আমাদের দেশের ‘ক্ষুদ্র ঋণ’ লগ্নিকারীরা সেবার আব্রুধারী ঘাতকদের তালিকার সংখ্যা পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পেলেও জনসংখ্যার সমানুপাতে দরিদ্রতা হ্রাস পাচ্ছে না। এমন গল্প শুনতে পাবো , গত ৪ঠা আগষ্ট বুধবার দুপুরে রাজধানীর একটি হোটেলে সিটি ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘সিটি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পুরস্কার ২০০৯’ বিতরণী অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী বাহাদুর এই কথা বলেন। আমাদের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছেন যে ,‘‘ ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ ও গ্রহিতার সংখ্যা বাড়লেও দারিদ্র্য বিমোচন কাঙ্খিত গতি অর্জন করতে পারছে না।’’ এ কথা জানতে পারলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ( ০৪ আগষ্ট ২০১০, ঢাকা ) অনলাইন পোর্টাল থেকে।
অর্থমন্ত্রীর কথা আনুযায়ী , ‘‘দেশে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে। ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণকারীরা দাবি করছে , ঋণ গ্রহিতার সংখ্যা তিন কোটিতে পৌঁছেছে। কিমত্ত তারপর ও দরিদ্র্য বেড়েই চলছে। ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণের পরিমান বাড়লেও দারিদ্র্য বিমোচন কাঙ্খিত গতি পাচ্ছে না। পরিসংখ্যান ও বাস্তবতার ব্যবধানই বলে দিচ্ছে কোথাও কোনো সমস্যা রয়ে গেছে।’’ পাশাপাশি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন ,‘‘ ক্ষুদ্র ঋণের প্রতিষ্ঠানিক ও আইনি জটিলতা দূর করতে হবে। ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহিতাদের ঝুঁকি ও বাড়তি খরচ অনেক বেশি হওয়ায় তারা অনেক কাজ ঠিকমত করতে পারেনা। এ ক্ষেত্রে প্রণোদনা চালু করতে সরকারের প্রতি আহবান জানান তিনি।’’
অথচ গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্রাক ক্ষুদ্র ঋণের দুই মহীরুহ সংস্থা ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩৮লাখ ৬০ হাজার ব্যক্তিকে ৮ হাজার ২৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেখা যায়, মাত্র এক দশকের ব্যবধানে গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্রাক শুধু এই দুই প্রতিষ্ঠানই ১কোটি ৫৯ লাখ ৩০ হাজার ৯৫২ মহিলাকে ৮০ হাজার ১২ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো তার নিয়ন্ত্রীত বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে অনুসন্ধান করতে , প্রখ্যাত এই দুই দারিদ্র্য বিমোচনকারীর ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সময়ে লগ্নিকৃত মূলধনের সুদের হার কত ছিল ?
আমাদের বাজারে ক্ষুদ্র ঋণের সচলতা মূলত আর্থ-সামাজিক এবং বিনিয়োগ পরিস্থিতির পূর্বে অনুসন্ধান প্রয়োজন। যাহা সমাজের দারিদ্র্য সীমার নিচের জনসংখ্যাকে নিজ পায়ে দাড়াবার জন্য চালু করা হয়েছে বলে প্রচার পায় পাশ্চাত্ব্যের মহাজনদের স্বার্থে। কারণ ১৯৮৩-৮৪ সালে বিশ্বের ২য় খয়রাতি দেশ হিসাবে আমাদের অবস্থান ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্টে প্রকাশিত হয়। যাহা একটি সম্পদশালী দেশের দূর্দশার চালচিত্রের বয়ান। অথচ আধুনিক সমাজের পূঁজির জীয়নকাঠী বজায় রাখতে বাজারে সবল ভোক্তা সৃষ্টি করার পায়তারা দৃষ্টিগোচর হয়। বর্তমান গোলকনামা (গ্লোবালাইজেশণ) কে উন্নত ও অনুন্নত বাজারের সংযোগ সৃষ্টির পূর্ব প্রস্ত্ততি হিসাবে দেখলে কোনো অপরাধ হবেনা ।
এই বিখ্যাত ‘ক্ষুদ্র ঋণ’-এর গতি প্রকৃতি নিয়ে জাতিসংঘের নয়টা সংগঠন বাংলাদেশের আর্থসামাজিক কাঠামোর অনুসন্ধানী পর্যাবেক্ষণ চালায় গত শতাব্দীর শেষ দশকের শুরুতে। তাদের ‘ফর্ক ইন্দা পাথ’ নামক প্রকাশনার মুখবন্ধে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। মহাজনী কারবারীদের স্বর্গভূমি , মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ ভ্রমন এবং স্থানীয় সকল মহাজনী কারবারীদের সমাজসেবকের পোষাকে পিটচাপড়িয়ে দেওয়ার কাহিনী ফলাও করে প্রচারের কথা দেশবাসী অবগত আছেন। তাইতো দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশের জনসংখ্যার প্রায় পাঁচ ভাগের একভাগ মহাজনি কারবারীদের খাতক তালিকায় বন্দী হয়ে গেছে সেবা নামক পাশ্চাত্ব্যের গুজোবের ফঁন্দিতে।
পাঠকের বিশেষ করে রাজনীতিবিদদের সুবিধার জন্য পূঁজি’র গতি প্রকৃতি (চরিত্র) সম্পর্কে আমাদের পরিচিত সিমেটিক পন্ডিত মাকর্স’র পূঁজি গ্রন্থের একটা ফুটনোটের বর্ণনা এখানে উল্লেখ করছি।
‘‘(কোয়াটারলী রিভিউ) পত্রিকার আলোচক বলেছেন যে পূঁজি বিক্ষোভ-আলোড়ণ ও বিবাদ বিসংবাদ এড়িয়ে চলে,পূঁজি হল গিয়ে ভীরু। কথাটা খুবই সত্য,তবে কিনা এটা নেহাত অর্ধসত্য ছাড়া কিছু নয়। পূঁজি মুনাফার অভাব কিংবা নিতান্ত সামান্য মুনাফাকে পরিহার করে চলে,যেমন কিনা আগে বলা হতো যে প্রকৃতি শূণ্যতাকে এড়িয়ে চলে ঘৃণাসহকারে। তবে যথেষ্ট পরিমান মুনাফা জুটলে তখন কিন্তু দারুণ সাহসী হয়ে ওঠে। দশ শতাংশ মুনাফা নিশ্চিত হলে পূঁজি সর্বত্রই খাটতে রাজি ; ২০ শতাংশ মুনাফা পূঁজিকে আগ্রহী করে তুলবে নিশ্চিতই ; ৫০ শতাংশ মুনাফা নিশ্চিতভাবে উদ্ব্যত করে তুলবে পূঁজিকে ; ১০০ শতাংশ মুনাফা পূঁজিকে অস্থির করে তুলবে সকল প্রকার মানবিক আইন কানুন পায়ে মড়িয়ে যেতে ; আর ৩০০ শতাংশ মুনাফা সন্ধান পেলেতো কথাই নেই ; তখন এমন কোন আপরাধ নেই যা করতে সে পিছপা হবে , এমন কোন ঝুঁকি নেই যা সে নিতে ভয় পাবে , এমন কি এর ফলে যদি পূঁজির মালিককে ফাঁসিরকাঠে ঝুলতে হয় তো তাও স্বীকার। যদি বিক্ষোভ-আলোড়ণ ও বিবাদ-বিসংবাদের ফলে মুনাফা জোটে,তাহলে পূঁজি ওই উভয় ব্যাপারকেই খোলাখুলি উস্কানি দেবে। চোরাচালান ও দাস ব্যবসায় এখানে যা যা বলা হয়েছে তার সবকিছুকেই পরিপূর্ণভাবে প্রমাণ করেছে’’।
এই হলো পূঁজি চরিত্রের প্রকৃত সংজ্ঞা। পাঠক বলেনতো আমাদের দেশের ভূমীদস্যুরা বা আদমব্যাপারী কেন আইনকে … ? কারণ তিনশত ভাগের উর্দ্ধে মুনাফার জন্যই এমনতরো ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটে থাকে।
আমাদের দেশের হেন কোনো হাট-বাজার , নগর বা বন্দর এবং বস্তি নাই যেখানে সমিতির নামে বা ‘দারিদ্র বিমোচনের’ নামে মহাজনী ঘাতকদের প্রবেশ ঘটে নাই। এমনতরো নিশ্চত মহাজনী মুনাফার ক্ষেত্রকে কেন আমাদের ‘অর্থ’ নামক জটিল বিষয়ের বিজ্ঞজনেরা ‘দারিদ্র্য বিমোচনের’ লালনক্ষেত্র ভাবলেন ? উনারা কি দরিদ্র বিমোচনের অগ্রজ হিসাবে বাংলাদেশের নাম লেখানোর কারণে পাশ্চাত্যের পিটচাপড়াণোর সুখে এখনো বিমোহিত হয়ে আছেন ! তাইতো সিমেটিক পন্ডিতের পূঁজির চরিত্র পাঠের জন্য উপরে উল্লেখ করলাম আমাদের মহামান্য পন্ডিত দ্বয়ের জ্ঞাতার্থে। কারণ , কয়েক বৎসর আগেও শতকরা ত্রিশ থেকে চল্লিশ ভাগ সুদের কারবারীকে ‘মহাজন’ না ভেবে ‘দারিদ্র্য বিমোচনকারী’ সেবক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়ে আসছে। এমনতরো বিচক্ষন প্রতারণা কেবল মাত্র আমাদের দেশে সম্ভব নেটিভ শিক্ষার বদৌলতে। তাও সম্ভব কথিত শিক্ষিত সমাজের অভাবি চরিত্রের শ্রেফ বিত্ত সংগ্রহের স্বার্থে।
দরিদ্র্য মানুষের কথা বলে শিক্ষিত লোকদের নিজ অভাব পূরণের কাহিনী আমাদের দেশে সেবার তকমা লাগানো প্রতিষ্ঠান গুলোতে অনুসন্ধান করলে বহু-বিচিত্র সংবাদ পাওয়া যায়। নিজেই এমন তরো অক্সফোর্ডীয় উইটের সংস্পর্শে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল একদা। বেচারা ষোল বছর বিলেত থাকায় এই ইংরেজ ভক্ত নেটিভ নিজ মাতৃভাষা বাংলা ভুলে গিয়েছিলেন প্রভুভক্তির নিষ্ঠা প্রমাণ করতে। উনার ডক্টরেটের বিষয়বস্ত্ত খুবই রেয়ার। পৃথিবীর বেশ কয়েকজন জগৎখ্যাত গুনি ব্যক্তিদের মধ্যে এই ব্যক্তিও একজন বলে ভাবতে খুব পুলকিত হন বেচারা। উনার হঠাৎ দেবরাজ্য থেকে আমাদের এই নরকে অবতরণের হেতু অন্যকিছু নয় শ্রেফ ‘দরিদ্র মানুষের কল্যাণ’ ব্রত বাস্তবায়ন করা। আমার মতো মূর্খ তো আছিই সাথে দাদা পার্টি(টিকি ধারী) বেকার দামড়া গুলোর সদগতি করারই যেন উনার উদ্দেশ্য। খাতায় নাম লিখায়ে দিলাম অক্সফোর্ডীয় গুরুর পান্ডার ভুমিকা পাওয়ার আশায়। উনিও দেশের কোনা-কাঞ্চিতে যত দাদা পার্টির ধাঁধাঁ সদস্যদের অনুসন্ধান করে লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে গোয়াল বোঝাই করতে থাকলেন। এই অবতারের মহান উদ্দেশ্য হলো দরিদ্র্য মানুষের কল্যাণ সাধন। আমরা মহাগুরুর ভজনা করতে যেয়ে আবিষ্কার করলাম গুরু অর্থনীতিতে অক্সফোর্ডিয় ডক্টরেট চোতাধারী হলেও ‘পূঁজি’ বোঝে না ! যে কারণে সংবিধানের জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র ইত্যাদিকে ভাল ভাল শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে বললেন। আমাদের ইবলিশিয় পর্যবেক্ষণে ভন্ড গুরু যে ফকু লেবাসধারী তা প্রকাশ পেলো। পরবর্তী সময় দেখা গেল এই মনসিক অভাবি ভন্ড দরিদ্র মানুষের কল্যাণ করতে না পারলেও নিজে কমপক্ষে দু’কোটি পাউন্ড স্টালিং-এর মালিকানার নগদ-সম্পত্তি গিলে বসে আছে।
দারিদ্র্য বিমোচন বলি বা সমাজের দরিদ্র্যসীমার নিচের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধির চিন্তা করি সবই করতে হবে রাষ্ট্রকে মুনাফা মুখি চিন্তাকে বাদ দিয়ে। অর্থাৎ শতকরা পাঁচ ভাগের উর্দ্ধে সুদের হার রাখা যাবে না সমাজের পশ্চাতপদ জনসংখ্যার ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য। অর্থমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী কোথাও কোন সমস্যা আছে ? অবশ্যই সমস্যা আছে, আর সেই সমস্যা হলো সুদের হার পাঁচ ভাগ হলেই সমাধানের সংবাদ পাওয়া যাবে। মাহমুদ সাহেবদের প্রস্তাবিত প্রণোদনার নামে সরকারের কাছে হাত পাতার প্রয়োজন হবে না। সুদ অবশ্যই সরল সুদ হতে হবে। আমাদের সরকার কোনো মহাজনী কোম্পানী নয় যে, তার মুনাফা মুখি প্রবণতাকে পৃষ্টোপোষকতা করতেই হবে। অবশ্যই মনে রাখতে হবে আমাদের দেশটা যেহেতু ‘পিপলস্ রিপাবলিক’, সুতরাং কোম্পানী বা ভিক্টোরিয়ান আমলের চিন্তা বর্জন করতে হবে। নচেৎ লালন শাহর বাণী স্বরণ করতে হবে প্রকৃতির আশ্রয়ে থেকে -
ভাবলি না মন কোথায় সে ধন
ভাজলি বেগুন পরের তেলে
গুণে পড়ে সারলি দফা
করলি রফা গোলেমালে।
করলি কত পড়াশুনা
কাজে কামে ঝঁলসে কাঁনা
কথায়তো চিড়ে ভেজে না
জল কিংবা দুধ না দিলে।
**আমার এই লেখাটি খুলনা জার্নাল এ প্রকাশিত হয়েছে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



