আমরা আগের পর্বগুলোতে মহাবিশ্বের বিভিন্ন জ্যোতিষ্ক নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। এসব জ্যোতিষ্ক কিন্তু আমরা দেখতে পাই। যেমন- নক্ষত্র, গ্রহ-উপগ্রহ, ধুমকেতু, গ্রহাণু, কোয়াসার, পালসার, নীহারিকা, নিউট্রন নক্ষত্র, গ্যালাক্সি ইত্যাদি। মহাবিশ্বের গ্যালাক্সির পরিমাণ প্রায় বিশ হাজার কোটি, আর নক্ষত্রের পরিমাণ কল্পনাতীত। স্বভাবতই এসব দৃশ্যমান পদার্থের পরিমাণ আমাদেরকে ভাবিয়ে তোলে, এত অসংখ্য পদার্থ মহাকাশে আছে তা কল্পনা করতেই আমরা নিজেদের মহাজাগতিক অসীমত্বে হারিয়ে ফেলি! কিন্তু তার চেয়েও চমকপ্রদ ব্যাপারটি কি জানেন? এই যে দৃশ্যমান সব পদার্থের কথা এতক্ষন আলোচনা করেছি, এগুলো মহাবিশ্বের মোট পদার্থের মাত্র ৫ শতাংশ! আর বাকি ৯৫ শতাংশ জিনিস আমরা দেখতেই পাই না!!!! অন্যভাবে বলা যায়, আমরা এই যে সহস্র কোটি নক্ষত্র দেখতে পাই, গ্রহ-উপগ্রহ, ধুমকেতু, বিশাল বিশাল গ্যালাক্সিগুলো দেখতে পাই, এসবই মহাবিশ্বের মোট পদার্থের মাত্র ৫ শতাংশ! তাহলে বাকি ৯৫ শতাংশ গেলো কই?
এই ৯৫ শতাংশের পুরোটা হচ্ছে ডার্ক ম্যাটার (কৃষ্ণ বস্তু) এবং ডার্ক এনার্জি (কৃষ্ণ শক্তি)। একটি গবেষণা অনুসারে আমাদের মহাবিশ্বের মোট ভর-শক্তির ৬৮.৩% হলো ডার্ক এনার্জি, ২৬.৮% হলো ডার্ক ম্যাটার, আর মাত্র ৪.৯% হলো সাধারণ বস্তু।
ছবিঃ মহাবিশ্বে বস্তু ও শক্তির পরিমাণগত তুলনা!
ডার্ক ম্যাটারঃ মহাবিশ্বে ডার্ক ম্যাটার হলো এমন এক ধরণের পদার্থ যেগুলো আমরা টেলিস্কোপের সাহায্য দেখতে পাই না। কারণ কি জানেন? এই পদার্থগুলো কোন দৃশ্যমান আলো (visible light) নির্গত করে না। কোন পদার্থ থেকে যখন আলো নির্গত হয়, তখনই আমরা সেগুলো দেখতে পাই। যেহেতু ডার্ক ম্যাটার থেকে টেলিস্কোপে সনাক্ত করার মত কোন আলোই আসে না, তাই পদার্থগুলো আমাদের কাছে অদৃশ্য।
এখন আপনাদের মাথায় নিশ্চই একটা প্রশ্ন ঘুরছে। যেই পদার্থগুলো আমরা দেখতেই পাই না, সেগুলোর অস্তিত্বের ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হচ্ছেন কিভাবে? বা বিজ্ঞানীরা কিভাবে বুঝতে পারছেন যে এই অদৃশ্য পদার্থগুলোর অস্তিত্ব আছে? আমরা এখন সেই প্রশ্নটির উত্তর জানব। বিষয়টি নিঃসন্দেহে মজার।
আমরা মহাবিশ্বে যেসব পদার্থ দেখতে পাই, সেগুলোর ভর কিন্তু গাণিতিক হিসেব-নিকেশ করে মেপে ফেলা সম্ভব। কোন বস্তুর ভর কিন্তু আমরা দু’ভাবে মাপতে পারি। একটা পদ্ধতি হচ্ছে- সেই বস্তুটি যে সব পদার্থ দিয়ে গঠিত সেগুলো হিসেব করে আমরা একটা ভর পেতে পারি। যেমন ধরুন- একটা নক্ষত্রের ভর মাপা যাবে সেই নক্ষত্রটির ভেতরে কি পরিমাণ বস্তু আছে, সেসব যোগ করে! ভর মাপার ক্ষেত্রে আরেকটা চমৎকার পদ্ধতি হচ্ছে- অন্যান্য বস্তুর ওপর সেই বস্তুটির প্রভাব বা মহাকর্ষ বল কেমন সেটি বের করে। সাধারণত অধিক ভরসম্পন্ন বস্তুর প্রভাব আশে-পাশের অন্য ভরসম্পন্ন বস্তুর ওপর খুব প্রবল হয়। আবার কম ভরসম্পন্ন বস্তুর প্রভাব আশে-পাশের অন্য জিনিসের ওপর হয় খুব কম। আপনার ভর যত বেশি হবে আপনার ক্ষমতাও তত বেশি হবে। এই দু’টি পদ্ধতি প্রায় সময়ই মোটামুটি কাজ করে। একটা নক্ষত্র যে পরিমাণ পদার্থ দিয়ে গঠিত হয়, তার উপরই নির্ভর করে যে সে আশেপাশের বস্তুগুলোর উপর কি পরিমাণ প্রভাব বিস্তার করবে। কিন্তু, কখনো কখনো সেটা হয় না।
মহাবিশ্বে এমন অসংখ্য বস্তু বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ করেছেন যে বস্তুগুলোর দৃশ্যমান পদার্থের পরিমাণ খুব কম, কিন্তু সেই বস্তুগুলো আশেপাশের অন্যান্য জিনিসের উপর প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করে আছে! মানে, সেই পদার্থগুলোর দৃশ্যমান গ্যাস, ধূলিকনা প্রভৃতি যোগ করে আমরা যে পরিমাণ ভর বের করতে পারছি; আশেপাশের অন্যান্য বস্তুর উপর তাদের প্রভাব হিসেব করলে ভর দাঁড়ায় আরো বেশি!
মহাশূন্যের এই নক্ষত্র বা গ্যালাক্সিদের বেলাতেও তাই। যেহেতু, এই বস্তুগুলোর দৃশ্যমান ভর অনেক কম, কিন্তু অন্যান্য বস্তুর উপর তাদের মহাকর্ষ বল অকল্পনীয়- তাহলে নিশ্চই এই বিপুল পরিমাণ ভর আমাদের কাছে অদৃশ্য! আর এই অদৃশ্য বস্তুর নাম দেয়া হয়েছে ডার্ক ম্যাটার! মহাবিশ্বের সব গ্যালাক্সির ভর মাপতে গিয়েই এরকম সমস্যায় পড়েছেন বিজ্ঞানীরা। দেখা যাচ্ছে, দৃশ্যমান নক্ষত্রদের পরিমাণ হিসেব করলে ভর দাঁড়ায় একরকম, আবার গ্যালাক্সিটির মহাকর্ষ বলের ক্ষমতা এবং অন্যান্য বস্তুর সঙ্গে তার ইন্টার-গ্র্যাভিটেশনাল ফোর্স হিসেবে করলে ভর দাঁড়ায় তার চেয়েও অনেক অনেক গুণ বেশি! গ্যালাক্সিদের গুচ্ছ বা অনেকগুলো গ্যালাক্সির সমাবেশের ক্ষেত্রেও সেটা সত্যি। সব মিলিয়ে বলা যায়, পুরো মহাবিশ্বেই অকল্পনীয় পরিমাণ ভর আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। তাই এগুলো হচ্ছে ডার্ক ম্যাটার।
ছবিঃ বিগ ব্যাং-এর পর মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ এবং ডার্ক এনার্জির প্রভাব
ডার্ক এনার্জিঃ আমাদের এই মহাবিশ্ব কিন্তু ধীরস্থির নয়। এটি খুব দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। মনে করুন- আমাদের এই মহাবিশ্বটি হচ্ছে একটা বেলুন। আপনি এই বেলুনটিতে ফুঁ দিচ্ছেন, আর এটি ক্রমাগত ছোট থেকে বড় হচ্ছে আর ফুলতে শুরু করেছে। আমাদের মহাবিশ্ব হচ্ছে অনেকটা এই বেলুনের মত। এটি খুব দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে, যা আমরা কল্পনাও করতে পারবো না। আপনি ফুঁ দিচ্ছেন বলেই বেলুনটি বাড়ছে। তেমনি আমাদের মহাবিশ্বেও এমন কোন একটি শক্তির উৎস আছে যা এটিকে খুব দ্রুত বাড়িয়ে তুলছে! এবং এই স্ফীতির হারও কিন্তু বেড়ে চলেছে। যে শক্তিটি মহাবিশ্বকে ক্রমবর্ধমান হারে প্রসারিত করার জন্য দায়ী, বিজ্ঞানীরা তার নামকরণ করেছেন কৃষ্ণশক্তি বা ডার্ক এনার্জি। তারমানে আমরা জানতে পারলাম, যে শক্তিটি মহাবিশ্বের স্ফীতি বা প্রসারণকে উত্তোরত্তর হারে বাড়িয়ে তুলেছে, তাই হলো কৃষ্ণশক্তি।
আজ থেকে প্রায় তেরশো কোটি বছর আগে এই মহাবিশ্ব যখন সৃষ্টি হয়েছিলো বিগ ব্যাং থেকে, তখন প্রচণ্ড গতিতে এটি প্রসারিত হতে শুরু করেছিলো। সেই প্রসারণের হার কিন্তু কমে এসেছিলো অনেক। কিন্তু প্রায় কয়েকশো কোটি বছর আগে মহাবিশ্বের এই সম্প্রসারণের হার বাড়তে শুরু করে! বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, এই স্ফীতির পুনঃআবির্ভাবের মূল কারণ হচ্ছে ডার্ক এনার্জি বা কৃষ্ণ শক্তি। কৃষ্ণ শক্তি এবং কৃষ্ণ বস্তুর প্রকৃতি নিয়ে এখনো গবেষনা চলছে।
আমার আরো লেখাঃ
আমাদের মহাবিশ্ব- তৃতীয় পর্বঃ যেভাবে সবকিছু শুরু হয়েছিলো!
আমাদের মহাবিশ্ব- দ্বিতীয় পর্বঃ মহাকাশের বিস্ময়কর সব জ্যোতিষ্কের গল্প!
আমাদের মহাবিশ্বঃ একটি মহাজাগতিক মহাসমুদ্রের গল্প
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০১৪ রাত ২:২০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




