‘বয়লিং ফ্রগ’ সিনড্রোম একটা জনপ্রিয় মেটাফোর। একটা ব্যাঙকে যদি আপনি একটি পানি ভর্তি পাত্রে রাখেন এবং পাত্রটিকে উত্তপ্ত করতে থাকেন তবে ব্যাঙটি পানির তাপমাত্রার সাথে সাথে নিজের শরীরের তাপমাত্রা ভারসাম্যে রাখতে থাকে। পানির উত্তাপ বাড়ার সাথে সাথে ব্যাঙটিও নিজের সহ্য ক্ষমতা বাড়াতে থাকে, লাফ দিয়ে বেরোনোর পরিবর্তে। কিন্তু একসময় পানির প্রচন্ড তাপমাত্রা ব্যাঙের শরীর আর মানিয়ে নিতে পারেনা। পানির প্রচন্ড উচ্চতাপমাত্রা্র সমতায় নিজের শরীরের তাপমাত্রা সহ্য ক্ষমতা তার নিজসীমার বাইরে চলে যায়। এমত পরিস্থিতিতে তখন ব্যাঙটি ফুটন্ত পানির পাত্র থেকে লাফ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়তো নেয়। কিন্তু সে তখন আর লাফ দিতে পারে না, কেননা ততক্ষনে ব্যাঙটি তার সমস্ত শক্তি তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রনে ব্যায় করে ফেলেছে। অত:পর সে পানিতে সেদ্ধ হতে থাকে। ব্যাঙটির মৃত্যুর কারনটা কিন্তু আসলে গরম পানি না, বিপদজনক পরিস্থিতির শুরুতে সেই পরিস্থিতি অস্বীকার করে লাফ না দেয়াটা তার মৃত্যুর কারন।
আবরার ফাহাদ নামের বুয়েটের মেধাবী যে ছাত্র সম্প্রতি তারই সহপাঠীদের দ্বারা হত্যাকান্ডের শিকার হলেন সেটা এই সমাজের ‘বয়েলিং সিন্ড্রোমটা’কে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। গণমাধ্যমে সম্প্রতি যে সংবাদগুলো উঠে আসছে তাতে এটা পরিস্কার যে, এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে র্যা গিংযের নামে শিক্ষার্থী নির্যাতন নতুনকিছু নয়। বরং বছরের পর বছর পুনঃ পুনঃ চর্চায় তা যেন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। এর পেছনে ক্ষমতাশীনদের বেপরোয়া আচরণ আর সাধারণ ছাত্রদের সবকিছু সহ্য করে নেবার মানসিকতাই আবরার কিংবা মোমতাজের মৃত্যুর কারন। খুব সম্ভবত আমরাও ঐ ব্যাঙের মত মানিয়ে নিচ্ছি আমাদের চারপাশের সাথে। সহ্য করছি সব, আর ভাবছি টিকে তো আছি!
প্রত্যেকেরই জানা উচিত সে আসলে কে? কী তার উদ্দেশ্য? সমাজে একশ্রেনির মানুষ আছেন যারা উচু স্তরের কিছু ভাবে না, কোনো কিছুকেই গভীর করে অনুভব করেন না। জীবনের মানে না জেনেই কাটিয়ে দেন একটা জীবন। তবে তারা হরহামেশাই যেটা করেন, সেগুলোকে ভদ্র ভাষায় ‘স্থুল রসিকতা’ বলা যেতে পারে। অধিকাংশ মানুষই বেশিরভাগ সময় চলতি পন্থার দাসত্ব করে। অন্যের দেখিয়ে দেয়া পদ্ধতিতে জীবনযাপন করতে গিয়ে নিজের সত্যিকারের সত্ত্বাটা আর তাদের চেনা হয়না। সময় ভয়ানক প্রতারক, চলছে সুপরিচিত সুবিধাবাদীদের সুসময়। এভাবে চলতে থাকলে মানুষ একসময় মুখ খুলতে ভুলে যাবে।
ডিজিটালাইজ়েশনের এই যুগে বর্তমানটা বেশ আকর্ষনীয়। তরুনদের কাছে রয়েছে এমন প্রযুক্তি যা বিশ্বকে ক্রমাগত ছোট এবং দৃশ্যমান করে তুলেছে। দূরত্ব কমিয়ে সবাইকে পরস্পরের প্রতিবেশি করে দিয়েছে। সোস্যাল মিডিয়াতে তরুণরা যেমন তথ্য পাচ্ছে, সেই সাথে তারা তাদের যুক্তি, বার্তা, মতামতও প্রকাশ করছেন। স্মার্টফোনের স্ক্রিন হয়ে উঠেছে মতামত প্রকাশের জায়গা। তবে লেজুরবৃত্তিকদের জন্য ‘সহমত ভাই’ প্রকাশের মাধ্যম। আবরার ফাহাদ চলতি পন্থার মধ্যে থেকেও কিছু তথ্য তুলে ধরে ছিল সেটাই ছিলো তার অপরাধ। অন্তঃসারশূন্যদের মতো সে তার স্মার্টফোনটাকে সেলফি তোলার কাজে ব্যবহার করেননি।
আবরারকে হত্যা করলো তার সহপাঠীরা, ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে নিষ্ঠুরতার চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়তে আসা এই কয়েকজন শিক্ষার্থীও প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় পড়াশুনা করে বুয়েটে পড়তে এসেছে। তাদের পরিবার-পরিজন-প্রতিবেশি সবই আছে। তবে তারা কেন এমন আচরণ করলো? কারনটা আত্মগোপন করে আর নেই বরং দিনের আলোর মত পরিষ্কার যে, তারা ক্ষমতার দাপট দেখাতে সংঘবদ্ধভাবে অপরাধটা সংঘটিত করেছে। হীন আনুগত্য তাদেরকে চতুষ্পদী জন্তু করে তুলেছিল। হত্যাকারীরা দেখিয়ে দিয়েছে মানুষ যতটা উদার হতে পারে, তার থেকে শতগুন নিষ্ঠুর হতে পারে। আবরারের সাথে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা সমবেদনার চেয়েও মনোযোগ দাবী করে বেশি।
স্বভাবগত ভাবে অন্ধকার প্রিয় মানুষদেরকে চাইলেই সভ্য বানানো যায়না, জোর করেও না। জোর করলেই কী সব হয়? যদি মানুষ ছোটবেলা থেকে সামাজক মূল্যবোধের মধ্যে বড় না হয়। আজকালকার ছেলেমেয়েরা কি সময়ের বহু আগেই প্রাপ্তবয়স্কের স্বপ্ন ভংগের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে? সমস্যাকে দীর্ঘদিন জিয়িয়ে রাখাও এক ধরনের সমাধান। পুরনো রোগের মতো পুরনো সমস্যা নিয়ে কেউ-ই বেশিদিন শুনতে চায় না। জীবিতদের থেকে লাশগুলো এখন অনেক বেশি মানবিক, ক্ষমতার দখলদারিত্ব নিয়ে ঝগড়া করে না। চাওয়া-পাওয়ার সামান্য ব্যবধানে একটা আপিল বেঞ্চ আছে। পৃথিবীর সবথেকে শক্তিশালী জুরিবোর্ড, বিবেকের অবস্থান সেখানে। অথচ সেই বিবেককে আমরা ব্যবহার করছি নিরবতার পাহারাদার হিসেবে।
কমোডিটি ফেটিশিজমের এই যুগে চাহিদা আর জোগানের ঘেরাটপে আটকে গেছি। মূল্যের বিচারে প্রতিনিয়ত বড় হচ্ছে সবকিছু কেবল ছোট হই আমরা। চারপাশটা বড় দ্বান্দিক। সাদা না কালো, চা না কফি, ভোর না গোধূলী, পাহাড় না সমুদ্র। সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পৌঁছতে আমাদের বোধগুলো হারিয়ে যায় কিংবা ফুরিয়ে যায়। দিন শেষে শুন্যতা আর অসন্তোষ। সামাজিক চাপ আমাদের আমাদেরকে সহনীয়ভাবে সুখি হতে শেখাচ্ছে। জীবনের অসংখ্য স্ববিরোধীতা রয়েছে, রয়েছে যৌথ অভিজ্ঞতা। একজনের অন্যজনের প্রতি বাড়িয়ে দেয়া সাহায্যের হাত ফুটিয়ে তুলতে পারে মানবিক সৌন্দর্য্য। মানুষকে বিচার করতে শিখতে হবে মানবিক মূল্যবোধের নিরিখে। কান পেতে আছি কোন হ্যামিলিয়নের বাঁশি শুনবো বলে। কেউ কি ডাকে? কেউ কি ডাকবে?
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১ রাত ১২:৪৩