somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাঙালি লেখক, সংগীতস্রষ্টা ও ভাষাবিদ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৭৯তম জন্মবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা

০১ লা জুন, ২০২০ রাত ২:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অগ্রজ বাঙালি লেখক, সংগীতস্রষ্টা ও ভাষাবিদ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির অন্যান্য সন্তানদের মতো তিনিও সাহিত্য ও সঙ্গীতানুরাগী ছিলেন। তাঁর প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য রচনাবলীঃ ১। সুশীলা ও বীরসিংহ (নাটক, ১৮৬৭), ২। বোম্বাই চিত্র (১৮৮৮), ৩। নবরত্নমালা, ৪। স্ত্রীস্বাধীনতা, ৫। বৌদ্ধধর্ম (১৯০১), ৬। আমার বাল্যকথা ও বোম্বাই প্রবাস (১৯১৫), ৭। ভারতবর্ষীয় ইংরেজ (১৯০৮), ৮। রাজা রামমোহন রায় ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি ছিলেন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগদানকারী প্রথম ভারতীয়। বদলি চাকরির সূত্রে তিনি সারা দেশ ভ্রমণ করেন। বাংলার বাইরে বদলির চাকরির সূত্রে সত্যেন্দ্রনাথ অনেকগুলি ভারতীয় ভাষা শেখারও সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি বাল গঙ্গাধর তিলকের গীতারহস্য ও তুকারামের অভঙ্গ কবিতাবলি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন। বদলির সূত্রে সত্যেন্দ্রনাথ যেখানেই গিয়েছিলেন, সেখানেই ব্রাহ্মসমাজের কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। আমেদাবাদ ও হায়দ্রাবাদ (সিন্ধু প্রদেশ) শহরে ব্রাহ্মসমাজের প্রসারে তাঁর বিশেষ অবদান ছিল। ব্রিটিশ ভারতের নারীমুক্তি আন্দোলনেও তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৮৪২ সালের আজকের দিনে তিনি কলকাতার জোড়াসাকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। আজ তাঁর ১৭৯তম জন্মবার্ষিকী। সাহিত্যিক, ভাষাবিদ ও সঙ্গীতজ্ঞ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা।


সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৪২ সালের ১লা জুন ভারতের জোড়সাকোর ঐতিহ্যবাহী ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মহির্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি বাড়িতেই সংস্কৃত ও ইংরেজি শিখেছিলেন। হিন্দু স্কুলের ছাত্র হিসাবে সত্যেন্দ্রনাথ ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত প্রথম প্রবেশিকা পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন এবং প্রথম বিভাগে স্থান অধিকার করে প্রেসিডেন্সি কলেজে (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন। ১৮৫৯ সালে তিনি মাত্র ৭ বছর বয়সের জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। সত্যেন্দ্রনাথের সাথে জ্ঞানদানন্দিনীর বিয়ের পর ঠাকুরবাড়িতেই তিনি গৃহশিক্ষকের কাছে লেখাপড়া শেখেন। জ্ঞানদানন্দিনী প্রথম ভারতীয় বাঙালি নারী, যিনি শ্বশুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন স্বামীর কর্মস্থলে। ১৮৬১ সালে আইসিএস আইন বলে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস চালু হলে ১৮৬২ সালে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণের উদ্দেশ্যে বন্ধু মনমোহন ঘোষের আর্থিক সহয়তায় দু-জনে ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ১৮৬৩ সালের জুন মাসে সত্যেন্দ্রনাথ ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে নির্বাচিত হন। এরপর শিক্ষাধীন প্রশিক্ষণ (প্রবেশনারি ট্রেনিং) সমাপ্ত করে ১৮৬৪ সালের নভেম্বর মাসে দেশে ফিরে এসে বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে কর্মে বহাল হন। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহারাষ্ট্র অঞ্চলের অগ্রণী সমাজ সংস্কারক ও প্রার্থনা সমাজ নেতৃবর্গের সংস্পর্শে আসেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মহাদেব গোবিন্দ রানাডে, কাশীনাথ ত্রিম্বক তেলঙ্গ, রামকৃষ্ণ গোপাল ভাণ্ডারকর ও নারায়ণ গণেশ চন্দবরকর। কর্মজীবনে ৩০ বছর তিনি আইসিএস পদ অলংকৃত করেছিলেন। ১৮৯৭ সালে মহারাষ্ট্রের সাতারার জজ হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণের পর সত্যেন্দ্রনাথ প্রথমে পার্ক স্ট্রিটে (অধুনা মাদার টেরিজা স্মরণি) ও পরে বালিগঞ্জে বসবাস করতে থাকেন। পারিবারিক সদস্যবর্গ ছাড়াও তারকনাথ পালিত, মনমোহন ঘোষ, সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ, উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্ত, বিহারীলাল গুপ্ত প্রমুখ বিশিষ্ট বন্ধুবর্গও এই দুই বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। তাঁদের পার্ক স্ট্রিটের বাড়িটি ছিল তাঁদের সাহিত্যিক মজলিস-এর কেন্দ্র। তাঁদের আলোচনার বিষয়বস্তু একটি বইতে গ্রন্থিত হয়েছিল। কিন্তু বইটি পরিবারের বাইরে প্রকাশিত হয়নি, এমনকি মুদ্রিতও হয়নি। আলোচনার কয়েকটি বিষয় ছিল বাংলা ভাষা ও বাংলা অক্ষর, কবিতার উপাদান, শৌর্য, পুরুষের প্রেম ও নারীর প্রেম।


সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বাংলার স্ত্রী-স্বাধীনতার পথিকৃৎ। তিনি বিলেত থেকে ফেরার পর তাঁর কর্মস্থল মহারাষ্ট্রে স্ত্রীকে নিয়ে যাবার জন্যে পিতার অনুমতি প্রার্থনা করলে বাড়িতে ধিক্কার পড়ে যায়। এ ব্যাপারে সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন অটল। শেষ পর্যন্ত পিতার অনুমতি নিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ শুরু করেন যাত্রার আয়োজন। কিন্তু সমস্যা দেখা গেল, জ্ঞানদানন্দিনী বাইরে যাবেন কী পোশাকে? কেন-না, সেকালের মেয়েরা বাড়িতে একখানা শাড়ি পরে থাকত। এমন বেশে জ্ঞানদানন্দিনী বাইরে যাবেন কি করে? অবশেষে জ্ঞানদানন্দিনীর জন্য তখনকার মত ফরাসি দোকানে অর্ডার দিয়ে বানানো হয় ‘ওরিয়েন্টাল ড্রেস'।এ পোষাক পরাও কষ্ট। জ্ঞানদানন্দিনী নিজে তা পরতেই পারলেন না। ঐ পোশাক পরেই তৈরি হলেন। প্রথমবারের এই পোশাক সমস্যা জ্ঞানদানন্দিনীকে বিব্রত করেছিল বলেই পরবর্তী সময়ে তিনি মেয়েদের পোশাক পরিচ্ছদ নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। স্বামীর কর্মস্থল বোম্বাই থাকাকালে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর শাড়ি ও জামার নমুনার নানা রকম পরিবর্তন করেন। গুজরাটি মেয়েরা যেভাবে শাড়ি পরে তার কিছু পরিবর্তন ঘটিয়ে ডান কাঁধের বদলে বাম কাঁধে অাঁচল নিয়ে শাড়ি পরার প্রচলিত সে রূপটি আমরা আজকের দিনে বাঙালি হিন্দু-মুসলমান মেয়েদের দেখি তা জ্ঞানদানন্দিনীরই আবিষ্কার। শাড়ির নিচে সায়া, সেমিজ, জামা ব্লাউজ পরার চলটি জ্ঞানদানন্দিনীই অবিভক্ত বাংলাদেশে প্রবর্তন করেছেন। ১৮৭৭ সালে সত্যেন্দ্রনাথ জ্ঞানদানন্দিনীকে এক ইংরেজ দম্পতির সঙ্গে ইংল্যান্ডে প্রেরণ করেন। জ্ঞানদানন্দিনী যে স্বামীকে ছাড়াই তাঁর তিন সন্তানকে নিয়ে ইংল্যান্ড পাড়ি দিয়েছিলেন, তা সেকালে ছিল এক দুঃসাহসী কাজ। এরপর সত্যেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথকেও ইংল্যান্ডে নিয়ে আসেন। রবীন্দ্রনাথের সেই ছিল প্রথম ইংল্যান্ড ভ্রমণ। ১৮৮০ সালে সকলে ভারতে ফিরে আসেন। জ্ঞানদানন্দিনী বিলেত থেকে ফিরে বিকেলে বেড়াতে বেরোনো এবং নিজের ছেলেমেয়েদের জন্মদিন পালনের মধ্যে দিয়ে ইউরোপীয় প্রথাটি নিজের পরিবারে প্রথম প্রচলন করেন। সেখান থেকে অখন্ড বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে জন্মদিন পালন করার আনুষ্ঠানিক প্রথাটি। জ্ঞানদানন্দিনীর উৎসাহেই প্রথম রবীন্দ্র জন্মোৎসাব পালিত হয় সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৪৯ নং পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতে। পত্রিকা প্রকাশ, প্রবন্ধ রচনা, রূপকথাকে নাট্যরূপ দেয়া, অভিনয় এসব কাজে জ্ঞানদানন্দিনী পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন। শুধুমাত্র জ্ঞানদানন্দিনীই নন, সত্যেন্দ্রনাথের বোনেরাও সামাজিক পরিবর্তনে অংশ নিয়েছিলেন। এজন্য উচ্চ ও মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দু সমাজের মেয়েদের পর্দাপ্রথার বাইরে বের করে আনার কৃতিত্ব অনেকটাই পেয়ে থাকেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর।


পিতা দেবেন্দ্রনাথ ও তাঁর সংগঠিত ধর্মমতের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ ছিল সত্যেন্দ্রনাথের। প্রথম যৌবনেই তিনি ও মনমোহন ঘোষ কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে কৃষ্ণনগর কলেজে গিয়ে সেখানকার তরুণ সমাজকে ব্রাহ্মসমাজের প্রতি আকৃষ্ট করেন। ইংল্যান্ডে পেশাগত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি ব্রাহ্মসমাজে উপদেশ প্রদান করতেন। পরবর্তীকালে আমেদাবাদে কর্মরত থাকার সময় তিনি ম্যাক্স মুলরকে ব্রাহ্মসমাজ সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন পাঠান। ম্যাক্সমুলরের স্ত্রী স্বামীর জীবনীগ্রন্থটি রচনা করেছিলেন, সেখানে তিনি এই প্রতিবেদনটি অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৯২৩ সালের ৯ জানুয়ারি মৃত্যুৃবরন করেন লেখক সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। আজ তাঁর ১৭৯তম জন্মবার্ষিকী। সাহিত্যিক, ভাষাবিদ, সঙ্গীতজ্ঞ ও প্রথম ভারতীয় সিভিলিয়ান সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা।

নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল :-& ফেসবুক
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুন, ২০২০ রাত ২:১৫
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×