বাংলাদেশের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী আঞ্জুমান আরা বেগম। "এমন মজা হয়না গায়ে সোনার গয়না বুবুমনির বিয়ে হবে বাজবে কত বাজনা .."এমনি অনেক জনপ্রিয় গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। আকাশের হাতে আছে এক রাশ নীল, বাতাসের আছে কিছু গন্ধ। রাত্রির গায়ে জ্বলে জোনাকী তটিনীর বুকে মৃদু ছন্দ। গানটির সুর, কথা এবং গায়কী যে কারো মনে নাড়া দেয় এখনও। জনপ্রিয় এই গানটির শিল্পী ছিলেন বরেণ্য কন্ঠশিল্পী আঞ্জুমান আরা বেগম । চলচ্চিত্রের চিরসবুজ এমন অনেক গানই নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা এখন গাইছেন। আঞ্জুমান আরা বেগম মূলত ষাটের দশকে সংগীত শিল্পী হিসেবে প্রবল জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তিনি চলচ্চিত্র, টেলিভিশন এবং মঞ্চের অসংখ্য জনপ্রিয় গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। ষাট দশকের শুরুতে যখন টেলিভিশন ছিল না, তখন আঞ্জুমান আরা বেগম রেডিওতে প্রতিমাসে তিনটি অনুষ্ঠান করতেন। প্রতি অনুষ্ঠানে তিনি সকাল, বিকাল ও রাতে শ্রোতাদের জন্য আধুনিক, নজরুল সংগীত, লোকগীতি, সেমি-ক্লাসিক্যাল, দেশাত্মবোধক, গজল ও গীতের ডালি নিয়ে আসতেন। সেই সময় তিনি চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক শুরু করেন। তার গাওয়া চলচ্চিত্রের অনেক গান দ্রুত শ্রোতাদের হৃদয়ে রেখাপাত করে। একই সাথে উর্দু চান্দা চলচ্চিত্রের ;চান্দনী ভিগি ভিগি হাওয়া; প্রচুর শ্রোতাপ্রিয় হয়। গত চার দশকে বাংলা চলচ্চিত্রের অসংখ্য কালজয়ী ভালোবাসার গান রয়েছে। ১৯৬৪ সালে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত প্রথম গানে কণ্ঠ দেন। সঙ্গীতে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ২০০৩ সালে একুশে পদকে ভূষিত করে। ২০০৪ সালের আজকের দিনে তিনি ঢাকার বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। আজ তার ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী আঞ্জুমান আরা বেগমের মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
আঞ্জুমান আরা বেগম ১৯৪২ সালের ১১ জানুয়ারি বর্তমান বাংলাদেশের (তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত) বগুড়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ডা. নাসিরউদ্দিন তালুকদার মুক্তিযোদ্ধাদের ঔষধ সরবরাহ ও আশ্রয় দেয়ার অভিযোগে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী আর্মীরা গ্রেফতার করে মেরে ফেলে। তার মাতার নাম জিয়াউন্নাহার তালুকদার। দুই ভাই এবং পাঁচ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। তাঁর বড়বোন জেব-উন-নেসা জামাল একজন গীতিকার ছিলেন এবং আরেক বোন মাহবুব আরা রেডিও ও টেলিভিশনের শিল্পী ছিলেন। সঙ্গীতশিল্পী জিনাত রেহানা তার ভাগ্নি এবং উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী রুনা লায়লা তার চাচাতো বোন। আঞ্জুমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন তাদের পরিবারের প্রত্যেক সদস্যই উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন। আঞ্জুমান আরা বেগম ১৯৫৮ সালে ষোল বছর বয়সে প্রথম চলচ্চিত্রে নেপথ্য গানে কণ্ঠ দেন। ১৯৬২ সালে তিনি এহতেশাম পরিচালিত উর্দু ভাষার চান্দা চলচ্চিত্রের "চান্দনী ভিগি ভিগি হাওয়া" গানে কণ্ঠ দেন। গানটি তখন ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৬৪ সালে তিনি সুভাষ দত্ত পরিচালিত সুতরাং চলচ্চিত্রের "তুমি আসবে বলে কাছে ডাকবে বলে ভাল বাসবে ওগো শুধু মোরে" সুতরাং চলচ্চিত্রের এই গানটিও গেয়েছিলেন আঞ্জুমান আরা বেগম। গানটির গীতিকার প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক এবং সুরকার সত্য সাহা। এটি সৈয়দ হকের লেখা প্রথম গান। সুভাষ দত্ত পরিচালিত আয়না ও অবশিষ্ট চলচ্চিত্রে "আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল" গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। গানটির রচয়িতা গাজী মাজহারুল আনোয়ার এবং সুর দেন সত্য সাহা। এটি বাংলাদেশের জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের গানের একটি। তার গাওয়া অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গানসমূহ হল "কে স্মরণের প্রান্তরে" "খোকনসোনা বলি শোন" "বৃষ্টি যখন" এবং "সাতটি রঙের মাঝে আমি মিল খুঁজে না পাই "।
ব্যক্তিগত জীবনে আঞ্জুমান আরা বেগম মাসুদ আলম সিদ্দিকীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তার স্বামী মাসুম আলম সিদ্দিকী সবসময় তাকে গান গাইতে উৎসাহ দিতেন। তার পুত্র তারিক মাশরুর দ্য ডেইলি স্টারের উপ-সম্পাদক এবং কন্যা উমানা এ্যাঞ্জেলিন এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির লেকচারার। আঞ্জুমান আরা বেগম প্রচুর পুরস্কার পেয়েছিলেন। ২০০২ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী তাকে গুণীজন সম্মাননা প্রদান করে। ২০০৩ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন। এ ছাড়াও তারকালোক পুরস্কার ও কলধ্বনি পদক লাভ করেন। পরে হজ্জ্ব করার পর তিনি অনেকটা নিভৃতচারী হয়ে যান এবং গান রেকর্ডিং বন্ধ করে দেন। শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকাবস্থায় ২০০৪ সালের ২৯মে মাসে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকার ধানমন্ডির মসজিদ-এ-তাকওয়ায় তার জানাজার নামাজের পরে তাকে ঢাকার বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়। মিষ্টি কথা ও শ্রুতিমধুর সুর হওয়ায় তার কণ্ঠেগীত কালজয়ী অসংখ্য গান এই সময়ে এসেও শ্রোতার মনে গানগুলো নতুনভাবে দৌলা দিচ্ছে। এসব গানের আবেদন আজীবনই শ্রোতাদের প্রাণে বাজবে। আজ কণ্ঠশিল্পী আঞ্জুমান আরা বেগমের ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। মৃত্যুদিনে তাকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধায়।
নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল ফেসবুক
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০২০ দুপুর ২:৩৯