে পারেন। না হলেও ‘কেন হয় নি’ বলতে পারেন, যদি উপযুক্ত এবং প্রাসঙ্গিক মনে করেন।
(৪) আপনার ‘ধারণাগত উন্নয়নের’ বিষয়টি মূল্যায়ন করুন:
যে বিষটি আপনি সামনে পেলেন, তাতে কি নতুন কোন ধারণা হয়েছে? নতুন কিছু কি শিখতে পেরেছেন? নতুন কোন উপলব্ধি? তাহলে তা অকপটে তুলে ধরুন আপনার মন্তব্যে। তাতে আপনি ছোট হবেন না, আপনার মন্তব্যের গ্রহণযোগ্যতাই কেবল বৃদ্ধি পাবে।
(৫) আপনার সন্তুষ্টির বিষয়টি মূল্যায়ন করুন:
যে বিষটি আপনি দেখলেন বা পড়লেন, তাতে কি আপনি পুরোপুরি সন্তুষ্ট? আরও কি কিছু বাকি আছে জানার? কিছু বিষয়ে কোন অপূর্ণতা আছে কি? বন্ধুত্বপূর্ণ ভঙ্গিতে সে বিষয়টিতে লেখক/পোস্টদাতার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন। বিষয়টি স্পর্শকাতর হলে ব্যক্তিগত বার্তার মাধ্যমে তা জানাতে পারেন। তাহলে পোস্টদাতা আপনার প্রতি মনে মনে কৃতজ্ঞ থাকবেন।
(৬) পোস্টদাতাকে আরেকটু জানার চেষ্টা করুন:
হয়তো লেখার বিষয়টিতে পোস্টদাতার পূর্বের কোন লেখার সংযোগ আছে, অথবা লেখকের সামাজিক পরিচয়ের যোগসূত্র আছে। পোস্টদাতার প্রোফাইলে ক্লিক করে মুহূর্তের মধ্যে জেনে নিন তার ব্যাকগ্রাউন্ড: তিনি কে, কী বিষয়ে লেখেন, কী তার উদ্দেশ্য ইত্যাদি ইত্যাদি। পাঠক বা মন্তব্যকারী সম্পর্কে তার কী মনোভাব সেটি জানার জন্য পূর্বের কোন পোস্টে ক্লিক করতে পারেন। সবকিছুই আপনার মন্তব্যকে সমৃদ্ধ করবে, সৃজনশীল করবে। খেয়াল রাখবেন, লেখকের বর্তমান লেখার ওপর ভিত্তি করেই আপনাকে মন্তব্য করতে হবে।
(৭) বিষয়টি সম্পর্কে আরেকটু জানার চেষ্টা করুন:
কবিতা হলে ভালোমতো পড়ে নিন, দুঃখের কবিতায় উচ্ছ্বাসপূর্ণ মন্তব্য দেবেন না! অথবা কবিতা পড়ে বলবেন না, গল্পটি ‘দারুণ হয়েছে!’ শোকবার্তায় ‘আনন্দের’ ইমোটিকোন দেবেন না! একবার ভুল হলে, আপনার ভারচুয়াল ইমেজ স্থায়িভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। বিষয় সম্পর্কে জানতে প্রয়োজনে আরও খোঁজ নিন। ইন্টারনেটে চাইলে পাওয়া যায় না এমন কোন তথ্য প্রায় নেই। বাংলায় সার্চ দিলেও আপনি অনেক তথ্য পেয়ে যাবেন।
(৮) মন্তব্যের কাঠামো নির্ধারণ করুন:
মন্তব্যের ঘরে শুধুই আপনার মন্তব্য দেবেন, নাকি পোস্টদাতার লেখা থেকে উদ্ধৃত করবেন? শুধুই মন্তব্য দিলে, সুস্পষ্টভাবে লিখুন আপনার প্রতিক্রিয়া। একাধিক বিষয়ে মন্তব্য দিতে একাধিক অনুচ্ছেদ ব্যবহার করুন। উদ্ধৃতি দিতে চাইলে, খেয়াল করবেন: লেখকের দুর্বল বিষয়টি যেন ওঠে না আসে! লেখক যে বিষয়টিতে আলোকপাত করতে চেয়েছেন, ঠিক সেটি খুঁজে বের করতে চেষ্টা করুন।
(৯) তুলনামূলক মূল্যায়ন করুন:
অন্য কারও লেখার সাথে কোন বিষয় সামঞ্জস্য/বিরোধপূর্ণ হলে তা গঠনমূলকভাবে তুলে ধরতে পারেন। ‘অন্য কেউ’ বলতে বর্তমান বা অতীতের, অনলাইন বা অফলাইনের যে কেউ হতে পারেন। লেখকেরও অন্য কোন লেখা/পোস্টের সাথে বর্তমান বিষয়টির মূল্যায়ন হতে পারে। তুলনামূলক মূল্যায়ন করতে যেয়ে কাউকে যেন ‘ব্যক্তিগতভাবে অবমূল্যায়ন’ না করা হয় খেয়াল রাখতে হবে। অনেকে কৌশলগত কারণে ‘তুলনা’ পর্যন্ত গিয়ে থেমে যান, ‘মূল্যায়ন’ করতে চান না। আলোচনা করুন বিস্তারিতভাবে, কিন্তু সমালোচনা করুন সাবধানে! মূল্যায়ন একটি স্পর্শকাতর বিষয়, উপযুক্ত তথ্য-উপাত্ত এবং যুক্তি প্রদর্শন না করতে পারলে বিষয়টিতে না আগানোই হবে উত্তম।
(১০) ভারচুয়াল সততা রক্ষা করুন:
অনলাইনে এটি সহজ, কারণ এখানে স্বার্থের দ্বন্দ্ব কম। বাস্তব জীবনে নিজের আবেগ-উচ্ছ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ করা সাধারণত কঠিন, কিন্তু আঙ্গুলকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ! নিজের ইচ্ছার বাইরে কাউকে খুশি করার চাপে থাকবেন না। সপ্তাহে ৫০০ লেখা পড়ে ৫০০টি ‘জেনুইন’ মন্তব্য দেওয়া প্রায় অবাস্তব, অসম্ভব এবং অগ্রহণযোগ্য। হয় আপনি বিদ্যাসাগরের জিন বহন করছেন, না হয় ভারচুয়াল প্রতারণা করছেন! দায়িত্বশীল মন্তব্য করে ভারচুয়াল ব্যক্তিত্ব তুলে ধরা, আর ‘সেরা মন্তব্যকারী’ হওয়া এক বিষয় নয়। আপনি কোনটি হতে চান, বেছে নিন। ভালো লাগলে পড়ুন, ইচ্ছে হলে মন্তব্য দিন। চাপে থাকারও প্রয়োজন নেই। মন্তব্য করার ক্ষেত্রে সততা রক্ষা করুন এবং বস্তুনিষ্ঠভাবে লেখার মূল্যায়ন করুন, লেখককে যেন লক্ষবস্তু না করেন।
শেষ কথা:
মন্তব্যে স্বকীয়তা/নিজস্বতা রাখা কেবলই চেষ্টা আর ইচ্ছার ব্যাপার। যদি কিছু না বলতে পারেন, তবে অন্তত প্রচলিত শব্দাবলীকে এড়িয়ে নতুন শব্দ ব্যবহার করুন। তারপরও কিছু বলতে না পারলে দয়া করে মন্তব্য দেবেন না। অনেকেই মনে করেন, শুধু নিজের পোস্ট তৈরি করার সময়ই মনোযোগী হতে হয়, সৃজনশীল হতে হয়। আমি তাতে শতভাগ দ্বিমত পোষণ করছি, কারণ তাতে ভারচুয়াল ব্যক্তিত্বের দ্বিমুখী অবস্থানটি পুরোপুরি অস্বীকার করা হয়। পোস্ট দেওয়া এবং মন্তব্য দেওয়া – দু’টি ভূমিকাই সমান গুরুত্বের। দু’টিতেই সমানভাবে দায়িত্বশীল হতে হয়। লেখা এবং প্রতিক্রিয়া উভয়ের সাথে আপনার নিজের নামটি জড়িয়ে আছে। পোস্ট এবং মন্তব্য দু’টিই আপনার, কোনটির মালিকানা অস্বীকার করার কায়দা নেই।
[[[ পাবলিক ব্লগে লিখতে গিয়ে কিছু উপলব্ধি আসলো - সেটাই শেয়ার করলাম। সহব্লগাররা এখানে নির্দ্বিধায় আরও কিছু বিষয় যোগ করতে পারেন । আলোচনা-সমালোচনার দ্বারও উন্মুক্ত থাকলো। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, আধুনিক ব্লগারদের সামর্থ্য আর সম্ভাবনা যেকোন সময়ের চেয়ে এখন বেশি। বিশ্বাস করি, ছাপার অক্ষরের চেয়ে ব্লগারের লেখার শক্তি অন্যরকমভাবে বেশি, কারণ এখন বইয়ের পাতার চেয়ে কম্পিউটারের স্ক্রিনে মানুষ বেশি দৃষ্টি রাখে। তাই, এবিষয়ে সামু’তে ধারাবাহিকভাবে লিখে যাওয়ার ইচ্ছা আছে।]]]
প্রাসঙ্গিক আরেকটি লেখা:
আধুনিক ব্লগারদের ১০টি প্রিয় ভুল ।
*ছবিটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।