somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞান বিষয়ের জনক এ কে নাজমুল করিমের ৩৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

১৮ ই নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞানচর্চার অগ্রদূত প্রফেসর ড. এ. কে. নাজমুল করিম। তিনি বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞান বিষয়ের জনক হিসেবে পরিচিত। প্রফেসর এ কে নাজমুল করিম ১৯৪০ এর দশকের মধ্যভাগ থেকে ১৯৬০ এর দশকের প্রায় শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে যে বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন, সাংস্কৃতিক মুক্তির আন্দোলন হয়েছে তার অন্যতম পুরোধা পুরুষ ছিলেন। তিনি সমাজ-সংস্কৃতি-মানুষকে নিয়ে পদ্ধতিগতভাবে চিন্তা করার নিরলস প্রয়াস পেয়েছিলেন এবং সেই চিন্তাকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে খ্যাতির সঙ্গে পৌঁছে দিতে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি এমন একজন সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, যার চিন্তা ও চেতনা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি থেকে শুরু করে উপমহাদেশীয় সমাজের মাঝে ঘটে যাওয়া প্রায় সব কর্মকাণ্ড সম্পর্কেই ছিল সদাজাগ্রত। এটি বলা অত্যুক্তি হবে না, একজন বুদ্ধিজীবী বা সমাজবিজ্ঞানীর সবচেয়ে বড় দায় সম্ভবত তার সময়কালকে যথার্থভাবে তুলে ধরতে পারা। আপাতদৃষ্টিতে কাজটি সহজ মনে হলেও এই কাজটি আমাদের দেশের হাতেগোনা কয়েকজন বুদ্ধিজীবী যথার্থ পদ্ধতি অনুসরণ করে যেতে পেরেছেন। নিজ সমাজের কৃষ্টি ঐতিহ্যের ওপর গভীর ধারণা ও স্বচ্ছ জ্ঞান না থাকলে তা কলমে তুলে আনা যায় না। প্রফেসর করিম তা পেরেছিলেন। দেশী-বিদেশী পত্রপত্রিকায় তাঁর প্রচুর সংখ্যক সমাজতত্ত্ববিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও তিনি ইবনে রশীদ ছদ্মনামে গবেষণাপত্র, বই এবং ছোটগল্প লিখতেন। নাজমুল করিম এদেশে সমাজবিজ্ঞানের জনক এবং উপমহাদেশের একজন অগ্রগণ্য সমাজচিন্তাবিদ হিসেবে পরিচিত। শিক্ষায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ২০১২ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করে। প্রফেসর ড. এ. কে. নাজমুল করিমের ৩৭তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৮২ সালের আজকের এই দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞানচর্চার ধ্রুপদী ঐতিহ্য এ কে নাজমুল করিমের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।


১৯২২ সালের ১ আগস্ট তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পূর্ব বাংলার নোয়াখালী জেলার লক্ষ্মীপুরে জন্মগ্রহণ করেন জনাব নাজমুল করিম। তার পৈতৃক নিবাস ছিল কুমিল্লা জেলার ফাল্গুনকরা গ্রামে। তার পিতা আবু রশীদ নিজামউদ্দিন মাহমুদ এবং মাতা মোসাম্মৎ শামসুন নেছা খাতুন। তিনি তার পিতামাতার আট সন্তানে মধ্যে সপ্তম। তার পিতার পরিবারে দেওয়ান ও ম্যাজিস্ট্রেট ছিল এবং তার মা জমিদার পরিবার থেকে এসেছেন। নাজমুল করিম ১৯৩৯ সালে ঠাকুরগাঁও ইংরেজি হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাস করেন। পরে ১৯৪১ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৪৪ সালে নাজমুল করিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বি.এ. (অনার্স) ও ১৯৪৬-এ এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। এর পর তিনি পূর্ব পাকিস্তান রাজ্য বৃত্তি লাভ করেন এবং উচ্চ শিক্ষার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সুযোগ পান। করিম প্রথমে ফেনি কলেজ এবং ঢাকা কলেজে লেকচারার হিসেবে পাঠদান করেন। ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনা করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরকার ও সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে আলাদাভাবে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৫৭ সালে ১৯ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত সমাজবিজ্ঞান বিভাগে লেকচারার পদে যোগ দেন এবং পরে চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ভালো ফলাফলের কারণে নজমুল করিম ১৯৬৪ সালে রকফেলার বৃত্তি পেয়ে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে ডক্টরেট করার সুযোগ পান। সেখানে তিনি টি বি বটমোরের অধীনে ডক্টরেট করেন। তার থিসিসের শিরোনাম ছিল "দ্য মডার্ন মুসলিম পলিটিক্যাল এলিট ইন বেঙ্গল", যা পরে ১৯৮০ সালে আরও বৃহৎ পরিসরে "দ্য ডাইনামিক্স অব বাংলাদেশ সোসাইটি" শিরোনামে বিকাশ পাবলিশিং হাউজ প্রাইভেট লিমিটেড থেকে প্রকাশিত হয়। আলোচ্য গ্রন্থটি ছাড়াও তিনি The Dynamics of Bangladesh Society ও ‘সমাজ-সমীক্ষণ’ (১৯৭২) নামে একটি পাঠ্যবই রচনা করেন। তিনি ১৯৮২ সালে অধ্যাপকরূপে অবসর গ্রহণ করেন। একুশে পদক ছাড়াও করিম ১৯৮৩ সালে র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কারের মনোনয়ন লাভ করেন।


নাজমুল করিম ছিলেন অসাধারণ সমাজ সচেতন, সমাজ নিরীক্ষক- বস্তুত একজন সমাজ-দার্শনিক। বলা চলে, বাঙালি মুসলিম সমাজকাঠামো বিশ্লেষণে তিনিই অগ্রপথিক। তাঁর লেখা ‘দ্যা চেঞ্জিং সোসাইটি ইন ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান’ (পরে যার নাম হয় ‘দ্যা চেঞ্জিং সোসাইটি ইন ইন্ডিয়া, পাকিস্তান অ্যান্ড বাংলাদেশ’) আপাত দৃষ্টিতে একটি ছোট গ্রন্থ হলেও এটি অনুপুঙ্খভাবে পড়লে বোঝা যাবে, মুসলিম সমাজ বিন্যাস ও মুসলিম সামাজিক স্তর বিন্যাস সম্পর্কে তার পর্যবেক্ষণের কি অসীম গভীরতা রয়েছে। তাঁর ‘ডিনামিকস অব বাংলাদেশ সোসাইটি’ গ্রন্থটিও অমূল্য। তিনি যে গবেষক হিসেবে খুব বড় ছিলেন তাই নয়, তিনি তার অনেক ছাত্রকেও সমাজ মানস ও জীবন অন্বেষায় জীবনের নিহিতার্থ তুলে ধরার ব্যাপারেও অনুপ্রাণিত করেছেন। তাঁর সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষ এখনো ভালোভাবে জানে না। তাঁর অবদানও জানে না। তাঁর যথার্থ পরিচয় বাঙালির কাছে তুলে ধরার কাজটি এখনো অসমাপ্ত রয়ে গেছে। ব্যাক্তিগত জীবনে নাজমুল করিম সৈয়দা জাহানারা বেগমের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। জাহানারা বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তাদের তিন কন্যা - শেহেরনাজ ইয়াসমিন, শাহনাজ নাসরিন এবং লামিয়া নাজনিন। সমাজবিজ্ঞানের জনক এবং উপমহাদেশের একজন অগ্রগণ্য সমাজচিন্তাবিদ হিসেবে সুপরিচিত নাজমুল করিম ১৯৮২ সালের ১৮ নভেম্বর বহুমূত্র রোগের কারণে সৃষ্ট জটিলতায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৬০ বছর। আজ তাঁর ৩৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞানচর্চার ধ্রুপদী ঐতিহ্য এ কে নাজমুল করিমের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।

নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:৩৩
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×