আর একটু হলেই ময়লা চাদরটা এসে লাগতো জয়িতার গায়ে। লাগলো না। তবু ওর মুখের অস্ফুট বিরক্তির আওয়াজটা ভেসে এল বেশ জোরেই।
- উফফ! অসহ্য! রাস্তাঘাটে এইসব পাগলগুলো যে কোত্থেকে জোটে! কথা নাই বার্তা নাই, গায়ের উপর এসে পড়বে, যত্তসব ডিজগাস্টিং।
- আহারে, এত ক্ষেপছিস কেন? পাগলটাতো তোকে ইচ্ছে করে ছুঁয়ে দিতে যায়নি।
- যাই বলিস, আমি এখন এই ড্রেস পরে কিভাবে স্যারের ব্যাচে যাব? আমার খুব অস্বস্তি লাগছে। আমি এখন বাসায় ফিরে যাচ্ছি, তুই বরং চলে যা।
শম্পা আর কথা বাড়াল না। সেই ক্লাস ফাইভ থেকে জয়িতাকে চেনে ও। একদম ওর মায়ের ডুপ্লিকেট কপি। একবার যদি কিছু "না" বলেছে, তো ওই কাজ সে দ্বিতীয়বার করবেই না। বাধ্য হয়েই বলল,
- ঠিক আছে জয়ি। আমি একাই যেতে পারবো। তুই সাবধানে যাস। বিকেলে ফোন দিস। কথা হবে।
----------------------------------------------------------------------------
টিং টং, টিং টং । কলিংবেলটা বেজেই চলেছে। দ্রুত পায়ে দরজার কাছে ছুটে এল লাবণ্য।
- কে?
- মা, আমি জয়ি।
- দাঁড়া, খুলছি।
দরজা খুলে বেশ অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন লাবণ্য ।
- কিরে? তোর তো এখন স্যারের কোচিং-এ থাকার কথা। চলে এলি কেন? কি হয়েছে? আমাকে বল।
- আর বলো না মা, মেজাজটা খুব খারাপ। স্যারের কোচিংয়েই যাচ্ছিলাম। গলির মুখেই আচমকা এক পাগল এসে গায়ের উপর পড়ল।
- কি বলিস?
- এই যে দেখো, আমার এত সুন্দর ড্রেসটার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে।
- কই দেখি? কই? কিছুইতো লাগেনি।
- দূর! তুমি মোটেই দেখতে পাওনা। যাও!
- হা হা! বুঝেছি। কোচিং ক্লাসে না যাওয়ার নতুন ফন্দি বের করছো, তাই না?
জয়িতা আর কিছুই বলল না। এখন তার মেজাজ আগের চেয়ে বেশি খারাপ। চুপ করে নিজের ঘরে চলে গেল সে।
-------------------------------------------------------------------------------
জয়িতা এ দুদিন কোচিং, ক্লাস - কোথাও যায়নি । নাহ, ও ফাঁকি দেয়নি। ওর খুব জ্বর গত কয়েকদিন ধরেই। লাবণ্য সারাক্ষণ মেয়ের মাথার কাছে বসে থাকে। মেয়েটার জ্বর কমছেই না। এত ওষুধ-পথ্য খাওয়ানোর পরেও উন্নতির লক্ষণ খুব সামান্য। এ কদিন ধরে তাই তারও খুব মন খারাপ। জয়িতা এখন ঘুম। আর লাবণ্য বসে বসে নানা রকম ভাবছে। হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠলো। ঘুমটা ভেঙে গেলো জয়ির।
- মা, দেখোতো এই আন-টাইমে কে ফোন দেয়?
- দাঁড়া দেখছি। মনে হয় শম্পা।
-উফফ, ফোন দেওয়ার আর সময় পায়না।
লাবণ্য মোবাইলটা হাতে নিতেই দেখলেন কলিং নাম্বারটা শম্পার।
- হ্যাঁ, হ্যালো, কে? শম্পা বলছো?
- জ্বী, আন্টি, স্লামালাইকুম। কেমন আছেন?
-এই তো, তুমি কেমন আছো?
-জ্বী ভালো। জয়িকে দেখিনা অনেকদিন। ও তো অনেকদিন কলেজে আসেনা, কোচিংয়েও দেখিনা। ওর কি শরীর খারাপ?
- হমম, গত কয়েকদিন ধরে ওর খুব জ্বর। এই নাও, ওর সাথে কথা বল।
ফোনটা জয়িতার দিকে বাড়িয়ে দিলেন লাবণ্য। এতক্ষণে ঘুম কিছুটা ভেঙেছে ওর।
- হ্যাঁ, বল ।
- কিরে, তোর নাকি খুব জ্বর?
- হমম।
- কবে থেকে?
- এইতো সপ্তাহখানেক।
- তুই একটাবার আমাকে ফোন দিয়ে বলবি না! অবশ্য তোর দোষ দিয়ে কি হবে? দোষ আমারই। আমি এ কয়েকটা দিন বেশ ব্যস্ত ছিলাম। তোর খোঁজও নিতে পারিনি।
- এখন কি এসব দোষ-গুণ আলোচনার জন্য ফোন দিয়েছিস?
- আরে নাহ, তোকে একটা মজার কাহিনী বলার জন্য ফোন দিয়েছি। শুনবি?
- কি কাহিনী? বলবি তো ...
- ওই পাগলটার কথা মনে আছে তোর? ওই যে সেদিন রাস্তায় ... তুই খুব ক্ষেপে গেছিলি ...
- হমম, মনে আছে। তো কাহিনী কি হয়েছে সেটা বল না আগে ...
- জানিস, ওই পাগলটা আজ একটা অদ্ভুত মজার কান্ড করেছে।
- কি করেছে বল না ...
- আমাদের ক্লাসের বি সেকশনের প্রিয়াংকাকে চিনিস?
- হমম, তো ...
- ওই পাগলটা কোত্থেকে একটা গোলাপ ফুল ছিঁড়ে এনেছিল আর সেটা দূর থেকে প্রিয়াংকার দিকে ছুঁড়ে মেরেছে এবং কি বলেছে জানিস? শুনলে তুই অবাকও হবি আবার হাসতে হাসতে মরেও যাবি ...
- কি বলেছে? বল না ...
- বলেছে, "মৃন্ময়ী, প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না....প্লিজ " ... আমরা যারা তখন পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম হাসতে হাসতে শেষ আর প্রিয়াংকাতো রাগে, লজ্জায় শেষ। সারাপথ আমরা ওকে ওই একটা কথাই বলতে বলতে এসেছি ... "মৃন্ময়ী, প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না....প্লিজ " ... আর ও তো ক্ষেপে 'এই মারে তো সেই মারে' অবস্থা।
- হা হা হা হা হা হা হা ... ও মাগো ...হাসতে হাসতে বোধ হয় মরেই যাব ...
- হমমম, আমার তো যখন মনে পড়ছে তখনই হাসছি ...
- এই শোন, আমার এখন ওষুধ খাওয়ার সময় হয়ে এল। আমি রাখছি। পরে কথা হবে রে। বাই ...
- ওক ... বা...ই
এতক্ষণ পাশে বসে খবরের কাগজের পাতায় চোখ বোলাচ্ছিলেন লাবণ্য। জয়িতার ফোন রাখা দেখতেই একটু নড়ে চড়ে বসলেন তিনি।
- কিরে, কি বলে শম্পা? এত হাসছিলি কেন? কি হয়েছে?
- আর বলো না মা ,... ব্যাপারটা চিন্তা করতেই এমন হাসি আসছে ...
- কি হয়েছে বলবি তো?
- শম্পা বললো, আজ একটা মজার ঘটনা ঘটছে। ওই যে একদিন তোমাকে একটা পাগলের কথা বলেছিলাম না ... যে পাগলটা আমার গায়ের উপর পড়ছিলো আর একটু হলেই ... ওই পাগলটা আজ আমাদের বি- সেকশনের একটা মেয়েকে গোলাপ ফুল দিয়েছে আর বলেছে, "মৃন্ময়ী, প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না....প্লিজ " ... প্রিয়াংকা তো পুরো ক্ষেপে আগুন ... হা হা হা হা ... খুব মজার ঘটনা, তাই না মা বলো?
আচমকা এত বছর পর সেই পুরনো নামে পুরনো ছন্দের ডাক শুনতে পেল লাবণ্য। সেই অতি পরিচিত, অতি চেনা সুর, সেই মায়াবী মুখখানি যে সে আজও ভোলেনি। হাতটা কেঁপে উঠলো ওর। কে এই পাগলটা? এই কি তবে আমার হারিয়ে যাওয়া অনির্বাণ। বুকটা কেঁপে উঠল তার।
- কি হয়েছে মা? শরীর খারাপ লাগছে তোমার?
- না সোনামনি, এমনি ...
------------------------------------------------------------------------------
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল লাবণ্য। একে একে সেই পুরনো স্মৃতিগুলো রোমন্থন করে চলল সে। সেই বিশ বছর আগের কথা। এক নিঃশব্দ নিভৃতচারীর আগমন ঘটেছিল তার জীবনে। একে একে তার জীবনের সাদাকালো পাতাগুলোকে সে চেয়েছিল রঙে রঙে ভরিয়ে দিতে। হয়ত পেরেছিল কিছুটা, হয়ত পারেনি।
সত্যিকারের ভালোবাসার সংজ্ঞা জেনেছিল ও। ছেলেটি এমন কেউ ছিল না, ছিল খুবই সাধারণ। ভালোবাসতো গান গাইতে, ছবি আঁকতে, গল্পের বই পড়তে। খুব মাতিয়ে রাখতে পারতো ও। গলির মুখে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত ঘন্টার পর ঘন্টা। আশেপাশের দোকানীরা অবাক চোখে দেখতো, কেউবা হাসি-তামাশা করত, কিন্তু কিছুতেই ভ্রুক্ষেপ ছিল না তার। সে ছিল খুব অভিমানী। নিজেকে কষ্ট দিত। এসেছিল কাঁদতে, কাঁদাতে ... তারপর সেই দুর্ঘটনা ... সবাই এতদিন জানত সব শেষ। নীরবে শুধুই চোখের জল ফেলেছে লাবণ্য। এরপর একদিন পরিবার, সমাজের চাপে বাধ্য হয়েই বিয়ের পিঁড়িতে বসা ...
ব্লগিং-এর দুনিয়াটা চিনিয়েছিল এই লাবণ্যই। এখন অবশ্য ব্লগিং ছেড়েই দিয়েছে লাবণ্য। শেখর এগুলো একদমই পছন্দ করেনা। ধীরে ধীরে সব ভুলে যেতে চেয়েছিল লাবণ্য। কিন্তু আজ? কি শুনলো সে? তাকে তো আজ যেতেই হবে ...
কাউকে কিছু না বলেই বাসা থেকে হঠাৎ বেরিয়ে পড়ল লাবণ্য। ঠিকানাটা আজও উজ্জ্বল তার মনের গভীরে। এতদিন শুধু এই রাস্তাগুলো, এই সরু গলিগুলো এড়িয়ে চলেছে সে। কিন্তু আজ কিসের টানে সে ছুটে চলেছে সেই পুরনো পথে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। দূর থেকে আবছা একটা ছায়ামুর্তি দেখতে পেল সে। সেই পুরনো বৈদ্যুতিক খুঁটির নিচে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে অবিচল একটা কঙ্কালসার রুগ্ন মানুষ। কিছুক্ষণ পর পর ছেঁড়া চাদরটা ঠিক করছে সে। আর ঘড়ি দেখার মত ভাবে কি যেন দেখছে হাতে, যদিও সেদিনের সেই ঘড়ি আজ আর তার হাতে নেই। চেহারায় যেন এক রুক্ষতার ছাপ।
- অনির্বাণ ... আজও দাঁড়িয়ে আছ তুমি?
কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তর পেল না সে। লাবণ্য একদম কাছে এসে ডাকলো ওকে, "অনির্বাণ ..." । এবার ছায়ামুর্তিটা ঘুরে দাঁড়াল। তার চোখে চরম জিঘাংসার চিহ্ণ। কি বিকট তার রূপ! তবুও লাবণ্য সাহস হারালো না।
- অনির্বাণ ... চেয়ে দেখো আমি এসেছি । আমাকে চিনতে পারছো না তুমি?
- কে আপনি? আমি আমার মৃন্ময়ীর জন্য এখানে দাঁড়িয়ে থাকবো। তাতে আপনার কি? যান, যান, নিজের কাজে যান ।
শব্দগুলো কাঁটার মত এসে বিঁধল লাবণ্যের বুকে। অনির্বাণ এখন পাগল - এই বাস্তবতা কি মেনে নিতে পারবে সে? এক বুক যন্ত্রনা সঙ্গী করে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ফিরে চলল সে। এটাই কি তবে নিষ্ঠুর নিয়তি?
[ এই গল্পের প্রতিটি চরিত্রই কাল্পনিক। কারো সাথে মিলে গেলে তা কাকতলীয় মাত্র, কর্তৃপক্ষ দায়ী নয় ]
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১০ রাত ১১:৪৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



