(আগের অংশটুকুর জন্য এখান থেকে পড়ে আসতে হবে)
নাঈমকে আমি প্রথম দেখি মসজিদে।
প্রতি শুক্রবার মসজিদে বেশ লোক সমাগম হয়। বেশীর ভাগ লোকেই অফিস বা ক্লাশ এর ফাঁকে এসে জুমা'র নামাজটি পড়ে যেতে চায়। সবাই থাকে তাড়াহুড়ার ভিতর।
হনলুলুর মসজিদটি আসলে একটি বাড়ি ছিল এককালে। একদম আবাসিক এলাকার মধ্যে এর অবস্থান হওয়াতে ছোট রাস্তার মধ্যে এতগুলো গাড়ি পার্ক করাটা এক ভ্যাজালের ব্যাপার। নাঈমকে আমি প্রথম দিন দেখি যে সে লোকজনকে তাদের গাড়িগুলো পার্ক করানোতে সাহায্য করছে।
তার চেহারা-সুরত আমাদের মতো দেখে প্রথমে ভেবেছিলাম যে সে পাকিস্তানীই হবে। ওরা আবার মসজিদের ব্যাপারে মহা উৎসাহী হয় সেটা জানতে পেরেছি ততদিনে।
কিছুদিন পর আর এক বাংলাদেশীর মাধ্যমে নাঈমের সাথে পরিচয় হোল। সে আসলে কেরালার লোক, মাস্টার্স করছে ইঞ্জিনিয়ারিংএ।
প্রথম আলাপেই সে অনুযোগের স্বরে বললো, "তোমাকে শুধু আমি জুমার দিনেই মসজিদে দেখি।"
"তাতে সমস্যা কি?"
"মসজিদ কি শুধু শুক্রবারের জন্যেই? না-মসজিদে সব সময়ে আসতে হবে।"
আমি এ ধরণের জংগী বক্তব্যে ঘাবড়ে যাই।
নাঈম কথা বলেই চলে, "তুমি কিছু মনে করোনা, তোমরা মানে বাংলাদেশের লোকেরা ধর্মটাকে বেশী সিরিয়াসলি নাওনা। কেমন যেন একটা দায়সারা ভাবে তোমরা মসজিদে আসো। টুপটাপ দুটো সেজদা দিয়ে সালাম ফিরাও, ব্যাস-তোমাদের কাজ শেষ। আমাদের নবী বলেছেন মসজিদে বসে সব কাজ করতে। আমি তো এখানে বসে বসেই আমার পরীক্ষার পড়াশুনা করি।"
আমি তখন পালাতে পারলে বাঁচি। এ আমি কার পাল্লায় পড়লাম রে বাবা?
নাঈম চলে যাওয়ার পর বাংলাদেশীটির দিকে তাকাতে সে হেসে বলে,"নাঈম মসজিদের ব্যাপারে একটু বেশি সিরিয়াস। নতুন লোক দেখলেই টানাটানি শুরু করে দেয়।"
এর পর থেকে নাঈমের মুখোমুখি হইনা তেমন। দূরে থেকে দেখলেই ক্যাম্পাসের গাছ-গাছালীর ভিতর লুকিয়ে পড়ি। কে জানে আবার কি নতুন ফতোয়া-টতোয়া দেয়া শুরু করবে।
শুক্রবারে তাকে দেখা যায় মহাব্যস্ত ভাবে গাড়ী পার্ক করানোতে। মাঝে মাঝে লোকজন না পাওয়া গেলে সে ছোটখাটো খুৎবাও দিয়ে ফেলে। মহা আলেম-টাইপের কোন বক্তৃতা না, ইসলাম নিয়ে আমাদের জানা বিষয়ের উপরই কিছু একটা বলা।
আস্তে আস্তে আমার মসজিদে যাওয়া কমে আসে। নাঈমের সাথে খুব একটা দেখা সাক্ষাৎ হয়না।
একদিন হঠাৎ সুজাত আমাকে বললো,"তুমি না বলেছিলে আমার সাথে একদিন নাইটক্লাবে যাবে?"
"বলেছিলাম নাকি?"
"হ্যাঁ বলেছিলে। আগামী কাল শুক্রবার। রাতে যাবে নাকি আমার সাথে?"
"খামাখা আমাকে নিয়ে টানাটানি কেন হে? আমিতো বলেইছি যে আমি মদ খাইনে, আর মেয়েদের সাথে নাচানাচি করার ইচ্ছে বা সাহস কোনটাই নেই আমার। তাহলে খামাখা সেখানে গিয়ে আমার ফায়দা কি?
সুজাত হাসে। "তুমি যাবে মজা দেখতে। দেখবে পেটে এ্যালকোহল পড়লে মানুষ কেমন বদলে যায়।"
আমি এ কথায় ঘাবড়ে যাই। "তুমি আবার ওখানে গিয়ে মাতলামী করবে নাকি?"
একথায় সুজাতের মনে হয় একটু আঁতে ঘা লাগে। "মাতলামী? আমি করবো মাতলামী? তুমি কি জানো আমার ল্যাবের লোকেরা আমাকে কি বলে?"
"নাহ-আমি কিভাবে জানবো যে তারা তোমাকে কি বলে?"
"তারা বলে যে সুজাত-ইউ ড্রিংক লাইক এ ফিশ।"
"তার মানে কি? আমি আবার ইংরেজী বুঝি কম।"
"তার মানে যে আমি অনেকখানি মদ খেতে পারি কোন রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই। আমার এ্যালকোহল টলারেন্স লেভেল খুবই হাই। একদম হার্ড লিকার খাই আমি, তাতেও কিসসু হয় না।"
"আচ্ছা বুঝলাম যে তুমি মহা তালেবর লোক। কখন যাবে তাহলে বলো।"
"তুমি তৈরী হয়ে বসে থেকো। আমি ন’টা থেকে সোয়া ন’টার মধ্যে তোমাকে পিক করবো তোমার ডর্ম থেকে।"
"আমাকে পিক করবে মানে? কিভাবে পিক করবে? তোমার তো গাড়ী নেই। সাথে গাড়ী থাকলেই না লোকে পিক করার কথা বলে।"
"আমার সাথে আমার এক বন্ধুও যাবে। তারই গাড়ী। কাল রাতে আমরা একটা বিশেষ নাইটক্লাবে যাবো। একটু দূরে সেটা। একদম ওয়াইকিকি বীচের উপরে। একটা ফাইভ-স্টার হোটেলের পঁচিশ তলায়। নাইটক্লাবটি একটু ক্ল্যাসি। আজেবাজে লোকেরা যায়না সেখানে। কাভার চার্জও বেশ বেশী।"
"কাভার চার্জ আবার কি?"
সুজাত আমাকে সবক দেয়।"নাইট ক্লাবে ঢুকতে গেলে একটা ফি চার্জ করে ওরা। তাকেই বলে কাভার চার্জ। তবে তুমি যেহেতু প্রথম বারের মতো যাচ্ছ, তাই তোমার কাভার চার্জটি কালকে আমিই দিয়ে দেব। পরের বার নাহয় তুমি দিও।"
"পরের বার মানে?"
সুজাত হাসে। "কে জানে? তুমি হয়তো জায়গাটি পছন্দও করতে পারো। ইন দ্যাট কেইস, তুমি হয়তো পরে আবার ওখানে যেতে চাইবে।"
মনের মধ্যে কু-চিন্তা খেলে গেল। সুজাতের মতলবটা কি আসলে? ও কি আমাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে কিছু খাইয়ে দেবে নাকি?
যাবার আগে সুজাত বলে গেলো, "ও ভালো কথা-যেহেতু এই নাইট ক্লাবটি খুবই ক্ল্যাসি, ভাল জামাকাপড় পরো কিন্তু। শর্টস আর স্যান্ডেল পরে গেলে ওরা কিন্তু ভিতরে ঢূকতে দেবে না।"
এখানে বলে রাখা ভাল যে হনলুলুতে লোকে খুবই ইনফরম্যাল জামাকাপড় পরে। শর্টস আর হাওয়াই চপ্পলই হচ্ছে বেশীর ভাগ লোকের পোশাক। শুধুমাত্র অল্পকিছু পেশার লোকেরাই নিয়মিত স্যুট-টাই পরে। এখানে যদি কেউ একটু ফরম্যাল পোশাক পরে তাহলে ধরেই নেওয়া হয় যে এই গাধা নিশ্চয়ই ট্যুরিস্ট। "কামাআইনা" (হাওয়াইয়ান ভাষায় এর অর্থ হচ্ছে স্থানীয় বা দেশী) হলে তো এই পোশাক পরার কথা না।
যাই হোক, ঘটনার দিন সন্ধ্যেবেলাতেই ডিনার খেয়ে নিলাম। তারপর স্যুটকেস খুঁজে একটু ভাল জামা-কাপড় পরলাম। তার মানে স্যুট-টাই নয় (অর ও জিনিস আমার ছিলোও না)। রেগুলার প্যান্ট-শার্টই।
ঘরে বসে টিভি দেখছি। ঠিক ন'টার সময় ফোন বাজলো। সুজাত।
"আমি ডর্মের নীচে আছি। নেমে এসো।"
"আসছি।"
সাধারণতঃ সুজাতকে আমি দেখেছি জীনস্ আর টীশার্ট পরা অবস্থায়। এখন তো দেখি বাবু বেশ মাঞ্জা মেরেছেন। অবশ্য খুব বেশী না। আমারই মতো জামা-কাপড়। তাতেই তাকে বেশ ভালই লাগছে।
"কই তোমার গাড়ীওয়ালা বন্ধু কই?"
"বাইরে রাস্তায় ওয়েট করছে। চলো যাই তাহলে।"
"চলো।"
ডর্মের সামনের রাস্তায় গাছটির নীচে একটি গা• রঙ্গের গাড়ী। সুজাত সামনে গিয়ে দরজা খুললো। গাড়ীর ভিতরের বাতিটি জ্বলে উঠলো সাথে সাথে। ড্রাইভিং সীটে বসে থাকা মানুষটি আমার দিকে ঘুরে তাকায়।
তাকে দেখে আমি ভূত দেখার মতো চমকে উঠি। মানুষটি আর কেউ না, আমাদের সবার অতি পরিচিত জনাব জংগী ফতোয়াবাজ নাঈম।
নাঈমও আমাকে দেখে একটু যেন ফ্যাকাশে হয়ে যায়।
আমিই আগে সামলে নেই। একটু হেসে বলি, "সালাম আলাইকুম, নাঈম। ইটস গুড টু সী ইউ।"
"ওয়ালাইকুম আস সালাম। এসো-ভিতরে এসো।"
সুজাত আমাদের কাজ-কারবার দেখে অবাক হয়। "ইউ গাইজ নো ইচ আদার?"
"হ্যাঁ-মসজিদে দেখা হয়েছে আমাদের।"
গাড়ী চলছে আস্তে আস্তে। আমরা সবাই চুপ করে আছি। কিছূক্ষণ পর অকস্মাৎ সুজাত হো হো করে হেসে ফেলে। আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকাই। কি হোল আবার?
সুজাত হাসতে হাসতে বলে, "ও-ইট ইজ সো ফানি। আমি দুই মসজিদ-পীপলকে নিয়ে নাইটক্লাবে যাচ্ছি। আমি শিউর উইল গো টু হেল ফর দিস।"
(বাকী অংশ পরের পর্বে)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


