ঘটনাটা ঘটেছে আমার ভীষণ কাছের এক বন্ধুর পরিবারে। ঠিক ততটাই কাছের, যতটা হলে বন্ধুকে ভাই বলে স্বীকৃতি দেয়া যায়। তাই, এই ঘটনার আদ্যোপান্ত জানি আমি। আর সেই জানাটা আমার বিশ্বাসের জায়গায় বেশ সজোরে আঘাত করেছে।
পরিবারের বর্ণনা না দিলে অন্যায় হয়ে যায়। আমার বন্ধুর বাবা নেই। অনেক দিন আগেই মারা গিয়েছেন। মা আছেন, ঢাকার এক নামকরা কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। অবসরে গিয়েছেন বছর দুই হল। আমার বন্ধু নিজে একটা ব্যাংকের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার। তার স্ত্রী একটা মাল্টি ন্যাশনালে মধ্য-স্তরের কর্মকর্তা। এছাড়া আমার বন্ধুর বড় এক ভাই রয়েছেন। যিনি এই ঘটনার যাকে বলা যায় কেন্দ্রে আছেন। থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়। আমার বন্ধুর বাবা মারা যাওয়ার তিন বছরের মাথায় এই ভাই সেখানে চলে যান। তখন আমার বন্ধু অনেক ছোট, এস এস সি দিবে। সেই সময় থেকেই এই পরিবার তার বড় ভাইয়ের উপর নির্ভরশীল। বড় ভাইও সেই দায়িত্ব নির্দ্বিধায় পালন করে গিয়েছেন। বন্ধুকে পড়াশোনা শেষ করতে সাহায্য করেছেন, মা-কে চাকরি থেকে অবসর নিতে বাধ্য করেছেন, ঢাকায় একটা ফ্ল্যাট কিনে সেখানে থিতু করেছেন পুরো পরিবারকে। আর তারপর সবার অমতে আগে বিয়ে করিয়েছেন নিজের ছোট ভাইকে, মানে আমার বন্ধুকে। তখন এটা নিয়ে বেশ হইচই হলেও, তার ব্যক্তিত্বের কারণে কথা বাড়াতে সাহস করে নি কেউ। বন্ধুর আপত্তিরও কারণ ছিল না। কারণ সে প্রেম করত। এই ফাঁকে বিয়েটা সেরে ফেলতে পেরে খুশীই হল সে। বিয়েতে ঝামেলাও হল কিছু। কোন এক অদ্ভুত কারণে মেয়ের পরিবার বিয়েতে মত দিল না। কাজেই একপক্ষীয় ভাবে বিয়ে হয়ে গেল। বউটা খুবই ভালো মেয়ে। এরকম একটা চাকরি করেও পরিবার ও মায়ের যত্ন নেয় দারুণভাবে। এরপর আরও বছর দুই চলে গেল। আমার বন্ধুর বড় ভাইয়ের মনে হল এইবার বিয়ে করা প্রয়োজন।
কাজেই পাত্রী দেখা শুরু হল। এই অবসরে জানা গেল বর্তমানে বিদেশী পাত্রদের প্রতি সাধারণ মানুষজনের মনোভাব খুব একটা ভালো নয়। আর সেই পাত্রের বয়স ত্রিশোর্ধ হলে এবং তার ছোট ভাইয়ের বিয়ে আগে হয়ে থাকলে সমস্যাটা আরও গুরুতর আকার ধারণ করে। এর মধ্যেও খোঁজ চলতে লাগল। সবচেয়ে সাহায্য করলো ফেসবুক। সেখানের একটা গ্রুপ থেকেই বায়োডাটার স্তূপ পাওয়া গেল। চলল যাচাই বাছাই। একটা শর্ট লিস্ট বানিয়ে মেয়ে দেখা হল। এবং শেষমেশ শুধু সৌন্দর্যের কারণে একটা মেয়েকে বেছে নেয়া হল। মেয়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নেয়া হল, গ্রামের বাড়িতে এবং ঢাকায় যে এলাকায় থাকে সেখানেও। সবজায়গা থেকে গ্রিন সিগন্যাল পাওয়ার পর লঙ ডিসট্যান্স এংগেজমেন্টটাও সেরে ফেলা হল ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠান করে। ছেলে মেয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলা শুরু করল। এবং সমস্যা ঘনীভূত হতে থাকল। বিয়ের কেনাকাটা ও বিয়ে পরবর্তীকালে একসাথে থাকার বিষয় নিয়ে এসময় একটা বেশ ভালো রকম মন কষাকষি হয়ে গেল ঐ ভাই আর মেয়ের মধ্যে। দুই পরিবার একত্রিত হল ও বিষয়টা নিয়ে বেশ বচসা শেষে একটা সমঝোতায় আসল। দোষটা সম্পূর্ণ মেয়েটারই ছিল ও এই ধরনের সমস্যায় সাধারণত বিয়ে ভেঙে যায় কিন্তু অদ্ভুতভাবে বিয়েটা টিকে গেল। কারণ বড় ভাই মানুষটা অসাধারণ চরিত্রের। তিনি এইভাবে এংগেজমেন্ট শেষে বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে মেয়েটার জীবনে দাগ ফেলতে চাইলেন না। বরং ভাবলেন ভবিষ্যতে মেয়েটা শুধরে যাবে। হয়তো এখানেই ভুল করেছিলেন।
বিয়েটা হয়ে গেল। বড় ভাই একমাসের ছুটিতে দেশে আসলেন। বিয়ে করলেন, হানিমুন করলেন। আত্মীয়দের বাসায় দাওয়াত খাওয়া হল, সবশেষে আবার উড়াল। বউকে নিয়ে যেতে আরও বছর খানেক লাগবে। ততদিন এই ফ্ল্যাটেই থাকবে সে। এবং ঠিক বিশ দিনের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো পরিবারটার উপরে। প্রচণ্ড কলহের সৃষ্টি হল ভাই আর তার পরিবারের মধ্যে। ভাইয়ের কথা তার বউয়ের সাথে নিয়মিত খারাপ আচরণ করা হচ্ছে। তাকে আপন করে নেয়া হচ্ছে না। বন্ধুর স্ত্রীর উপর অনেক দোষারোপ করা হল। বন্ধু ও তার মার উপরও। ভীষণ নাটকীয়ভাবে এক দিনের মাথায় বাসা থেকে সকল জিনিসপত্র সহ মেয়েকে নিজের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন ভাইয়া। ঘটনার চাকা ঝড়ের বেগে গড়াতে শুরু করল। পরিবারের সাথে এক অমোচনীয় দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গেল ঐ ভাইয়ের। আগে যেখানে দিনে তিনবার ফোন করে মায়ের খোঁজ নিতেন তিনি। এখন নিয়ম করে সপ্তাহে একবার, শুধুমাত্র রবিবার, ফোন করে খুব স্বল্প সময়ের জন্য কথা বলেন তিনি। প্রতিদিন কথা বলতেন আমার বন্ধুর সাথে, তার বউয়ের সাথে, একটা মেয়ে আছে ওদের দেড় বছর বয়স; পাগলের মত ভালোবাসতেন যাকে। তাদের সাথে কথা বলেন না মাস ছয়েক হল। পরিবারের খরচের দিকটা দেখতেন তিনি। বন্ধুকে কখনও একটা টাকাও দিতে হয় নি, আসলে দিতে দিতেন না কিছুতেই - ছয় মাস হল সেটাও বন্ধ। বউকে এই বাসায় আসতে নিষেধ করেছেন তিনি। নিয়ম রক্ষার্থে সেও সপ্তাহে একবার ফোন করে আমার বন্ধুর মা-কে। একটা সুখী পরিবার মুহূর্তে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল। আমার বন্ধুর মা এই শোক সামলে নিতে পারছেন না, তার শরীর এখন এতটাই খারাপ যে বন্ধু আতংকিত কখন একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায়। বন্ধুর বউ ব্যাপারটাতে নিজেকে দোষী ভাবে কারণ বিয়ের দেখভাল, ঘটকালী সব সেই করেছিল। তার এই নিজেকে দোষ দেয়া বন্ধুর পারিবারিক জীবনেও দুর্যোগ ডেকে আনছে।
কিন্তু, ঘটনা আসলে এখানে শেষ নয়। ঘটনার শুরু হল এখানে।
বিদ্রঃ এটা কোন গল্প নয়। সত্যিকার ঘটনা যার প্রভাব অনেক গুরুতর। একটানা লিখতে পারি না। মাত্র ডেঙ্গু থেকে উঠলাম। তাই ভেঙ্গে ভেঙ্গে লেখা।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই আগস্ট, ২০১৯ দুপুর ২:১৪