এই পোস্টটি একেবারেই অপরিকল্পিত; সহব্লগার আল্লাহ রাখার একটি পোস্টের কিছু মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মন্তব্য করতে গিয়ে বিশাল আকৃতি দেখে শেষে আলাদা পোস্ট হিসেবে দিয়ে দিলাম। কিছু ব্যক্তিগত দুঃখবোধ ও ক্ষোভ কাজ করেছে; কাউকে কোনভাবে আঘাত দিয়ে থাকলে অগ্রিম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
============================================
ঐ পোস্টের দু'টো মন্তব্য কোট করছি।
*পৃথিবীর অনেক প্রতিভাবানরাও অটিষ্টিক ছিলেন।
*রেইন ম্যানের মত দু চারটা অটিস্টিক যদি জন্ম নিত বঙ্গদেশে!
এখানে মনে রাখা দরকার, অটিজম সম্পর্কে বেশ কিছু ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে। এর একটি হলো ASD (Autism Spectrum Disorder) আক্রান্ত ব্যক্তিরা সুপ্ত প্রতিভার অধিকারী।
বাস্তবতা: অটিস্টিকদের কেউ কেউ হয়তো বিশেষ পরিস্থিতিতে খুব ভাল আইকিউ স্কোর করতে পারে অথবা বিশেষ কোন কাজে দক্ষতা দেখাতে পারে, কিন্তু এটা নিছকই ব্যতিক্রমী ঘটনা। সাধারণ অটিস্টিক জনগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য মিডিয়ায়, চলচ্চিত্রে বা সাহিত্যে সমাদৃত হবার মতো আকর্ষণীয় কিছু নয়। বিশেষ কোন দক্ষতার অধিকারী অটিস্টিককে নিয়ে লিখিত উপন্যাস পড়ে, কিংবা তাকে নিয়ে নির্মিত ডকুমেন্টারি বা চলচ্চিত্র দেখে অনেকে ধারণা করে নেন ASD আক্রান্ত সবারই বিশেষ কোন প্রতিভা থাকে (যেমন গণিতে ভাল হওয়া)। বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র রেইনম্যানে ডাস্টিন হফম্যানের চরিত্র, অথবা আইনস্টাইনের অটিজম থাকার প্রসঙ্গ অনেকেই জানেন এবং প্রাসঙ্গিক আলোচনায় রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করতে ভালবাসেন। বাস্তবতা হলো আমেরিকায় শিশুদের প্রতি ১৫০ জন একজন এবং অস্ট্রেলিয়ায় ১৬০ জনে একজন শিশু অটিজম আক্রান্ত। যাদের অধিকাংশই ম্যাথ-জিনিয়াস হওয়া দূরে থাক, খুব সাধারণ দৈনন্দিন কাজকর্মেও অন্যের উপর নির্ভরশীল।
=============================================
আরেকটি মন্তব্য দেখা যাক।
*ইদানীং বাংলাদেশে শোনা যাচ্ছে।
বাস্তবতা: অটিজম বাংলাদেশে একেবারে নতুন কিছু না। স্রেফ শনাক্ত করা হয়নি বা হয়না বলেই আগে শোনা যেতোনা। অবিশ্বাস্য শোনাতে পারে; বাংলাদেশে মাত্র কয়েক বছর আগেও চিকিৎসকদের অনেকেই (এমনকি শিশু বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও কেউ কেউ) ছিলেন যারা অটিজম সম্পর্কে সেভাবে সচেতন ছিলেন না। এই তথ্যটি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার অর্জন। কেউ আপত্তি করলে সবিনয়ে জানাতে চাই, জনৈক চক্ষুবিশেষজ্ঞ আমার অটিজম-আক্রান্ত সন্তানের চোখের সমস্যার জন্য আইড্রপ দিতে গিয়ে অস্বাভাবিক আচরণ দেখে প্রচণ্ড বিরক্ত হন। তখনই নাকি এই অটিজম টার্মটি সম্পর্কে উনি প্রথম জানতে পারেন। আরেকবার এক শিশু শল্যবিশেষজ্ঞ এই টার্মটি শুনে তখনই আবার হাসিমুখে অটিস্টিক-এর নিষ্ঠুর বঙ্গানুবাদ করেন: ভোদাইস্টিক। এখনও খুব বেশী আশাব্যঞ্জক পরিবর্তন আসেনি এই অবস্থার। পনেরষোলকোটির দেশে একজনও স্পিচ থেরাপিস্ট নেই এবং স্পিচ থেরাপির গুরুত্ব বিষয়ে উন্নত বিশ্বে যতোটা জোর দেয়া হয়, আমাদের চিকিৎসকরা অভিভাবকদের কাছে বিষয়টি সেভাবে উপস্থাপন করেন বলে মনে হয়নি।
প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, ইউএসএ'তে ষাটের দশকে প্রথম অটিস্টিক শিশুকে চিহ্নিত করা হয়। তবে তখন একে অব্যাখ্যায়িত অক্ষমতা হিসেবে দেখানো হয়েছিল। ১৯৯১ সাল থেকে special education exceptionality হিসেবে অটিজমকে অন্যান্য শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবন্ধিতার বাইরে স্বতন্ত্র ক্যাটাগরিভুক্ত করা হয়। বর্তমানে এটা fastest-growing developmental disability এবং বার্ষিক গড় বৃদ্ধির হার ১০-১৭% (অটিজম সোসাইটি অফ অ্যামেরিকা'র ২০০৬ সালের তথ্যানুযায়ী)। পৃথিবীতে মাত্র চারটি দেশে অটিস্টিকদের সংখ্যার হিসাব রাখার ব্যবস্থা আছে (ইউএসএ, ইউকে, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায়; তাও সর্বত্র অপেক্ষাকৃত মৃদু মাত্রার অ্যাসপারগার সিনড্রোম ও PDDNOS (Pervasive developmental disorder not otherwise specified) কে হিসেবের মধ্যে ধরা হয়না। এইসব দেশের হারকে ব্যবহার করে অন্যান্য দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে অটিস্টিকদের অনুমিত সংখ্যা হিসাব করা হয়)। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এসব দেশের কোথাও কোথাও অটিস্টিকদের সংখ্যা ৫০০%-১০০০% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। এই হার নিঃসন্দেহে আতঙ্কজনক। স্থানবিশেষে অটিস্টিকদের সংখ্যাবৃদ্ধির অস্বাভাবিক উচ্চহারের কারণ হিসেবে পরিসংখ্যানিক প্রক্রিয়ার আওতার পুনঃনির্ধারণকে হয়তো দায়ী করা যেতে পারে; কিন্তু বাস্তবতা হল এই হার সত্যিই বাড়ছে।
============================================
একই মন্তব্যের দ্বিতীয় অংশ:
*চিন্তা করবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে।
বাস্তবতা: অটিস্টিক শিশু কখনোই পুরোপুরি সেরে উঠবে না। তারপরও, মৃদু মাত্রার অটিজম, যেমন অ্যাসপারগার সিনড্রোমের ক্ষেত্রে যথাযথ সহযোগিতা, সমর্থন ও শিক্ষা পেলে পরিণত বয়সে আত্মনির্ভরতা অর্জন করা সম্ভব। বাকীদের বেলায়, উচ্চমাত্রার অটিজমের ক্ষেত্রে পরিণত বয়সেও অন্যের সাহায্য ছাড়া কখনোই স্বনির্ভর দৈনন্দিন জীবনযাপন সম্ভব নয়।
============================================
============================================
এবার একান্তই আমার নিজের কিছু কথা।
অটিজম আক্রান্ত শিশুর পিতামাতা কী জীবন যাপন করেন, তারা ছাড়া আর কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব না। আমার অনুরোধ, তাদের প্রতি কোনরকম সান্ত্বনাবাণী দেবেন না। তাদেরকে এই সমস্যা মোকাবেলায় সাহায্য করুন। এটা দৈবক্রমে সেরে যাবেনা, তাদেরকে যা করতে হবে তা হলো মন স্থির করে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে শিশুটির সঙ্গে কঠোর পরিশ্রমসাধ্য কার্যকর সময় ব্যয়।
অটিজম আক্রান্ত শিশুকে অর্থপূর্ণভাবে কথা বলা, অন্যের সঙ্গে কমিউনিকেট করা, অন্যের ডাকে সাড়া দেয়া, অন্যের সঙ্গে আইকন্ট্যাক্ট করা, গ্রস মোটর অ্যাক্টিভিটি (হাঁটা, দৌড়ানো, হামাগুড়ি দেয়া, লাফানো, এক পায়ে লাফানো ইত্যাদি), ফাইন মোটর অ্যাক্টিভিটি (আঙুল দিয়ে কোন বস্তু (যেমন পেন্সিল) ঠিকভাবে ধরা, বোতাম লাগানো, কাগজ বা কাপড় ভাঁজ করা বা কাটা, হাত রগড়ে ধোয়া, হাত থেকে পানি ঝাড়া) ইত্যাদি কাজ শেখানো অকল্পনীয় ধৈর্য্য, সময় ও শ্রমসাপেক্ষ। স্বাভাবিক শিশুরা পারিপার্শ্বিক পরিবেশ-প্রতিবেশ থেকেই এতো স্বতঃফূর্তভাবে এসব শেখে যে আমরা ধারণাই করতে পারিনা এগুলো কোন বিশেষ "কাজ" কিনা আর সেসব "শেখাতেই" বা হবে কেন।
আমার সন্তান মাঝারি ধরণের অটিজমের শিকার; তাকে কথা শেখানোর জন্য অনর্গল গল্প বলে যেতে হয়েছে, অন্য কারো সঙ্গে বিভিন্ন ধরণের সংলাপ আদানপ্রদানের পুনরাবৃত্ত অভিনয় দেখাতে হয়েছে বার বার। তার আগ্রহ অনুযায়ী খেলনা, চারপাশের জীবজড় নির্বিশেষে সবার মুখে সংলাপ বসিয়ে গল্প বলে যেতে হয়েছে। এই কাজ করতে গিয়ে আক্ষরিক অর্থেই আমার গলায় ঘা হয়ে গিয়েছিলো সেই সময়। সে সাইকেলে উঠে বসে থাকতো, প্যাডেলে চাপ দেয়ার সাধারণ ব্যাপারটা শেখানোর জন্য আমাকে তার পায়ের পাতা হাত দিয়ে চেপে ধরে তার সাইকেলের পাশে পাশে প্রায় হামাগুড়ি দিতে হয়েছে প্রতিদিন অন্তত আধাঘন্টা করে ছয় মাস। প্রতিদিন অন্তত আধাঘন্টা ধরে তাকে জামার বোতাম লাগাতে শেখাতে হয়েছে। কিছুক্ষণ বিছানায় পাশাপাশি দুটো জামা রেখে; একটা বোতাম নিজে লাগিয়ে তাকে দেখিয়ে, এবং একই কাজ তাকেও রিপিট করতে হবে সেটা বোঝাতে হয়েছে। আয়নার সামনে দুজনকেই দাঁড়াতে হয়েছে, পরে থাকা জামার বোতাম লাগিয়ে-খুলে আয়না দেখে দেখে প্র্যাকটিস করাতে হয়েছে। এভাবে প্রায় একবছর পর সে প্রথম নিজে নিজে বোতাম লাগাতে সক্ষম হয়। তেমনি পেন্সিল ধরে লেখা শেখানো। অসংখ্য তুচ্ছাতিতুচ্ছ অথচ দৈনন্দিন কাজ। এসব কাজ শেখানোর সময় সবচেয়ে কঠিন কাজটা হলো তার মনোযোগ আর দৃষ্টি ধরে রাখার জন্য অনর্গল তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় এমনভাবে বুঝিয়ে বুঝিয়ে কথা বলে যাওয়া।
এতো কথা বলার উদ্দেশ্য হলো, এই স্নায়ুক্ষয়ী দীর্ঘমেয়াদী পরিশ্রমে শিশুর অভিভাবককে উদ্বুদ্ধ করুন। আইনস্টাইন অটিস্টিক ছিলেন-- এই ধরণের স্টুপিড উদাহরণ না দিয়ে এভাবে শ্রম আর সময় দেয়ার পর শিশুর উন্নতি দেখলে তাদের অ্যাপ্রিশিয়েট করুন। শিশু তার ঘাটতি কমিয়ে আনবে এমন প্র্যাক্টিক্যাল আশাবাদ দিন। দয়া করে আমার সেই অর্বাচীন আত্মীয়টির মতো বলবেননা, "এইসব কোন ব্যাপার, সব ঠিক হয়ে যায়, দুইদিন আগে আর পরে। আর তুই করলি কী, ক্যারিয়ার বাদ দিয়ে বেবীসিটিং! এতো পড়াশোনা তাহলে কেন করলি!"
ব্লগে অটিজম নিয়ে পোস্ট দিতে গিয়ে নিষ্ঠুর থেকে শুরু করে অশ্লীল রসিকতা পর্যন্ত পেয়েছি। যে দেশের শিশু বিশেষজ্ঞ একটা শিশুকে "ভোদাইস্টিক" বলতে পারেন, সে দেশে শিক্ষিত লোকের জন্য এসব আসলে কোন ব্যাপারই না। তাদের বলি, দয়া করতে না পারলে স্রেফ অফ যান, শুধু নিষ্ঠুরতা দেখাবেন না প্লিজ। সেটা এক নিয়তিই আমাদের যথেষ্ট দেখিয়েছে।
আগ্রহীরা দেখতে পারেন--
http://www.nushera.com/taxonomy/term/25
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে নভেম্বর, ২০০৯ সকাল ৭:২২