somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্মৃতির পাতায় আটকে যাওয়া দিনগুলো

২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কন্যাদ্বয়কে রাতে ঘুম পাড়াতে পাশে শুয়ে হঠাৎ করেই নিজে চলে গেলাম একদম শৈশবের অনেক অনেক আগের সময়ে। শনি-মঙ্গলবার হাট বসতো তখন, এখনো বসে তবে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির দরুন হাটের অপেক্ষা করতে হয় না মানুষকে। সপ্তাহের বাজার বলতে এই দুদিন বাড়ির পাশ থেকে করা যেতো, এছাড়া অতি প্রয়োজন হলে দূরের হাটে বা বাজারে যেতে হতো। চিকন চিকন দূর্বাঘাসে মোড়া বর্গাকার একটুকরো মাঠে বসতো সেই হাট। অল্প কয়েকটা টিনের ছাউনী দেওয়া ঘর ছিল, ঘর বলতে চারপাশে বাঁশের খুটি উপরে এক চালা টিন। সেখানে তেল আর শুকনো সদাই নিয়ে বসতো। আমরা গ্রামে বেড়াতে গেলে আব্বা বেশিরভাগ সময় ঢাকায় থাকতেন চাকরীসূত্রে। আমাদের বাজার করে দিতেন নানা ভাই। কেরোসিন তেলের জন্যে নীল প্লাস্টিকের লাল মুখ ওয়ালা গ্যালন ছিল। খালি গ্যালন দড়িতে বেঁধে পায়ের সাথে ঢং ঢং করে বাড়ি মেরে মেরে চলতাম হাটের দিকে। দূর থেকে মৌমাছির মত গুন গুন আওয়াজ আসতো কাছে গেলে বোঝা যেতো তা হল হাটুরেদের শোরগোল।
সামনের দিকে সবজি, রাস্তার উপর দুধওয়ালা বসতো। মাঝে বসতো তেল, শুকনো সদাই নিয়ে। একদম শেষ মাথায় ছিল মাছের বড়বড় ডালি। আমার বড় কাকা হাটের একদম শুরুতে দৌড়ে এক ভাগা ছোট মাছ নিয়ে কাকী কিংবা মেয়েদের হাতে দিতেন। আমাদের এলাকায় বলে শকুন খোকরা; অসাধারন স্বাদ সেই মাছের চচ্চরি। বাড়ী থেকে যদি বলা হতো মাছ ভালো তবে প্রায় শেষ হাটে আবার কোন এক পদ নিয়ে আসতেন দৌড়ে। হাটের সাথেই বাড়ি হবার সুবিধা এই। কিন্তু মেঝো কাকা কোন কোন দিন দূরে কাজে গেলে ফিরতে সন্ধ্যা হতো সেদিন আর মাছ বাজার হতো না। কাকীর মাচার শাক সবজিই ছিল পরবর্তী হাটবারের আগ পর্যন্ত ভরসা। এ নিয়ে কোন অভিযোগ ছিল না কাকীর।
হাটে যেতাম সিঙারা আর নিমকীর লোভে। আলু স্রেফ হলুদ লবনে ভেজে তাই দিয়ে বানাতো তিন কোনা আকৃত্রির সিঙারা। ত্রিশ পেরিয়ে এই বয়সেও এখনো আমি খুঁজেফিরি সেই আটা দিয়ে বানানো নরম সিঙারা! একটু বড় হলে দেখলাম গ্রামে যাবার পথে লঞ্চে বিক্রি হতো, এরপর পদ্মাসেতু চালু হওয়ায় লঞ্চ নেই তবে সেই সিঙারাওয়ালারা বাসে ওঠে ঢাকা থেকে যাবার পথে সেতু পাড় হলে। জানি সেই স্বাদ পাবো না তাই ইচ্ছে হয় না সবসময় কেনার! নিউজ প্রিন্ট বইয়ের পাতায় মুড়ে পাটের সুতলি দিয়ে বেঁধে কালিজিরা ছিটানো কমলা রংয়ের চিকন চিকন সেই নিমকী হারিয়ে গেছে জীবন থেকে, রয়ে গেছে কেবল স্মৃতির পাতায়!

বৃষ্টির দিনে সেই হাটে দূর্বাঘাসের ভেতর জায়গায় জায়গায় পানি জমে যেতো, দল বেঁধে সেই ঘাসের ভেতর লাফালাফির দিন এই জীবনে আর একটাবার ফিরে পেতে ইচ্ছে করে। আমার জীবনে না আসুক কন্যাদের জীবনে আসুক, তাইতো বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দ ওদের তিন বছর পূর্ন হবার আগই পেয়েছে। এখন বৃষ্টি দেখলেই কন্যারা কলকলিয়ে ওঠে ভিজতে যাবার জন্যে।

সন্ধ্যে নামার আগে হারিকেনের কাঁচ পরিস্কার করার যে ব্যস্ততা ছিল তার জায়গায় এখন বিজলীবাতি আর চার্জার লাইট দখল করেছে কিন্তু ঐ কেরোসিনের গন্ধ যে বড্ড ভালো লাগতো আমার তা কারো সামনে স্বীকার করতে লজ্জা পেতাম! সন্ধ্যে নামতেই জোনাকির দল বের হতো ঝাঁকে ঝাঁকে। দুই শরিক পরের ঘরের সমবয়সী জাহাংগীর কথা দিয়েছিল আমাকে জোনাকী ধরে দিবে, হাতের মুঠোয় ধরলে আলো জ্বলে, সে এক বিস্ময়কর জিনিস! জাহাংগীরের খোঁজ করতে গেলে শুনি ঘুমিয়ে গেছে, মনটাই খারাপ হল প্রচণ্ড। ওদের শরিকদের বাড়ীতে গেলে অবাক বিস্ময়ে দেখতাম এত ছোট ছোট ঘরে পুরো পরিবারের জীবনযাপন। আমার সেই ছোট্ট মাথায় তখন না ঢুকলেও এখন বুঝি কী মানবেতর জীবন ছিল ওদের! মোটামুটি ১৫০ স্কয়ার ফিটের পাট খড়ির বেড়া আর ছনের ছাউনীর ঘরে কোন প্রকার আসবাব ছাড়াই দিব্যি তাদের ঘর ভর্তি ছেলে মেয়ে নিয়ে বসবাস ছিল। সেই ঘরের অর্ধেকে মাচা যেটাকে আমাদের এলাকায় বলে 'ওগৈর' পেতে মাটির কোলা, কলস, মটকা কাঁথা বালিশ থাকতো, বাকী অর্ধেকে রাতে পাটি বিছিয়ে বিছানা করতো! বেড়ার সাথে বা চাল থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া শিকায় ঝুলতো ভাত তরকারীর গামলা। মোটামুটি এই ছিল জীবন ওদের। জাহাংগীরের বাপ চাচা ৪ভাইয়ের একই রকম ঘর যেখানে দারিদ্রতার চরমসীমা বিরাজ করতো। সময়ের সাথে সাথে ভাগ্য বদলেছে কিছুটা এখন। হুট করে ছেলেটার কথা মনে পড়ল জোনাকী পোকার কথা ভেবে এছাড়া ওর সাথে তেমন কোন স্মৃতি ছিল না। এক যুগেরও বেশি সময় হয়ত ওকে দেখি না।

আমি চাইলেই এখন ছয় ঘর কিংবা নয় ঘরের কুতকুত খেলতে পারি না কিন্তু বাড়ির সামনের রাস্তায় তখন তা ছিল নিত্যদিনের অভ্যাস। পুরনো স্মৃতি, পুরনো দিন একটা সময়ের পর থেকে খুব টানে তাইতো বাসা খোঁজার সময় লাল সিমেন্টের চওড়া টানা বারান্দার এই বাসাটা দেখার পর পছন্দ হয়ে যায়। এই বাসার সবচাইতে পছন্দের জায়গা এর বারান্দা। শুনেছি আমার জন্ম সালে এই বাড়িটি করা। পুরনো এই বাসায় আমার ঘোর লেগে গেলেও কন্যাদের খুব একটা পছন্দ নয় তাইতো নিয়ম করে রোজ নানুর বাসায় যেতে হয়। একদিন ভেবেছি সারাদিনের জন্যে ওদের নানুর বাসায় দিয়ে আমি সারাদিন উত্তরের এই বারান্দায় বসে বাইরে দেখবো।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেসবুক বিপ্লবে সেভেন সিস্টার্স দখল—গুগল ম্যাপ আপডেট বাকি

লিখেছেন মহিউদ্দিন হায়দার, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৩০




কিছু তথাকথিত “বাংলাদেশি বিপ্লবী” নাকি ঘোষণা দিয়েছে—ভারতের সেভেন সিস্টার্স বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে! সহযোগী হিসেবে থাকবে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী আর পাকিস্তানি স্বপ্ন।শুনে মনে হয়—ট্যাংক আসবে ইনবক্সে। ড্রোন নামবে লাইভ কমেন্টে। আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গু এনালিস্ট কাম ইন্টারন্যাশনাল সাংবাদিক জুলকার নায়েরের মাস্টারক্লাস অবজারবেশন !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২৬

বাংলাদেশের দক্ষিণপন্থীদের দম আছে বলতে হয়! নির্বাচন ঠেকানোর প্রকল্পের গতি কিছুটা পিছিয়ে পড়তেই নতুন টার্গেট শনাক্ত করতে দেরি করেনি তারা। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ ঘিরে নতুন কর্মসূচি সাজাতে শুরু করেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিবাদ: দিল্লির ছায়া থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র

লিখেছেন কৃষ্ণচূড়া লাল রঙ, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৫:৫৭

একটা সত্য আজ স্পষ্ট করে বলা দরকার—
শেখ হাসিনার আর কোনো ক্ষমতা নেই।
বাংলাদেশের মাটিতে সে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত।

কিন্তু বিপদ এখানেই শেষ হয়নি।

ক্ষমতা হারিয়ে শেখ হাসিনা এখন ভারতে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

Grameen Phone স্পষ্ট ভাবেই ভারত প্রেমী হয়ে উঠেছে

লিখেছেন অপলক , ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪৯



গত কয়েক মাসে GP বহু বাংলাদেশী অভিজ্ঞ কর্মীদের ছাটায় করেছে। GP র মেইন ব্রাঞ্চে প্রায় ১১৮০জন কর্মচারী আছেন যার ভেতরে ৭১৯ জন ভারতীয়। বলা যায়, GP এখন পুরোদস্তুর ভারতীয়।

কারনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×