প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব তৃতীয় পর্ব চতুর্থ পর্ব
সকালবেলা বৃষ্টির শব্দে নিলার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম ভেঙ্গে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সে দেখতে পেল অবিরত বারিধারার ঝমঝম শব্দ। সে এক বিমোহিতকর দৃশ্য। বৃষ্টি নিলার খুবই প্রিয়। ছোটবেলায় যখন স্কুলে পড়ত, তখন বৃষ্টি হলেই ঘর থেকে বের হয়ে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজত, এর জন্য মায়ের কাছে যে কত বকুনি খেতে হয়েছে তার হিসেব নেই। বহুবছর পরে আজ বৃষ্টির জন্য সেই উন্মাদনাটা আর নেই, তার বদলে এখন মনে স্থান করে নিয়েছে বৃষ্টির গান। বৃষ্টি হলেই বৃষ্টি নিয়ে গাওয়া বিভিন্ন শিল্পীদের গান শুনতে চেষ্টা করে নিলা, প্রিয় গানের কলিগুলো বারবার আনমনে আউরে যায়। এই যেমন এই মুহুর্তে তার আগুনের গাওয়া একটি গান খুব মনে পড়ছেঃ
বৃষ্টি এসেছে মনে
অসময় এই জীবনে
বৃষ্টি থেকো গো তুমি
সারাক্ষণ, আমরণ……….........
আজ ঘুম থেকে উঠেই কম্পিউটার টা অন করে আগুনের গানটা ছেড়ে দিয়ে জানালার পাশে বসে রইল নিলা অনেকক্ষণ। আগুনের গানের সাথে সুর মিলিয়ে নিলারও বৃষ্টিকে আপনমনে বলে ওঠে, "“হে বৃষ্টি, এমন ঝরঝর করে তুমিও ঝরে পড়ো আমার এই জীবনে।"”
বৃষ্টি দেখতে দেখতেই নিলা গতকাল রাতের শুভ্রর ফোনের কথা ভাবছে। শুভ্র কি সিরিয়াস কিছু বলতে চায় নিলাকে? ও কাল এমন স্বরে কথা বলল যেন বিশেষ কিছু ভাবছে নিলাকে নিয়ে? সত্যিই কি তাই নাকি এটা নিছকই নিলার অস্থির মনের কল্পনা? আসলে গতকাল বিকেলে শুভ্রকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার পর থেকেই নিলা কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠেছে। এতদিন যাকে শুধু একজন ভাল বন্ধুর দরজা দিয়েই এসেছিল, হঠাৎ একটি বিকেলের স্বপ্নেই সেই দরজা দিয়ে যেন নতুন এক সম্পর্কের আগমন ঘটছে। শুভ্রও কি ঠিক এমনটাই ভাবছে? যদি এমনটাই না ভেবে থাকে, তাহলে কাল রাতে ফোনে ওর কন্ঠস্বর এমন ঘোর লাগা মনে হল কেন? আজ বিকেলে দেখা করে সে আসলে কি বলতে চায় নিলাকে? এসব নানা কথা ভাবতে ভাবতে নিলা সিদ্ধান্ত নিতে পারছেনা সত্যিই সে আজ শুভ্রর সাথে দেখা করবে কিনা, কেমন যেন একটা লজ্জাবোধ তাকে ঘিরে রেখেছে। কি আশ্চর্যের ব্যাপার!!! এতদিন শুভ্রসহ সব বন্ধুরা মিলে কত আড্ডা দিয়েছে ক্যাম্পাসে, বটতলায়, ক্যান্টিনে, এর আগে কখনও শুভ্রকে নিয়ে এমন অনুভূতি হয়নি নিলার, আজ এমন হচ্ছে কেন?
ধুর ছাই, কিসব ভাবছে নিলা!!! এতসব ছাইপাশ না ভেবে দেখাই যাক না, কি বলতে চায় শুভ্র। এসব ভাবতে ভাবতেই সকালের নাস্তা সেরে পড়তে বসল সে, পরীক্ষার সিলেবাস এখনও কমপ্লিট করা হয়নি, আজকালের মধ্যেই শেষ করতে হবে। দুপুরের মাঝে পড়া কিছুটা এগিয়ে রেখে বিকালে শুভ্রর সাথে দেখা করতে যাবে বলে ঠিক করল সে।
ওদিকে শুভ্ররও ঘুম ভাঙল বৃষ্টির শব্দে। ঘুম ভাঙতেই গতকালের বিকেলের বৃষ্টিভেজা স্বপ্নের কথা মনে পড়ে গেল তার, যেখানে সে আর নিলা বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছিল সবুজে ঘেরা একটি পার্কে। গতকালের সেই স্বপ্নের পর আজ এই অঝোরধারায় বৃষ্টি, শুভ্র আনমনে হঠাৎ বলে উঠল, “হোয়াট এ কো-ইনসিডেন্স!!!”
পরীক্ষার প্রস্তুতি এরইমধ্যে প্রায় শেষ শুভ্রর, এখন শুধু একটু ঝালিয়ে নেয়ার পালা। শুভ্র ব্রেকফাস্ট শেষে তাই একটু বই নিয়ে বসল সিলেবাস রিভিশান দেয়ার জন্য। পড়তে পড়তে কখন যে দুপুর হয়ে গেল টেরই পেলনা সে। হঠাৎ নিলার ফোনকলে শুভ্রর পড়াশুনা থেকে মনোসংযোগে ছন্দপতন ঘটলঃ
-কি করছিস শুভ্র?
-এই তো পড়ছিলাম, সিলেবাস অলমোস্ট কমপ্লিট, এখন একটু রিভিশান দিচ্ছিলাম। তুই কি করছিলি?
-আমিও বই নিয়ে বসেছিলাম ব্রেকফাস্টের পরে, সিলেবাস এখনও কিছুটা বাকি আছে, আজকালের মধ্যে শেষ করতে হবে, সময় আর বেশী বাকি নেই।
-ডোন্ট ওয়ারি, সময় তো আছে এখনও দুদিন, পড়তে থাক, শেষ হয়ে যাবে সিলেবাস।
-হুমমম……আচ্ছা বিকালে বের হবি বলছিলি, কোথায় যেতে চাস?
-তুই বল, আফটার অল লেডি ইস ফার্স্ট (মুচকি হেসে)…
-(অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে নিলার উত্তর) সংসদ ভবনের সামনে আয়, আজ ওয়েদারটাও ঠান্ডা, ঐখানে বসে কথা বলতেও ভালোই লাগবে।
-গুড আইডিয়া, আমি তাহলে চারটার মধ্যে ঐখানে পৌঁছে যাব।
-ঠিক আছে, পৌঁছে ফোন দিস।
-ওকে, ছাড়ছি এখন। বাই।
-বাই।
নিলার সাথে কথা শেষ করে শুভ্র ওয়াশরুমে গেল শাওয়ার নিতে। শাওয়ার শেষে বের হয়ে মায়ের সাথে লাঞ্চ সেরে তৈরী হয়ে বের হল। রাস্তায় প্রায়সময়ই ভয়াবহ জ্যাম থাকে, তাই একটু আগেভাগেই বের হল, নাহলে সময়মত পৌঁছাতে পারবেনা, তখন আবার নিলার ঝাড়ি খেতে হবে। চারটার কিছু আগেই সে পৌঁছে গেল, তখনও নিলা এসে পৌঁছায়নি দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল শুভ্র, “যাক এ যাত্রা নিলার ঝাড়ি থেকে বাঁচলাম”, মনে মনে বলে উঠল সে। নিলার মোবাইলে ফোন করল তখনই সে, কিন্তু বারবার রিং বেজেই যাচ্ছে, বেজেই যাচ্ছে, নিলা ফোন ধরছেনা। মনে হয় ও রাস্তায় আছে, তাই মোবাইলের রিং টের পায়নি। তাই অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল শুভ্র। বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হলোনা, মিনিট দশেক পরেই দূর থেকে নিলাকে হেঁটে আসতে দেখল সে। কাছে এসেই প্রথমে কথা বলে উঠল নিলাঃ
-সরি রে, দেরী হয়ে গেল। কি করব বল, জ্যাম এ আটকা পড়েছিলাম অনেকক্ষণ।
-ইটস্ ওকে, আমিও এসেছি বেশীক্ষণ হয়নি, মিনিট দশেক আগেই পৌঁছেছি।
-হুমমম। আচ্ছা বল এবার, কাল তোর কথা শুনে মনে হয়েছে তুই আমাকে কিছু বলতে চাস……
-কি করে বুঝলি?
-হাহাহা, জানিসই তো, মেয়েরা অনেককিছু আগেভাগেই টের পায়।
-হুমম, তা জানি। আসলে কিভাবে যে শুরু করি বুঝতে পারছিনা……..
-অত ভণিতা না করে বলে ফ্যাল তো কি হয়েছে?
-আসলে কাল ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরে দুপুরে ঘুম দিয়েছিলাম একটা। স্বপ্নে তোকে দেখলাম…….
-তাই? কি দেখলি স্বপ্নে?
-দেখলাম প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে, তুই আর আমি একটা পার্কে হেঁটে বেড়াচ্ছি। আমাদের দুজনের হাতেই ছাতা থাকার পরও ছাতা বন্ধ করে আমরা কাকভেজা হয়ে হাঁটছি, আশেপাশের লোকজন আমাদের এই পাগলামি দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, কিন্তু আমাদের সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।
-হুমমম……আমিও কাল রাতে তোকে নিয়ে একটা স্বপ্ন দেখেছি।
-তাই নাকি!!! কি দেখলি?
-দেখলাম তুই আর আমি ট্রেনে করে দূরে কোথাও যাচ্ছি, আমি আর তুই পাশাপাশি সিটে বসে।
(নিলা যে শুভ্রর কাঁধে মাথা রেখে বসেছিল, স্বপ্নের এই অংশটা সে শুভ্রকে লজ্জায় বলতে পারলোনা)
-হুমম….......সুন্দর স্বপ্ন।
-দেখেছিস নিলা, তোর আর আমার স্বপ্ন প্রায় একই সময়ে দেখা, একেই মনে হয় বলে কো-ইনসিডেন্স।
-হবে হয়তো।
-তোকে আজ একটা কথা বলব ভাবছি, তুই যদি মাইন্ড না করিস তাহলে বলতে পারি।
-(রাগতঃ স্বরে নিলার উত্তর) তুই বেশী ভণিতা করতে শিখেছিস আজকাল, কি বলতে চাস সরাসরি বলতে পারিস না?
-না মানে, ইয়ে মানে…..(শুভ্র আমতা আমতা করছে)
-উফ, তোকে নিয়ে আর পারিনা, এমন করলে আমি চলে যাব কিন্তু………....
(এই বলে নিলা উঠে দাঁড়াল, চলে যাবার জন্য পা বাড়ালো)
(ঠিক এই সময়ে শুভ্র হাত বাড়িয়ে নিলার হাতটা ধরলো)
-প্লিজ যাসনে নিলা, আমি তোকে ভালোবেসে ফেলেছি রে……।
(এই কথাটি যদিও মনে মনে আশা করছিল নিলা শুভ্র’র কাছ থেকে, তার পরও কেমন যেন একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল সে শুভ্র’র কথাটি শুনে)
-কি বললি!!! আবার বলতো!!!
-(ভয়ে ভয়ে শুভ্র’র উত্তর) কেন? আমি কি অন্যায় কিছু বললাম? যদি অন্যায় কিছু হয়ে থাকে তবে বলতে পারিস, আমি তোকে ভালোবাসি বলে যে তোরও আমাকে ভালোবাসতে হবে, এমনতো নয়। তোর পক্ষ থেকে যদি উত্তর হ্যাঁ না হয়, তবে আমরা আগের মতই বন্ধু থাকব।
-না, তুই যা বললি সেটা আরেকবার বল, শুনতে ইচ্ছা করছে।
(এবার শুভ্র বুঝতে পারল নিলারও সম্মতি আছে)
-আই লাভ ইউ, নিলা।
-আই লাভ ইউ টু, শুভ্র।
(চলবে).......