কি অজুহাত দাঁড় করিয়ে সেদিন সকালে ডাক্তার ও চাবিওয়ালাকে বাড়ী থেকে বিদায় করা হলো, তা গ্রেগর এখনও জানতে পারে নি। তার কথাই তো বোঝেনা কেউ। অন্যদের কথা যে সে বোঝে, ভাবেনি কেউ, এমনকি বোনও ভাবতে পারে নি। সেকারণে প্রতিবারই যখন তার বোন এ ঘরে আসতো, গ্রেগরকে বোনের দীর্ঘশ্বাস ও কখনো সখনো হায় খোদা জাতীয় বিলাপ শুনেই সন্তুষ্ট থাকতে হতো। পুরো অভ্যস্ত হবে বোন, সে আশা করাই বৃথা। তা সত্বেও কিছুটা অভ্যস্ত হবার পর সে কিছুটা আন্তরিকও হলো সে। গ্রেগর পরিস্কার করে পুরোটা খাবার খেলে বলতো,'আজ দেখছি ভালই খেলো'! উল্টোটা হলে বলতো, 'আজ সবই তো রয়ে গেল'!
যেহেতু বাইরের জীবনের কোন খবরই পেতো না, সেহেতু মাঝে মাঝে পাশের ঘরে কান পাততো গ্রেগর। পাশের ঘরে কোন গলার শব্দ শুনলেই, সে ঘরের দরজায় ছুটে যেত । নিজেকে দরজার সাথে সেটিয়ে কথা শোনার চেষ্টা করতো। করে প্রথম দিকে তাকে নিয়ে কোন কথাই হতো না। কি করা যেতে পারে এ অবস্থায়, এ নিয়ে আলাপ আলোচনা চললো প্রথম দু্থ দিন। দু্থবেলা খাবারের মাঝামাঝি সময়েও একই বিষয়ে আলাপ চললো। কমপক্ষে পরিবারের দু্থজন সদস্য সবসময়েই বাড়ীতে থাকতো, কারণ একা কেউই থাকতে চাইতো না। পুরো বাড়ী খালি রাখার প্রশ্নই আসে না। বাড়ীর আয়া পুরো ঘটনা সম্পর্কে কতটা অবহিত, তা জানা যায়নি। তবে প্রথম দিনই সে মাটিতে হাঁটু গেড়ে মা কে অনুরোধ করলো তাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিতে। পনেরো মিনিট পর কাঁদতে কাঁদতে তাকে এতে তার কি বিরাট উপকার হলো, তা জানিয়ে বারবার ধন্যবাদ জানালো। কেউ কোন অনুরোধ করার আগেই সমস্ত ঘটনা গোপন রাখার কঠিন শপথ করে বিদায় নিলো।
মায়ের সাথে থেকে রান্নাবান্নার দায়িত্ব বর্তালো বোনের হাতে। তেমন কঠিন হলোনা, কারন খাওয়ার রুচি ছিলনা করোরই। প্রায়ই শোনা যেত, একজন আরেকজনকে আরেকটু খাবার অনুরোধ করছে। 'ধন্যবাদ, যথেষ্ট খেয়েছি', এধরণের উত্তর ছাড়া অন্য কোন উত্তর শোনা যেত না কখনোই। প্রায়শ:ই বোন বাবাকে জিজ্ঞেস করতো, তার একটা বিয়ার চাই কি না। আন্তরিকতা নিয়ে নিজেই এনে দিতে চাইতো। উত্তর না পেলে বাড়ীর কেয়ার টেকার কে পাঠানোর কথা বলতো, যাতে বাবাকে কোন অস্বস্তিতে পড়তে না হয় । একসময় বাবার পরিষ্কার অসম্মতার পর এ আলোচনার সমাপ্তি হতো তাতেই।
প্রথম ক্থদিনের মাঝেই বাবা তাদের তাদের আর্থিক অবস্থা ও সম্ভাবনা মাকে ও একই সাথে বোনকেও তুলে ধরলেন। সুযোগ পেলেই তিনি তার ছোট বাক্স নিয়ে টেবিলে বসতেন, যা তিনি তার পাঁচ বছর আগের ব্যাবসায়িক বিপর্যয় থেকে বাঁচাতে পেরেছিলেন। এতে ছিল কিছু রশিদপত্র ও প্রমাণাদি। সে বাক্সের জাটিল তালা খোলা, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বের করা ও আবার তালা বন্ধ করার আওয়াজ পাওয়া যেত। বাবার এই কর্মপ্রবাহ ছিল গ্রেগরের জন্যে তার বন্দি জীবনের প্রথম আনন্দের খোরাক। তার জানা ছিল, বাবা তার নিজের ব্যবসা থেকে কিছুই বাঁচাতে পারেন নি। অন্ততপক্ষে: বাবা তার এই ধারণার বিপক্ষে কখনোই কিছু বলেন নি। এটাও ঠিক যে সে নিজ থেকে জানতে চায়নি কিছু। গ্রেগরের একমাত্র চিন্তা ছিল তখন, বাবার ব্যাবসায়িক বিপর্যয়ে পুরো পরিবার যে নিদারুন হতাশায় ডুবে ছিল, তা যথাসম্ভব ভুলিয়ে দেওয়া। সেজন্যেই সে মনের ভেতরে কোন এক বিশেষ জ্বালায় চাকুরীতে যোগ দিয়েছিল। খুব তাড়াতাড়িই তাই সাধারণ শিক্ষানবীস থেকে এক যাযাবর দালাল হয়ে গেল। ভালো আয় করার সুযোগ ও দালালীর নগদ টাকাপয়সা হাতে আসতে থাকলো। খুব ভাল সময় ছিল তখন । পরবর্তী সময়ে কখনোই এতটা প্রাচুর্য ও জৌলুস ফিরে আসেনি। তারপরও গ্রেগর যতোটা আয় করতো, তার তার পুরো পরিবারের ভরণপোষনের জন্যে যথেষ্টই ছিল। একসময় তা, একদিকে যেমন গ্রেগরের, অন্যদিকে তেমনি তার পরিবারের জন্যেও অভ্যাসে পরিনত হল। অন্যরা যেমন আনন্দের সাথে নিত, তেমনি গ্রেগরও দিয়েই আনন্দ পেত। কিন্তু এর মাঝে আন্তরিকতার অভাব ছিল বেশ। মনের দিক থেকে বোনটি তার কাছাকাছি রইল। বোনের গান বাজনার প্রতি উৎসাহ বেশ। ভালো ভায়োলিন বাজাতে পারে। যদিও ভীষন ব্যয়বহুল, তারপরও পরিকল্পনা ছিল সামনের বছর ওকে সঙ্গীত কলেজে পাঠানোর। প্রতিবারই অল্প সময়ের জল্যে যখন শহরে থাকতো গ্রেগর, বোনের সাথে আলোচনায় সঙ্গীত কলেজের কথাই উঠতো বারবার। তখনও তা সপ্ন, যার বাস্তবায়ন চিন্তার বাইরে। বাবা মা এ অলোচনা একেবারেই শুনতে চাইতেন না। কিন্তু গ্রেগর এ নিয়ে ভেবে বড়দিনে এর বাস্তবায়নের কথা বাবা মা কে জানাতে মনে মনে তৈরী হচ্ছিল।
দরজায় লেপ্টে কান পেতে থাকার সময় তার এই বর্তমান অবস্থায় একেবারেই অদরকারী এসব চিন্তা ভাবনাই তার মাথায় খেলা করতো। মাঝে মাঝে স্বাভাবিক ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে শ্রবশক্তি কাজ করতো না, নিজের অজান্তেই মাথা খুটতো দরজায়। নিজেকে সামলে নিত সাথে সাথেই, কারন এ দুর্বল শব্দটিও সবার মনযোগ আকর্ষন করতো। চুপচাচ হয়ে যেত সবাই। কিছুক্ষন পর বাবার মুখে শোনা যেত,্থ না জানি আবার সে কি করছে্থ? কিছুটা বিরতির পর আবার শুরু হতো অসমাপ্ত আলোচনা।
অনেক কিছুই জানতে পারলো গ্রেগর। বাবা তার বক্তব্যের পূণরাবৃত্তি করতেন। এর একটি কারন, এসব বিষয় নিয়ে তিনি অনেক দিন যাবৎ না ভেবেই অভ্যস্ত। আরেকটি কারণ, মা সহজে সব বুঝে উঠতে পারতেন না। নানা ধরণের বিপর্যয়ের পরও পুরোনো সময়ের কিছু টাকাপয়সা জমা ছিল, যা সুদেআসলে কিছুটা ফেঁপে উঠেছে। তাছাড়া গ্রেগর সামন্যই নিজের জন্যে রেখে যে টাকাপয়সা মাসে মাসে বাড়ীতে দিত, তার পুরোটা খরচ না হয়ে জমে বেশ বড় একটা অঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। গ্রেগর দরজার আড়ালে বসে এই আশাতীত সাবাধানতা ও মিতব্যায়িতার কথা শুনে পরিতৃপ্ত হয়ে মাথা নাড়লো। আসলে এ টাকায় তার বসের কাছে বাবার যা দেনা, সবই শোধ করা যেত। তাতে এই যাযাবরের কাজটি ছাড়াও সহজ হতো তার জন্যে। তারপরও এখন বাবা যা করেছেন, তা নি:সন্দেহে অনেক জরুরী।
কিন্তু এই জমা টাকার সুদে পুরো পরিবারের খরচ চালানো অসম্ভব। হয়তো দু্থবছর সংসার চালানো যাবে, এর বেশী নয়। সাধারনত: এই টাকাটি খরচ না করে কোন বিপদ আপদের জন্যেই জমা থাকার কথা। তার অর্খ হচ্ছে এখন সংসারের খরচ কহন করার জন্যে কারো টাকা আয় করা দরকার। যদিও বাবা সুস্থ, তারপরও তার বয়েস হয়েছে। গত পাঁচ বছরে কোন কাজ করেন নি, তাই নিজের উপর বিরাট আস্থা থাকার কথাও নয়। গত পাঁচটি বছরই ছিল তার ব্যার্থ ও পরিশ্রান্ত জীবনের প্রথম ছুটি। এখন বেশ মোটা হয়েছেন ও চলাফেরায়ও জড়তা এসেছে। বৃদ্ধা মা কাজ করবেন? তিনি তো হাঁপানী রোগে আক্রান্ত। ঘরের ভেতর চলাফেলা করেই হাঁপাতে থাকেন। শ্বাঁসকষ্টের কারণে জানালা খুলে সোফায় পড়ে থাকেন। বোন আয় করবে টাকা? তার তো মাত্র সতেরো বছর বয়েস। এ পর্যন্ত জীবনে যা পেয়েছে, তা হচ্ছে, ভাল কাপড়চোপড় পড়া, বেশী বেলা করে ঘুমোনো, মাঝে মাঝে সাংসারিক অলোচনায় সাহায্য করা ও ভায়োলিন বাজানো। যখনই টাকা আয় সংক্রান্ত কোন কথাবার্তা হতো, পাশেই চামড়ায় মোড়া শীতল এক সোফায় গা এলিয়ে দিত। এসব আলোচনার ফলে লজ্জায় ও অক্ষমতায় শরীর গরম হয়ে যেত তার।
প্রায়ই সারারাত ঘুম হতোনা তার। সোফার নীচে শুয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা চামড়ার দিকে তাকিয়ে থাকতো। মাঝে মাঝে খুব পরিশ্রম করে সোফাটি জানালার কাছে টেনে নিয়ে যেত। সোফার উপর ভর করে এলিয়ে থাকতো জানালায়। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটো, তারপরও হয়তো জানালার কাছে পুরোনো কোন স্মৃতি জড়ানো ছিল। সামান্য দুরের জিনিসও সময়ের সাথে সাথে আবছা হয়ে উঠলো তার চোখের সামনে। রাস্তার উল্টো দিকের হাসপাতাল, যা প্রতিদিনই চোখের সামনে পড়ায় বিরক্ত হতো আগে। এখন সেটা আর দেখতেই পেত না। যদি তার জানা না থাকতো , শহরের ভেতরে শার্লোটেনস্ট্রীটে তাদের বাড়ীটি, তাহলে হয়তো ভাবতো যে, এমনি এক খোলা প্রান্তরে বাড়ী ওদের, যেখানে ধুসর আকাশ আর ধুসর মাটি এক হয়ে আছে। দু্থবার তার বোন সোফাটি জানালান সামনে দেখার পর, প্রতিবারই ঘর পরিস্কার করে সোফাটি নিজেই সেখানে ঠেলে নিয়ে যেত। জানালার একটি পাল্লাও খুলে রাখলো।
যদি গ্রেগর বোনের সাথে কথা বলতে সক্ষম হতো ও ওর জন্যে যতটুকু করছে, সেজন্যে ধন্যবাদ জানাতে পারতো, তাহলে বোনের সাহায্য নেয়াও অনেকটা সহজ হতো তার জন্যে। কিন্তু এ অক্ষমতায় তাকে মনোকষ্টে ভুগতে হচ্ছে। বোনও চেষ্টা করতো এই বেদনাদায়ক পরিস্থিতি যতোটা সম্ভব সহনীয় করার। হয়তো সময়ের প্রবাহের সাথে সাথে তা করতেও পেরেছে। পাশাপাশি গ্রেগরেরও এরই মাঝে অনেক বিষয় আরো বেশী টের পেলো। বোনের এ ঘরে ঢোকাই গ্রেগরের জন্যে ভয়ংকর লাগতো। ঢোকার পরপরই বোন দ্রুত তার কাজগুলো সেরে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করার জন্যে ব্যাস্ত হয়ে পড়তো। খুব চেষ্টা করতো, যাতে গ্রেগরের সামনাসামনি না হতে হয়। জানলাটির কাছে গিয়েই তড়িঘড়ি খুলতো সেটি। যথেষ্ট শীত থাকলেও এমন ভাবে জানালার কাছে গিয়ে অনেক্ষন নি:শ্বাস নিত, যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তার। বোনের এই অস্থিরতা ও আওয়াজ দিনে দু্থবার আতঙ্কিত করতো ওকে, সে সময়টিতে ভয়ে সোফার নীচে কাঁপতে থাকতো। তারপরও তার বিশ্বাস, যে কোনো ভাবে সম্ভব হলে বোন অবশ্যই গ্রেগরের ঘরের জানালা বন্ধই রাখতো।
তার রূপান্তরের এক মাস পেরিয়ে গেছে প্রায়। এখন আর গ্রেগরের চেহারা দেখে বোনের অবাক হবার কথাও নয়। একদিন প্রতিদিনের বাঁধাধরা সময়ে একটু আগেই ঘরে ঢুকলো বোন। ও খুব অসহায় অবস্থায় জানলার এলিয়ে তাকিয়েছিল বাইরে, ও বোন ঘরে আসায় আঁতকে উঠলো খুব। এক্ষুনি জানালা খুলতে চাইবে বোন, আর নিজে সোফা সহ সেখানে! কিন্তু বোন ঘরে না ঢুকে সাথ সাথেই বেরিয়ে দরজার তালা আটকে দিল। তার চমকানোর ভঙ্গী দেখে যে কেউ ভাবতে পারে, সে তার বোনকে কামড়ে দিতে চেয়েছিল। গ্রেগর সাথে সাথেই সোফার তলায় গিয়ে লুকিয়ে পড়ল। কিন্তু সেদিন গ্রেগরকে দুপুর অবধি ওর জন্যে অপেক্ষা করতে হলো। দপুরে আগের চেয়ে অনেক বেশী অস্থির দেখা গেলো বোনকে। এতে বুঝতে শিখলো গ্রেগর, তার এই চেহারা বোনের জন্যে এখন অবধি সহনীয় নয় ও সামনেও এর কোন বদল আশা করা যেতে পারে না। সোফার বাইরে তার শরীরের প্রতিটি ছোট অংশ চোখে পড়াও তাব বোনের জন্যে এঘর থেকে বেরিয়ে যাবার জন্যে যথেষ্ট। তাই একদিন প্রায় চার ঘন্টার পরিশ্রমে সোফার উপর একটি চাদর এমন ভাবে বিছাতে সক্ষম হলো, যাতে ও সোফার নীচে পুরোপুরি আড়ালে পড়ে ও বোন উবু হয়েও তাকে দেখতে না পায়। বোনের যদি ভাবতো, গ্রেগরের এভাবে নিজেকে ঢাকার কোন দরকার নেই, তাহলে তা সে নিজেই সরিয়ে দিত। এমনভাবে অন্ধকারে পড়ে থাকা কারো জন্যোই আনন্দের নয়। কিন্তু বোন চাদরটি যেভাবে ছিল, সেভাবেই রেখে দিল। বরং একবার গ্রেগর চাদরটি সামান্য নাড়িয়ে এক পলক বাইরে তাকিয়ে বোনের চেহারায় কৃতজ্ঞতা ছাপই দেখতে পেলো।
অসমাপ্ত ....

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


