somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি অসম্পূর্ণ চিঠি

৩০ শে জুন, ২০১৫ রাত ১২:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



(১)
বাসা পাল্টানো যে বিশাল ঝামেলা সেটা এবার আমি হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। কিন্তু কিছু করার ছিল না। ছেলে মেয়ে বড় হয়ে গেছে। ওদের জন্য আলাদা রুম দরকার। তাছাড়া গ্রাম থেকে আজকাল প্রায়ই আত্মীয়স্বজন আসছে। একটু বড় বাসা না হলে চলছিলই না।
নতুন যে বাসাটায় উঠলাম সেটা খালিই পড়ে ছিল। আমরা দু’দিন আগেই ট্রাকের ওপর মালপত্র বোঝাই করে এখানে চলে এসেছিলাম। শুরুতে তো ট্রাকই খুঁজে পাই না! মহা ঝামেলার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। পরে অফিসের কলিগেরা হেল্প করলো। তারপরও ঝামেলা হল। এই ভারী ভারী ফার্নিচার দেখে ট্রাকের সাথে আসা কুলিরা প্রথমে বুঝতেই পারেনি ওগুলো অতো ভারী হবে! সব পুরনো আমলের ফার্নিচার। আমার দাদার আমলের। এখন এসব জিনিষ আর পাওয়াই যায় না। ওরা তো আমার কাঠের আলমারি নাড়াতে গিয়েই বেঁকে বসলো। বলল, চারজন লোকে এই ভারী আলমারি নামানো সম্ভব না। আরও লোক লাগবে। আরও লোক মানে, আরও টাকা।
আমি বললাম, আমি আর একটা পয়সাও বেশী দেব না।
লোকগুলো আমার কথা শুনে গাড়ি নিয়ে চলেই যাচ্ছিল! আমি আবার কাঁধে পিঠে আদর করে ওদের ফেরালাম। আরে বাবা, দু’চার টাকা বেশী নিবি, তো নিবি। তাই বলে আমি একটু দরদাম করতে পারবো না? এতো রাগ করলে চলে?
এখানে এসে ঘরদোর গোছাতে গোছাতেই পাক্কা তিন দিন লেগে গেল। জিনিষপত্র তো আর কম না! সেদিন খাটটা শেষ বারের মতো টেনে হিঁচড়ে জানালার কাছে নিয়ে পার্মানেন্টলি সেট করার পর বউকে বললাম, আর না। আমি বারান্দায় গিয়ে বসলাম তুমি আমাকে এক কাপ চা দাও ওখানে। বলা হয়নি, সুন্দর একটা বারান্দা আছে এই বাসাটায়। সত্যি কথা বলতে কি, বারান্দাটা দেখেই বাসাটা আমার পছন্দ হয়ে গিয়েছিল।
খাট নাড়াতে গিয়েই খাটের নিচ থেকে একটা দোমড়ানো চিঠি খুঁজে পেয়েছিলাম। বেশ বড় সড় চিঠি। সম্ভবত বেশ কয়টা পাতা নষ্ট হয়ে গেছে। চিঠিটা হাতে করে বারান্দায় নিয়ে এলাম। ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং লাগছে। আজকাল তো লোকজন চিঠি লেখেই না। আর চিঠির বিষয়বস্তুও বেশ গুরুগম্ভীর বলে মনে হচ্ছে। খাট নাড়াবার সময় পুরোটা পড়ার সুযোগ পাই নাই। এখন চিঠিটা পড়া যেতে পারে...
(২)
“...কেমন করে হয় আমি জানি না। তুমি চলে যাবার পর আমার কিছুদিন খুব ভালো কেটেছিল। আমার মনে আছে, দশ-বারোজন বন্ধু বান্ধব মিলে সুন্দরবন চলে গিয়েছিলাম। সেখানে ছিলাম প্রায় সাত দিন। সুন্দরবনের সেই জঙ্গলের মধ্যে সাত দিন! চিঠিতে তোমাকে সেই গল্প বলে শেষ করা যাবে না।
তারপরও একটা দিনের কথা না বলে পারছি না। পাথর ঘাটা থেকে আমরা একটা স্পীডবোট ভাড়া করেছিলাম। আমাদের সাথে যে গাইড ছিল সে জানালো, এই ট্রলারের চালক সিরাজ মিয়া নাকি সুন্দরবনের নাড়িনক্ষত্র জানে। গভীর অমাবস্যার রাতেও নাকি সে সুন্দরবনের খালগুলোকে হাতের তালুর মতোই স্পষ্ট দেখতে পায়। এই সিরাজ মিয়াকে রাজী করতে পারলেই আমরা একমাত্র বাঘের স্বর্গরাজ্য বাগদিতে পৌঁছাতে পারবো। এই বাগদির কথা আমরা আগে শুনি নাই। অন্য কেউ নাকি সেখানে যেতে রাজী হবে না।! আপাতত সিরাজ মিয়া আমাদের নিয়ে সুন্দরবনের সেফ জোন থেকেই ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে – এ রকমই কথা হয়েছে। অনেক ধরাধরির পর সিরাজ মিয়া রাজী হল।
কালীর চরের পাশ দিয়ে এক পাশ দিয়ে চলে গেছে মালঞ্চ নদী, আরেকপাশ দিয়ে অর্পনগাছিয়া নদী। আমরা মালঞ্চ নদী দিয়ে যখন ঢুকলাম তখন রাতে হয়ে আসছে। নদীর দুপাশে গহীন জঙ্গল, সেখান থেকে কিছুক্ষণ পরপর অদ্ভুত সব শব্দ ভেসে আসছে। পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দের সাথে মিশে গিয়ে আমাদের শহুরে কানে সব কিছুকেই অলৌকিক মনে হচ্ছিল। সেরাতে পূর্ণিমা ছিল কিনা সেটা মনে পড়ছে না। তবে আকাশে চাঁদ ছিল। মেঘ ছিল না বলে সেই অসম্পূর্ণ চাঁদের আলোতেই সব কিছু বেশ ভালো ভাবে দেখা যাচ্ছিল। নদীর পাড়ে থকথকে কাঁদা, ভাটার সময় কাঁদার মধ্যে গেঁথে যাওয়া কেওড়া গাছের ন্যাড়া শ্বাসমূলগুলোকে দেখাচ্ছিল পাতাল ফুঁড়ে বের হয়ে আসা ভূতের হাতের মতো।
নদীর ধার ঘেঁষে গভীর রাতে আমাদের স্পীডবোট প্রায় নিঃশব্দে চলতে লাগলো। রাতের বেলা খালের ভেতরে ঢুকলে নাকি ঝামেলায় পড়তে হবে। সেজন্যই অপেক্ষা। ঠিক যখন ভোর হয়ে আসছে, তখন সিরাজ মিয়া আমাদের জানালো এবার আমরা বেলকুচিঁ খাল দিয়ে সুন্দর বনের গভীরে প্রবেশ করবো। সবাই যেন টাইট হয়ে বসি। বেলকুচিঁ খাল বেয়ে আমরা পড়বো ঘিয়া খালে। সেই ঘিয়া খাল ধরে ঘন্টাখানেক এগুলোই বাগদী। ভাগ্য ভালো থাকলে এর মধ্যেই বাঘের দেখা পেয়ে যেতে পারি।
সিরাজ মিয়ার কথা শুনে আমরা সবাই ঘুম তাড়িয়ে নড়ে চড়ে বসলাম। খাল দিয়ে ঢুকেছি দশ মিনিটও হয়নি, এমন সময় রাব্বানি আঙ্গুল তুলে আমাদের একদিকে দেখালো। মুহূর্তেই আমাদের ঘুম জড়ানো চোখের ওপর থেকে ক্লান্তির ছায়াটা মুছে গিয়ে সেখানে আশ্রয় নিল সম্ভ্রম মেশানো বিস্ময়।
খালের পাড়ের দিকে গাছ গাছালি এদিকে একটু কম। কাঁদার ওপর লাল কাঁকড়ার ঝাঁক। উঁচু উঁচু কেওড়া গাছের গুঁড়িতে জোয়ারের সময় ভেসে আসা কাঁদা শুকিয়ে ধূসর হয়ে আছে। সেই ধূসর গাছের গুঁড়ির ভেতর দিয়ে নিশ্চিন্ত ভঙ্গীতে হেঁটে যাচ্ছে কালো হলুদের ডোরা কাঁটা এক রাজকীয় বেড়াল! দৃশ্যটা এখনও চোখের সামনে ভাসে!
তোমাকে খুব মিস করছিলাম মনে মনে। এই রকম একটা অ্যাডভেঞ্চারে যাওয়ার খুব শখ ছিল তোমার। কিন্তু আমার রাগ তখনও পড়েনি। সত্যি বলতে কি, তখন তোমার কথা মনে পড়াতে নিজের ওপরই রাগ লাগছিল। অবশ্য আমি তখনও জানতাম না তুমি সত্যিই আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারবে। মজার কথা কি জানো? সেই যে রফিক নামের ছেলেটা। যাকে নিয়ে আমাদের সম্পর্কটা বেশ কিছুদিন ধুঁক ধুঁকে এই তিক্ততায় পৌঁছে গেল, সেই রফিককে দেখলাম সারা রাস্তা কার সাথে সারাক্ষণ যেন ফোনে কথা বলছে। রফিক সেই মেয়েটাকেও ভালবাসতে পারেনি।
ওখান থেকে ফিরে আসার পর বেশ কিছুদিন আমি ইচ্ছা করেই তোমার কোন খোঁজ খবর নেইনি। নিজের ইগোর কাছে পরাজিত হতে ইচ্ছা করছিল না। এখন ভেবে খুব আফসোস লাগে। ইশ! তখনও সময় ছিল! শুধু যদি নিজেকে শুধরে নিয়ে তোমার হাতটা টেনে ধরতাম! তুমি কি হাতটা ছাড়িয়ে নিতে পারতে? আমার মনে হয় না। সেক্ষেত্রে আমাকেও আর এই ছন্নছাড়া জীবন যাপন করতে হতো না। জীবনটা হয়তো সুন্দরই হতো।
আমি যখন বুঝলাম তোমাকে আর ফিরে পাবো না, তার পরবর্তী ছয়টা মাস আমি খুব পাগলামি করে বেড়িয়েছি। ইউনিভার্সিটি যেতাম না, ক্লাস করতাম না। আজে বাজে কিছু বন্ধু জুটেছিল। নেশা করা শিখে গেলাম খুব দ্রুত। বাবার কাছ থেকে কেড়ে কুড়ে টাকা নিয়ে গাঁজা খেতাম। মদ খেতাম। ওসব করতে গিয়েই মানিব্যাগে রাখা তোমার ছবিটা একদিন হারিয়ে ফেললাম। ঠিক সে দিনই স্পষ্ট করে বুঝলাম আমি তোমাকে হারিয়েছি। বুঝলাম আমার কি দোষ ছিল। তারপরই নেশা ভাং ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমার মনের মধ্যে যে যন্ত্রণা জন্ম নিয়েছিল সেদিন সেটা নেশা করে কাটানো যায় না। আসলে সারাজীবন আমি কোন কিছুই বুঝে করিনি। তখন আমার কাছে সব কিছুই ছিল। যখন বুঝলাম তখন আর কোথাও কিছুই নেই।”
চিঠির বেশ কিছু অংশ এরপর নষ্ট হয়ে গেছে, অনেক চেষ্টা করেও কিছুই উদ্ধার করা গেল না। আমি এস সময় হাল ছেড়ে দিয়ে বাকি অংশটুকু পড়তে লাগলামঃ-
“জানো, এই কয়দিন ধরে আমি আমার বাউন্ডুলে জীবনকে একটা রুটিনের মধ্যে নিয়ে এসেছি। সময় মতো অফিস শেষ করি। অফিস থেকে ফিরেই এখন আর আড্ডা দিতে বের হয়ে যাই না। জামাকাপড় বদলে আমি একটা গোসল দিয়ে ফেলি। জঘন্য একটা গরম পড়েছে। গোসল করার পর নিজেকে বেশ ফুরফুরে লাগে। ফুরফুরে মেজাজ নিয়েই সন্ধ্যার নাস্তা করি। নাস্তার পর এক কাপ চা। চা-টা নিজেই বানাই। আমার আবার কড়া লিকারের চা পছন্দ। লিকারের মাপটা ঠিকঠাক না হলে চা খেয়ে আরাম নেই। চা নিয়ে সোজা বারান্দায় চলে যাই। রকিং চেয়ারে দোল খেতে খেতে চা খাই আর মনে মনে বলি – আহ!
চা খাওয়ার পর হঠাৎ করেই একটা অস্থিরতা চলে আসে। এই সময় একটু আড্ডা দিতে ইচ্ছা করে। তবে আমি যেহেতু আমার বেখাপ্পা জীবনযাপনকে একটা রুটিনের মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি সেহেতু এসব আজেবাজে চিন্তা বাদ দিয়ে আমি একটা বই পড়তে বসি অথবা গানটান শুনি। এখন পড়ছি ভল্গা থেকে গঙ্গা। সেই প্রাগৈতিহাসিক সময়ের মানুষের জীবনযাত্রা বোঝার চেষ্টা করছি। বইটা পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে একটু আনমনা হয়ে পড়ি বলে তাল হারিয়ে যায়। বইটা ভালো। খুবই ইন্টারেস্টিং। তবে আমি একটু ধীরে সুস্থে পড়ছি। ভালো বই ধীরে সুস্থে পড়াই নিয়ম।
সমস্যা হয় যখন রাত নয়টা দশটার দিকে আমার নিজেকে একটু নিঃসঙ্গ লাগতে শুরু করে। তখন আমি শীতল পাটি আর একটা বালিশ কোলে করে ছাদে চলে যাই। সাথে থাকে গান শোনার সরঞ্জাম আর একটা খোলা আকাশ। অজস্র তারা ভরা ঝকমকে আকাশটার শরীর পিছলে উড়ে উড়ে চলে যেতে থাকা প্রজাপতি মেঘ আর হু হু করে বয়ে যাওয়া মাতাল হাওয়ায় আমার কেমন যেন উদাস উদাস লাগে। গভীর রাত পর্যন্ত আমি কল্পনার সিড়ি বেয়ে কার কার আকাশে যেন ঘুরে বেড়াই।
আজকে সারা আকাশ গুনে দেখলাম। মনে হল চার পাঁচটা তারা বেশীই আছে। অবশ্য তারা কিছু কমও থাকতে পারে। আজকাল আকাশের দিকে তাকিয়ে আমি কোন কূল কিনারা খুঁজে পাই না। তাই রুটিন ধরে আমি প্রতি রাতে একটা আকাশ খুঁজে বেড়াই। কিন্তু তোমার আকাশটা কেন জানি আমি কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। সময় পেলে তোমার আকাশটা নিয়ে একদিন আমার কাছে চলে এসো! রুটিন ধরে একা একা তারা গুনতে আমার আর ভালো লাগে না।...”
(৩)
চিঠিটা পড়ে আমার খুব মন খারাপ হয়ে গেল। কার লেখা চিঠি এটা? এই বাসাতেই থাকতেন নাকি? ভদ্রলোকের জন্য আমার খুবই খারাপ লাগছে।
আমি খুব সাধারণ মানুষ, চিন্তা ভাবনার গভীরতা একেবারেই নেই। নিজের জীবনে অ্যাডভেঞ্চার বলতে কি বোঝায় সেটা কখনোই বুঝিনি। আমার কাছে এখন এই বাসা পাল্টানোটাই একটা অ্যাডভেঞ্চার। ছেলে মেয়েকে নিয়ে স্কুলে-কলেজে যাই, ওদের যখন রেজাল্ট দেয় – এগুলোই আমার জীবনের একমাত্র গল্প। কথা বলে আরাম পাওয়া যায় না বলে বোধহয় আমার বন্ধুবান্ধবও কম।
বিয়ের আগে আমার সহধর্মিণীর সাথে যেদিন প্রথম দেখা হল সেদিন সে চোখমুখ শক্ত করে আমাকে কিছু কথা বলেছিল। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় সেও একজনকে ভালোবাসতো। কোন একটা কারণে দু’জনের সম্পর্কটা শেষ পর্যন্ত টেকেনি। সেই ছেলেটা কখনও হয়তো আর ফিরে আসবে না, এলেও সে হয়তো আর ফিরে যাবে না, কিন্তু তাঁর মন থেকে ছেলেটাকে মুছে ফেলা কঠিন। আমাকে দেখে তার ভালো মানুষ বলে মনে হয়েছে বলে সে বিয়েতে রাজী হয়েছে। এখন আমি চাইলে তাঁকে বিয়ে করতেও পারি, নাও করতে পারি। মজার ব্যাপার হল, আমিও একজনকে মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছিলাম একসময়। অবশ্য সেটা মনে মনেই থেকে গিয়েছিল। কি যেন নাম ছিল মেয়েটার? মনে পড়ছে না।
আমার স্ত্রীকেকে প্রথম দেখেই সম্ভবত আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম। সেদিন তাঁর সেই অদ্ভুত কথা শুনে দু’রাত আমি ভালো করে ঘুমাতে পারিনি। কিন্তু তৃতীয়দিন সকালে বাসার সব মুরুব্বীদের জোর করে ধরে নিয়ে ওদের বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম। সেদিনই ওকে আঙটি পড়িয়ে রেখে এসেছিলাম। আমার ভালোবাসার গল্প বলতে এতটুকুই! চিঠিটা পড়ে আজকে আবার সেই কথাগুলো মনে পড়ে গেল। বুকের ভেতর কোথাও কি একটু ব্যাথা করে উঠল? কে জানে?
এরমধ্যেই আমার গিন্নি এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় চলে এসেছে। তাঁর দিকে তাকিয়ে আমার বুকের মধ্যে কেমন যেন করে উঠলো। ক্লান্ত মুখে এখনও হাসি জড়িয়ে আছে। আমি চিঠিটা হাতে নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করলাম, “তুমি কেমন আছো?”
গিন্নি অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে পালটা প্রশ্ন করলো, “হঠাৎ এই কথা?”
আমি চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বললাম, “আমার পাশে একটু বসবে!”
“আহ! রাখ তো! অনেক কাজ পড়ে আছে! রান্না করতে হবে!” বলেই ঘরের ভেতরে রওনা দিল।
আমার জীবনটা এই রকমই। আমার কোন কথাই বলা হয়ে ওঠে না। হয়তো আমার বলার প্রয়োজন নেই। আমি এক হাতে সেই অসম্পূর্ণ চিঠিটা আর এক কাপ ধূমায়িত চা নিয়ে বারান্দায় একা বসে রইলাম। চিঠিটা মনে হয় না পড়লেই ভালো ছিল।
(৪)
চায়ের কাপটা এক পাশে রেখে দোমড়ানো চিঠিটা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে বাইরে ফেলে দিলাম। আর তখনই আমার স্ত্রী এক কাপ চা হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে বসলো। আমি প্রায় চমকে গিয়েছিলাম।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ও আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “কি যেন বলছিলে?”
আমি অন্যমনস্ক ভঙ্গীতে বললাম, “নাহ, তেমন কিছু না।”
“তোমার কি কোন কারণে মন খারাপ?”
“নাহ!”
ঠিক তখনই হৈহৈ করতে করতে আমার দুই ছেলে মেয়ে আন্দালিব আর আনিকা এসে পড়লো।
“তোমরা একা একা এখানে বসে কি করছো, বাবা?” জোর করে আমার হাতের চায়ের কাপটা কেড়ে নিয়ে মেয়ে প্রশ্ন করলো।
“গাধী, তুই কিছুই বুঝিস না। বাবা-মা গল্প করছিল।” কথা বলতে বলতে আন্দালিব মেঝেতেই বসে পড়লো।
“সত্যি!” আনিকা বাচ্চা মেয়ের মতো খুশী হয়ে ওঠে। “অনেক দিন গল্প শুনি না।”
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, “সত্যি গল্প শুনবি?”
ছেলে মেয়ে এক সাথে হ্যাঁ বলে ওঠে। আন্দালিব এবার মায়ের হাত থেকে চায়ের কাপ কেড়ে নিয়ে বারান্দায় হেলান দিয়ে বসে।
“আমি যে একবার সুন্দরবন গিয়েছিলাম সেই গল্প কি তোদের বলেছি?”
“না, বাবা!”
সদ্য ছিঁড়ে ফেলে দেয়া চিঠিটার গল্পটা ধার করে আমি গল্প বলতে থাকি। আকাশে একফালি চাঁদ উঠেছে। সেই চাঁদের আলোর খানিকটা এসে পড়েছে আমাদের বারান্দায়। সেই আলোতে গল্প শোনার জন্য আমার সামনে বসে আছে আমার ছেলে, মেয়ে আর তাদের মা। এই তিনজন মানুষের কাছে আমি ভালোবাসার ঋণে জড়িয়ে আছি। নিজেদের ভুল ভ্রান্তি এড়িয়ে পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটাই আসলে একটা কঠিন সাধনা। সেই সাধনার পুরস্কার আছে। আমার মনে হয় ভালবাসতে পারাটা সেই সাধনার পুরস্কার, তবে এই উপহার গ্রহণ করতে জানতে হয়। আমি খুব সাধারণ একজন মানুষ। তারপরও জীবনের এই অসাধারণ বিষয়টা আজকে আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে ধরা দিল।
বারান্দায় সুন্দর বাতাস আসছে। সেই বাতাস কোন এক জায়গা থেকে ভাসিয়ে নিয়ে আসছে হাসনাহেনার মাদকতাময় সুবাস। আমি গল্প বলতে শুরু করি, অসম্পূর্ণ চিঠিটা এবার সম্পূর্ণ হতে থাকে।

"...He breathes into my ear
until my soul takes on His fragrance.
He is the soul of my soul –
How can I escape?
But why would any soul in this world
want to escape from the Beloved?"
---Rum

আমার লেখা অন্যান্য গল্পঃ

১) একটি অসমাপ্ত ভালোবাসার গল্প
২) ফেরা
৩) জয়ানালের মধ্যরাতের কবিতা
৪) নিগূঢ় প্রতিবিম্ব
৫) পুনর্জাগরন
৬) একজন জাহেদা বেগম
৭)গল্পঃ আক্ষেপ
৮) পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট প্রেমের গল্পটা
৯) শেষ পর্যন্ত
১০) কোন এক অনিয়ন্ত্রিত সকালে
১১) নীরব রজনী দেখো মগ্ন জোছনায়
১২) ভয়

আমার ফেসবুকঃ
স্বপ্নস্বর্গ - নাভিদ কায়সারের ব্লগ
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুন, ২০১৫ রাত ১২:১৭
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সিকান্দার রাজার চেয়ে একজন পতিতাও ভালো।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৭

সিকান্দার রাজা কোকের বোতল সামনে থেকে সরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গেছেন! কিন্তু তাকে যারা হিরো বানিয়েছেন, তারা কেউ দেখছেন না তিনি কত বড় নেমকহারামি করেছেন। তারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল।

ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে শোনা গুরুত্বপূর্ণ অনেক ছড়া কবিতার মত নিচের এই লাইন দুইটাকে আজও অনেক প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×