রাতের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদটা ঝলমল করছে। মৃদু বাতাসের স্পর্শে গাছের পাতাগুলো ধীরে ধীরে দুলছে। পাখিরা দিনের ক্লান্তি ভুলে নিরাপদ আশ্রয়ে ঘুমিয়ে আছে। গ্রামের পুকুরের জলেও শান্ত শীতলতার স্পর্শ। সারাদিনের কোলাহল পেরিয়ে শান্তির আবেশ গ্রামটিকে ঘিরে রেখেছে। এই গ্রামের নাম শান্তিপুর।
শান্তিপুর গ্রামের মানুষগুলো সাদামাটা, সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত। তাদের জীবনে কোনো জটিলতা নেই, নেই কোনো প্রতিযোগিতা। সকালে সূর্যের প্রথম আলো যখন গ্রামের মাটিতে পড়ে, তখনই যেন জীবন নতুন করে শুরু হয়। দিন শুরু হয় কৃষক মধু মিয়ার মাঠে যাবার প্রস্তুতি নিয়ে। মধু মিয়া বংশ পরম্পরায় কৃষিকাজ করে আসছে। তার জীবনের সবটুকু ভালোবাসা লুকিয়ে আছে এই জমিতে। জমি চাষ করা, ধানের সোনালী রঙ ধরা দেখার মধ্যেই তার সুখ।
মধু মিয়ার বউ, ফুলমণি। সরল স্বভাবের এক নারী, যে সারাদিন ঘরের কাজকর্ম সামলে আবার সন্ধ্যায় উঠোনে বসে গ্রামের মেয়েদের সাথে গল্প করে। তার গল্পের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে আনন্দ। এক ঝাঁক পাখির মতোই তার কথাগুলো মিষ্টি আর সাবলীল। মধু মিয়ার একটাই ছেলে, রাজু। সদ্য হাইস্কুল শেষ করেছে। গ্রামের স্কুলে পড়ে সে অনেকটাই এগিয়ে গেছে, তার মেধার জন্য সে সবার প্রিয়।
একদিন সকালে রাজু উঠোনে বসে পড়ছিল। হঠাৎ তার মনে হলো, জীবন তো শুধু এই গ্রামেই সীমাবদ্ধ নয়। বাইরের জগৎ কেমন? শহরের মানুষরা কেমন জীবন যাপন করে? রাজুর কৌতূহল দিন দিন বেড়েই চলল। সে তার বাবার কাছে এসে বলল, "বাবা, আমি শহরে যেতে চাই। নতুন কিছু শিখতে চাই।"
মধু মিয়া রাজুর কথা শুনে কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলেন। শহরের জীবন সহজ নয়, জানেন তিনি। তবুও রাজুর চোখের স্বপ্ন দেখার ইচ্ছা তাকে থামাতে পারেনি। তিনি বললেন, "তুই যা চাইছিস তা যদি তোর ভালো হয়, তাহলে আমি তোকে বাধা দিব না। তুই যা, তবে মনে রাখিস—যেখানেই থাকিস, মন যেন সবসময় ভালো থাকে।"
রাজু বাবার আশীর্বাদ নিয়ে শহরের পথে রওনা দিল। শহরে পৌঁছে সে বুঝল, গ্রামের সরল জীবনের সাথে শহরের জীবনের কোনো মিল নেই। শহরে সবাই যেন দৌড়াচ্ছে—কেউ কাজের পেছনে, কেউ টাকার পেছনে, কেউ আবার সুখের সন্ধানে। রাজু কিছুদিন পর একটা কলেজে ভর্তি হল। সে পড়াশোনায় মনোযোগ দিল, কিন্তু তার মনের কোথাও যেন এক ধরণের শূন্যতা বিরাজ করছিল। গ্রামের সেই শান্ত পরিবেশ, মায়ের হাতের রান্না, বাবার মমতা—সবকিছু তার মনে পড়তে লাগল। শহরের কোলাহলে হারিয়ে যেতে যেতে সে অনুভব করল, তার জীবনের আসল প্রশান্তি তো সেই গ্রামে।
কয়েক মাস পর রাজু ছুটি নিয়ে গ্রামে ফিরে এল। বাড়ি ফিরেই সে যেন নতুন করে শ্বাস নিল। তার মা-বাবা তাকে দেখে খুশিতে আটখানা। সেই পরিচিত উঠোন, পুকুরের জল, বাঁশঝাড়ের মৃদু শব্দ—সবকিছু তার হৃদয়ে প্রশান্তি এনে দিল।
গ্রামে ফিরে সে বুঝতে পারল, মানুষের প্রকৃত শান্তি শহরের চাকচিক্য কিংবা বড় বড় দালানের মধ্যে নয়; শান্তি লুকিয়ে আছে তার শিকড়ে, যেখানে মানুষ প্রকৃতির সাথে মিশে থাকে, সহজ-সরল জীবনে। রাজু স্থির করল, সে আর শহরে ফিরে যাবে না। এখানেই থেকে যাবে, বাবার মতো জমিতে কাজ করবে।
তার এই সিদ্ধান্তে মধু মিয়া ও ফুলমণি যেন তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার পেলেন। রাজু ধীরে ধীরে গ্রামের মানুষদের সঙ্গে মিশে গেল, তার বন্ধুদের সাথে মিলে গ্রামের উন্নয়নে নতুন নতুন পরিকল্পনা করতে শুরু করল। সে গ্রামের যুবকদের সংগঠিত করে শিক্ষা, কৃষি ও স্বনির্ভরতার নানা উদ্যোগ নিতে লাগল।
এরপর কেটে গেল কয়েক বছর। রাজুর উদ্যোগে শান্তিপুর গ্রামের মানুষ অনেক এগিয়ে গেল। গ্রামের শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত হলো, কৃষিকাজে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ল, সবাই মিলে সমৃদ্ধি আর প্রশান্তির এক নতুন অধ্যায় তৈরি করল। আর রাজু? সে বুঝতে পারল, তার জীবনের আসল সুখ শহরের কোলাহলে নয়, এই সরল গ্রামের মাটিতে, যেখানে তার শেকড়।
রাজু প্রতিদিন সন্ধ্যায় পুকুরপাড়ে বসে পূর্ণিমার চাঁদ দেখে। বাতাসের মৃদু হাওয়ায় তার মন শান্ত হয়ে যায়। তার মনে হয়, প্রকৃত শান্তি তো এটাই—নিজেকে খুঁজে পাওয়া, নিজের আশেপাশের মানুষদের নিয়ে সুখে থাকা।
এভাবেই শান্তিপুর গ্রামের রাজু তার জীবন খুঁজে পায়। শহরের কোলাহল নয়, গ্রাম্য প্রকৃতির কোলে সে পায় সেই অনাবিল প্রশান্তি, যা তার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন।
ছবিসূত্র