হ্যাঁ ; তিনি রাস্তায় থাকেন।
এক ছেলে পোষ্টঅফিসের কেরানী। সেখানেই থাকতেন। ছেলের সামান্য আয়। নিজেরই সংসার চলে না। তার উপর পিতার ভার বহন করা। বৃদ্ধ বাবা আশা করেছিলো হয়তোবা ছেলে একসময় তাকে কোনো বৃদ্ধাশ্রম-এ দিয়ে আসবে। অথবা আর কিছু না পারুক নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করে তাকে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসতে বলবে। কিন্তু চুরির অপবাদ মাথায় নিয়ে তাকে আসতে হবে তা ভাবতেও পারেননি। কিন্তু তাই হয়েছিলো।
বয়স হয়েছে ইদ্রিস সাহেবের। অবশ্য একজন রাস্তার শতচ্ছিন্ন বস্ত্র পরিহিত মানুষকে সাহেব বলা যাবে কিনা এ ব্যাপারে অনেকের অনেক আপত্তি থাকবে। তারপরও তার অতীত বংশগৌরব তাকে এখনো পদপিষ্ট হতে দেয়নি সমাজের ধন্যাট্য মানুষগুলোর।
সবকিছু তিনি মনে করতে পারছেননা। যতদূর মনে পড়ে – তিনি সেদিন ছেলের বাড়ির বারান্দায় ঘুমাচ্ছিলেন। শীতের রাত। হঠাত তার ছেলের বউ এসে তার ঘুম ভাঙ্গালো। এরপর আরো কি কি ঘটেছিলো মনে পড়ছে না – শুধু মনে পড়ছে বৌমার সোনার বালা হারিয়েছিল – ঘরে আর কেউ না থাকায় সন্দেহটা ওই বৃদ্ধ-বাপটার উপরই পড়ে। তাকে অনেক গালমন্দ শুনতে হয়েছিলো সেদিন। তবে সবচেয়ে যেটা তাকে বেশী আঘাত করে; তা হলো নিজের ছেলে যখন বউটার কথা শুনে তাকে চোর বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলে সে সময়টা; তখন মনে হচ্ছিলো যদি তাকে তার ছেলে লাথি দিয়েও বলত- বাবা তুমি চোর নও; তাও ভালো ছিলো।
সবই ছিলো তার। মেঘনার পাড়ে বিঘা-বিঘা জমি আর বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেত। ঠিক কত বিঘা জমি তিনি পৈত্রিক সূত্রে পেয়েছিলেন তা ঠিক মনে করতে পারছেন না। ঘরে ছিলো প্রেমময়ী স্ত্রী। দু’জনের ভালোবাসার সংসারে ছিলো পাঁচটি সন্তান। চার ছেলে আর ছোট একটা মেয়ে। আর্থিক সমৃদ্ধি যেমন ছিলো- তেমনি ছিলো মনের অনাবিল প্রশান্তি।
এরপরে কি হয়েছিলো তা ভুলবার নয়। মাঝে মাঝে ভুলে যান; তবে দুই হাতের কবজি অবধি পোড়া দাগ তাকে মনে করিয়ে দেয় বারেবার- তিনি এই দু’হাত দিয়ে নয় মাস স্টেনগান চালিয়েছেন।
হ্যাঁ- মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি হারিয়েছেন তার স্ত্রীকে; বড় তিন ছেলের সারিবদ্ধ লাশ তিনি নিজের হাতে কবর দেন মেঘনার পাড়ে। যে মাটিতে নিজ হাতে ফসলের বীজ পুতেছেন- সেখানে সেদিন তাকে চাপা দিতে হয়েছিল আদরের সন্তানদের ছিন্নভিন্ন লাশ। হানাদারদের কবল থেকে রক্ষা পায় তার তিন বছরের ছোট ছেলেটা আর দুই মাসের মেয়েটা। সন্তানদের নিয়ে তিনি চলে যান বর্ডার পার হয়ে শরনার্থী শিবিরে। দেশে ফিরে এসে শুরু করেন যুদ্ধ। না- দেশপ্রেম কি জিনিস তিনি যানতেন না। তার মধ্যে ছিলো কেবল স্বজন হারানোর প্রতিশোধ নেবার স্পৃহা।
স্বাধীনতার পর তিনি চলে যান শরনার্থী শিবিরে পুত্র কন্যার খোঁজে। পাবেননা ভেবেই গিয়েছিলেন; কিন্তু স্রষ্টার অপার করুণায় তিনি ফিরে পেলেন তার জীবিত দু’সন্তানকে। ছেলেকে নিয়ে দেশে ফিরে এলেন। সদ্যস্বাধীন দেশে কন্যার নিরাপত্তা দিতে পারবেন না বলে তাকে রেখে এলেন পশ্চিম-বাংলার এক ভারতীয় পরিবারের কাছে। ইচ্ছা ছিলো দেশে এসে যদি সব ঠিক করতে পারেন তবে নিয়ে আসবেন তার কন্যাকে।
দেশে আসার পর গুছিয়ে নিচ্ছিলেন আবার নিজের জীবনটাকে। ছেলেটাকে আবার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। আবার তার ক্ষেতে বুনলেন ফসলের বীজ। কিন্তু আরেকটি ঘটনা আবার তার জীবনকে এলোমেলো করে দিলো। পঁচাত্তরের আগষ্ট।
সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে কাপুরুষগুলো খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসলো। যুদ্ধে পরাজিত রাজাকারেরা আবার এক হয়ে এলাকাগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে থাকলো। ইদ্রিস সাহেবকেও সেদিন স্বাধীন বাংলার বুক থেকে নিজের ভিটেমাটি ছাড়তে হয়েছিলো। সেটা দখল করে নিয়েছিলো ঐ এলাকার আল-বদরের চীফ।
এখন অবশ্য ইদ্রিস সাহেবের এখন এসব নিয়ে তেমন কোনো আক্ষেপ নেই। যেখানে নিজের সন্তান পিতাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়- সেখানে দেশের সাথে বেঈমানী তার কাছে আর কিএমন বিবেচ্য বিষয়?
বয়স তার এখন সত্তর’র কোঠায়। বসে থাকেন ছয়নম্বর জা’মে মসজিদের কিনারে। প্রতি শুক্রবারে জুম’আ শেষে নামাযীদের দেয়া অর্থ দিয়েই সপ্তাহ চালাতে হয় এখন তার। জীবনের স্বাদ-আহ্লাদ এখন আর নেই। বেঁচে থাকার তেমন কোনো ইচ্ছাও নেই। যেটা আছে তা হলো জীবনের জন্য সংগ্রাম করে অবশিষ্ট সময়গুলো কাটানো।
অতীতের কথা মাঝে মাঝে তার মনের পর্দাগুলো নাড়িয়ে দেয়। মেয়েটাকে তিনি আর দেশে আনতে পারেননি। স্বাধীনতার তিন বছর পর যখন আনতে গিয়েছিলেন মেয়ে তাকে দেখে চিনতে পারেনি; আসা তো দূরের কথা কোলেই উঠেনি। অশ্রুস্বজল চোখ নিয়েই সেদিন তিনি খালি হাতে ফিরে এসেছিলেন দেশে। অবশ্য আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। কেননা এর কয়েক বছর পরে তাকে ভিটেছাড়া হতে হয়েছিলো।
আর তেমন কিছু তার মনে পড়েনা আজকাল। রাস্তায় ঘুমান। রাস্তার কুকুর গুলোর সাথে ভালো সখ্য হয়ে গেছে তার। তার সামান্য খাবারের কিছু অংশ তারা বরাদ্দ পায়। তার ছেলেও সপ্তাহান্তে এই মসজিদে নামায পড়তে আসে। তিনি মাঝে মাঝে দেখেন। কখনো দেখেননা। দেখলেও আর দশটা লোকের মতই তার দিকে থালা বাড়িয়ে দেন। আর দশটা লোকের মত তাকেও বলেন-“ বা’জান- দুইডা পয়সা দিবেন?”
তবে হয়ত সেই “বা’জান” ডাকটা অন্য দশজনের চেয়ে আলাদা হয়।
ইদ্রিস সাহেব ভিটেবাড়ি হারিয়ে তার এই একমাত্র সন্তানকে নিয়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন এই শহরে। সর্বস্ব দিয়ে যিনি বড় করেছেন তার এই সন্তানকে। বড় হয়েছে তার সন্তান; মানুষ হয়নি।
ইদ্রিস সাহেবের মেঘনার পাড়ে ফসলের মাঠ ছিলো; যেই মাঠের কাকতাড়ুয়া গুলো এখন কুর্নিশ করে সেই রাজাকারটিকে। স্বাধীন বাংলার ক্ষেতের ফসলগুলো এখনো ভোগ করে স্বাধীনতাবিরোধী লোকগুলো। তাদের মাথাগুলো নিশ্চিন্তে ঠাঁয় পায় স্বাধীন দেশের আলীসান বাড়ীগুলোর পরিষ্কার বিছানায়।
আর ইদ্রিস সাহেব রাস্তায় পড়ে থাকেন। তার স্বাধীন দেশের ধুলো পড়া রাস্তায়।
আলোচিত ব্লগ
আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন
ফেসবুক বিপ্লবে সেভেন সিস্টার্স দখল—গুগল ম্যাপ আপডেট বাকি

কিছু তথাকথিত “বাংলাদেশি বিপ্লবী” নাকি ঘোষণা দিয়েছে—ভারতের সেভেন সিস্টার্স বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে! সহযোগী হিসেবে থাকবে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী আর পাকিস্তানি স্বপ্ন।শুনে মনে হয়—ট্যাংক আসবে ইনবক্সে। ড্রোন নামবে লাইভ কমেন্টে। আর... ...বাকিটুকু পড়ুন
বাঙ্গু এনালিস্ট কাম ইন্টারন্যাশনাল সাংবাদিক জুলকার নায়েরের মাস্টারক্লাস অবজারবেশন !

ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিবাদ: দিল্লির ছায়া থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র
একটা সত্য আজ স্পষ্ট করে বলা দরকার—
শেখ হাসিনার আর কোনো ক্ষমতা নেই।
বাংলাদেশের মাটিতে সে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত।
কিন্তু বিপদ এখানেই শেষ হয়নি।
ক্ষমতা হারিয়ে শেখ হাসিনা এখন ভারতে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন
Grameen Phone স্পষ্ট ভাবেই ভারত প্রেমী হয়ে উঠেছে

গত কয়েক মাসে GP বহু বাংলাদেশী অভিজ্ঞ কর্মীদের ছাটায় করেছে। GP র মেইন ব্রাঞ্চে প্রায় ১১৮০জন কর্মচারী আছেন যার ভেতরে ৭১৯ জন ভারতীয়। বলা যায়, GP এখন পুরোদস্তুর ভারতীয়।
কারনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।