আজ ৮ মার্চ । তারিখের বিবেচনায় এ দিনটি হয়ত তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন নয়। কিন্তু আজ সকালে যে চরম বাস্তব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলাম তাতে হয়ত এ দিনটি সারাজীবন আমার দুঃস্বপ্নের স্মৃতির পাতায় অমলিন হয়ে থাকবে ।
এ রকম ঘটনা অনেকেই হয়ত মাঝেমধ্যে পত্রিকায় পড়ে থাকবেন । আমিও অনেকবার পড়েছি, কিন্তু বাস্তবে এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হব আগে ভাবিনি । যাই হোক, আর কথা না বাড়িয়ে শুরু করছি ।
আজ সকাল সোয়া দশটার দিকে গিয়েছিলাম ইস্টার্ন প্লাজায়[অফিস সাইট] । উদ্দেশ্য পিসিতে একটা সফটওয়্যার সেট-আপের সমস্যা দূর করা । যাই হোক, আর সবার মত উঠে পড়লাম লিফটে । প্রায় ১২-১৫ জন মানুষ ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে আছি । আমার হাতে আবার সি.পি.ইউ । বেশ কষ্ট হচ্ছিল । তবু ভাবছিলাম, আর তো মাত্র মিনিটখানেকেরই ব্যাপার ; লিফট থেকে নেমে পড়লেই শান্তি । এসব ভাবতে ভাবতেই লিফট গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে যাত্রা শুরু করলো ।
কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই বাঁধলো বিপত্তি । কারেন্ট গেলো চলে । আর যায় কোথায় ! সবার মধ্যেই একটা অনাকাঙ্খিত আশঙ্কা মনের অজান্তেই চেপে বসল । তবুও ইস্টার্ন প্লাজা বলে কথা ! জেনারেটর তো আছেই, চিন্তা কি! আমাদের সাথে লিফটের মধ্যে একজন গার্ড ও একজন লিফটম্যান ছিলেন । তারা এমন একটা ভাব করতে লাগলেন যেন কিছুই হয়নি । মিনিটখানেকের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে । জেনারেটর অন হল বলে ...
কিন্তু বিধিবাম! জেনারেটর চালু নেই, তার উপর লিফট সাপোর্ট দেবার মত এনার্জিও নাকি নেই ! বাহ, দারুন - এমন মন্তুব্য করলেন অনেকেই । এই সংবাদ জানার পর লিফটম্যান তার করুণ কন্ঠে তারই সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করতে লাগলেন । কিন্তু মনে হচ্ছিল, এত ক্ষুদ্র কন্ঠের আওয়াজ বাইরের মানুষগুলোর কানে পৌঁছাচ্ছে না ।
বেশ কিছুক্ষণ চিৎকারের পর বাইরে থেকে সাড়া পাওয়া গেল । কিন্তু লিফটের লোকেশন ঠিকমত অনুমান করা বেশ কঠিন কাজ ছিল । তার উপর ইস্টার্ন প্লাজার এই অংশটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল - গ্রাউন্ড ফ্লোরের পর একেবারে ফিফথ ফ্লোরে অর্থাৎ ছয়তলায় গিয়ে থামে । কারণ, বাকি ফ্লোরগুলোতে মার্কেট থাকার কারণে সেগুলো বন্ধ ।
এদিকে আমরা অর্থাৎ আটকে পড়া মানুষগুলো একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছি । কেউ মোবাইলে বাইরে স্বজনদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে যাচ্ছেন, কেউবা ইস্টার্ন প্লাজার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের চোদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করছেন, কেউ ভেঙে পড়েছেন চরমভাবে । আমার একদম বামপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি যখন বলল, "ভাই প্লিজ, আমাকে বাঁচান । আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে " - তখন মনে হল, আজকেই হয়ত আমার জীবনের শেষ দিন । বিধাতা হয়ত এভাবেই আমার মৃত্যু লিখে রেখেছেন । নইলে কেনই বা আমি আজ এভাবে লিফটে বন্দী ।
সবার কথা খুব মনে পড়ছিল । মনে পড়ছিল আমার প্রিয় মানুষগুলোর কথা । খুব ইচ্ছা হচ্ছিল, ফোন করার । তবু অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করলাম । জানতাম, ফোন করা মাত্রই ওরা পাগলের মত ছোটাছুটি শুরু করবে, কান্নাকাটি করবে । খুব কষ্ট হচ্ছিল ওদের কথা ভেবে। মনে মনে সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছিলাম - বন্ধু, শুভানুধ্যায়ী, আপনজন, পরিচিত...সবার কাছ থেকে। বলছিলাম, "ক্ষমা করো বন্ধু । অনেক কষ্ট দিয়েছি তোমাদের, কখনোই দিতে পারিনি কিছুই..."
আরো কষ্ট হচ্ছিল, যখন দেখলাম আমার পাশের দুজন বসে পড়েছেন লিফটের ফ্লোরে । একজনকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন ওনার শ্বাস-কষ্ট হচ্ছে । বাকিরা খুব ঘামছেন । আমি আমার পাশে দাঁড়ানো এক ভাইয়ার সাথে কথা বলছিলাম আর জানছিলাম তার পূর্ব কিছু অভিজ্ঞতার কথা। অনেক কষ্টে আর জোর করে নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করাই ছিল যেন ছিল নিজের সাথে নিজের অভিনয় ।
এরই মধ্যে কখন যে প্রায় মিনিট বিশেক হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। ইতোমধ্যে লিফট কন্ট্রোল রুম এবং উদ্ধারকর্মীদের সহায়তায় লিফট এক ইঞ্চি-এক ইঞ্চি করে ওঠা শুরু করেছে । এর কিছুক্ষণের মধ্যেই কন্ট্রোল রুম এবং উদ্ধারকর্মীদের সহায়তায় লিফটের দরজা কিছুটা খোলা গেলো । সবাই যেনো কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো ।
তবুও আরেকটা ভয় কাজ করছিল সবার মাঝে । লিফট ছিড়ে পড়বে না তো! যাই হোক, স্রষ্টার অসীম করুণায় আরো মিনিট দশেকের চেষ্টায় অবশেষে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হলাম । লিফটের দরজার চারদিকে তখন কৌতুহলী জনতার ভিড় । মনে হচ্ছিল যেন নতুন জীবনের স্বাদ নিচ্ছি । আর প্রার্থনা করছিলাম যেন এমন দুঃস্বপ্নময় মুহুর্ত যেনো কারও জীবনে না আসে ।
আরও কিছু বাস্তব, দুঃখজনক হলেও সত্য উপলব্ধি হল আমাদের এইসব স্বনামধন্য কিছু প্রতিষ্ঠানের অব্যবস্থাপনা আর অদক্ষতা দেখে । লিফটের মত একটা অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস যেখানে ডেডিকেটেড [ভালো বাংলা শব্দ পেলাম না ] হওয়া উচিত, অর্থাৎ এর এমার্জেন্সি সিস্টেমটা এমন হওয়া উচিত যেন এমন অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি না ঘটতে পারে - সেদিকে কর্তৃপক্ষের কোন নজরই নেই । বিদ্যুত যেতে পারে এই আশংকায় যদি জেনারেটরের ব্যবস্থা রাখা হয়, তাহলে প্রয়োজনের সময় সেগুলো অন পাওয়া যায় না কেন??? আর এসব কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের প্রয়োজনের সময় কেন পাওয়া যায় না ??? শুধু শুধু বেতন দিয়ে তাদের রাখার কোন যুক্তিই আমি খুঁজে পাই না । জানিনা এসব প্রশ্নের উত্তর আদৌ পাওয়া যাবে কি না । হয়ত সাময়িক কিছুদিনের জন্য ব্যবস্থাপনা বেশ জোরদার করা হবে, কিন্তু তারপর??? আবারো বহুদিন বাদে দেখা যাবে এমনই কোন অনাকাঙ্খিত ঘটনা [প্রার্থনা করি যেন আর না ঘটে...] আর কত??? এর কি কোন উত্তর নেই?
জানিনা কতদিন বাদে আবারো ব্লগিং করছি । ব্লগিং ভালোবাসি বিধায় হয়ত সেই ভালোবাসার টানে আবার রাত জেগে লিখতে শুরু করেছি । সামনে আবার পরীক্ষা । পড়াশুনা সব শিকেয় উঠেছে । জানিনা আবার কবে বসব ব্লগিং-এ। সবাই ভালো থাকবেন । শুভ রাত্রি ।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মার্চ, ২০১০ রাত ৩:১৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



