-এই শালা বাই€¥*§
কামরুল একটা খারাপ গালি দিয়ে উঠল । গালি দিয়েই জিহ্বায় একটা কামড় দিল । মনে মনে ঠিক করেছিল আজকে বাস চালানোর সময় কোন গালি দিবে না ।
বাঁ দিকের মহিলা যাত্রী গুলো কেমন বিব্রত চোখে তাকাচ্ছে । কেউ আবার এমন একটা ভাব করছে যেন কিছু শুনে নি ।
কামরুল নিজের উপর একটু বিরক্ত হল । আজকে সকাল বেলায় নিয়ত করেছিল বাস চালানোর সময় আজকে কিছুতেই গালি দিবে না । কিন্তু শালার সিএনজিটা এমন ভাবে ডানে চাপলো মুখ দিয়ে গালিটা বের হয়ে গেল ।
নাহ আর একটু সাবধানে চালাতে হবে । কামরুল গাড়ির গতি কমিয়ে আনলো ।
এতো জোড়ে চালানোর অবশ্য খুব একটা দরকার নাই । রাস্তাঘাট ফাকাই বলা চলে । বিরোধী দলের অবরোধে রাস্তার গাড়ি ঘোড়ার সংখ্যা একদম কম । কামরুলও সারাদিন গাড়ি চালায় নি । সেই সকাল বেলা গাড়ি নিয়ে মিরপুর থেকে সদরঘাট এসেছিল । আর যায় নি । রাস্তা ঘাটের যা অবস্থা তাতে যাওয়ার সাহস হয় নাই । কখন কি হয়ে যায় কে জানে । কিন্তু তবুও তো বসে থাকা চলে না ।
যারা হরতাল অবরোধ ডাকে তাদের তো কোন চিন্তা নাই । তারা তো দিয়েই খালাস । আর সরকারের খুব বেশি চিন্তা আছে বলে মনে হয় না । চিন্তা তো সব কামরুলের মত লোকেদের । একদিন কাজ না করলে একদিন চুলায় আগুন জ্বলে না । তাই তো এতো ঝুকি নিয়েও বাইরে বের হতে হয় ।
প্রতিদিন সকালে এক টিপ নিয়ে বের হয় আবার সন্ধ্যার দিকে আরেক টিপ নিয়ে মিরপুরে যায় । কামরুলের বাসটা এগিয়ে চলছে । কমরুল গাড়ির গতি বেশ কমিয়ে এনেছে ।
মত্স ভবন পার হয়ে ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউটের পাশ দিয়ে বাসটা এগিয়ে চলছে শাহবাগের দিকে ।
-আরে কি করে কি করে ?
কামরুল চিত্কার করে উঠল ।
-ওস্তাদ ।
-হুম ।
-আর কতক্ষন বইসা থাকবেন ?
কাদের বিরক্ত হয়ে তার সাগরেদ আলমের দিকে তাকালো । বিরক্ত মুখেই বলল
-বেশি বুঝিস না । চুপ থাক ।
-ওস্তাদ আর ভালা লাগতেছে না । কতক্ষন ধইরা বইসা আছি এখানে । হাতের ভিতরে নিশপিস করতাছে ।
কাদের মাঝে মাঝে নিজের এই সাগরেদ দেখে অবাক লাগে । সেদিনকার ছেলে । কিন্তু এই লাইনে আলমের পারফরমেন্স দিন দিন কাদের কেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে । গত দুইদিন ঢাকা শহরে আলম যত গাড়ি ভেঙ্গেছে অন্য কোন কর্মী এতো ভেঙ্গেছে কি না কে জানে ! এই ভাবে এগিয়ে যেতে থাকলে হাই কমান্ডের নজরে পড়ে যাবে ।
সেই তুলনায় কাদেরের পারফরমেন্স ভাল না । আজকে কাদেরকে কিছু করতেই হবে । উপর থেকে নির্দেশ এসেছে এমন কিছু করতে হবে যেন সংবাদের শিরোনাম হয় । এবং কাজটা করতে হবে শাহবাগের আসে পাশে ।
কাজটা করায় ঝুকি আছে কিন্তু টাকাও পাওয়াও যাবে বেশ । কাদের একাই আসতে চেয়েছিল কিন্তু তাকে একা আসতে দেওয়া হয় নি । উপরের কড়া নির্দেশ যে কোন ভাবেই কাজটা করতে হবে তাই কাদের যে কাজটা দিয়েছে সে কোন প্রকার ঝুকি নিতে চায় নি । কাদেরের সাথে তাই আলমকেও পাঠিয়েছে ।
হঠাত্ করেই আলম হিহি করে হেসে উঠলো ।
-এই আলইম্যা হাসোছ ক্যা ?
-না ওস্তাদ কিছু না । ভাবতাছি যখন কামডা করুম তখন কেমুন মজা হইবো ! অনেক দিন বাস পুড়াই নাই ।
-কাইলই না পুড়াইলি ।
-আরে দুর । ঐডা কিছু হইলো ? ঐ বাসটা খাড়াইয়া ছিল । ভিতরে কেউ ছিল না । ঐ বাস পুড়ায়া কুনো মজা নাই ।
কাদের আবারও বিরক্ত হয়ে তাকালো আলমের দিকে । মাঝে আলমের এমন কথা বার্তা শুনে কাদের অবাক হয় । কাদের বলল
-তুই বেশি কথা কস । রেডি হ ।
মাগরিবের আযান দিয়েছে কিছুক্ষন আগে । চারিপাশে অন্ধকার নেমে এসেছে । সোডিয়ামের হলুদ বাতি গুলো জ্বলে উঠেছে । হলুদ বাতির নিচ দিয়ে দুজনেই রাস্তা পার হয়ে রাস্তার বিপরীত দিকে গিয়ে হাজির হল । ল্যাম্পপোষ্ট থেকে একটু দুরে দাড়িয়েছে দুজন । এই জায়গাটা একটু অন্ধকার মত । একটা ল্যাম্পপোষ্টের আলো জ্বলছে না । তাই অন্ধকার জায়গাটা । কাদের বলল
-মাল গুলো আছে তো ?
-আরে কিযে কন না ওস্তাদ ? তিনটা আছে ।
-বাইর কর ।
পিঠে ঝুলানো কাপড়ের ব্যাগ থেকে একটা পেট্রল বোমা বের করলো আলম ।
-ঐ তো একটা বাস আইতাছে । রেডি হ ।
-হুম । ওস্তাদ রেডি ।
-আগুন ধরা জলদি । জলদি ।
-ধরাইছি । মারমু ?
-দাড়া দাড়া ...... মার । ছুইড়া মার ।
কয়েক মিনিট কি হল কিছু বোঝা গেল না । হঠাত্ই অন্ধকারের ভিতর বাসটার ডান পাশটা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল । বাসটা জ্বলন্ত অবস্থায় কিছু দুর চলে একটা ইলেক্ট্রিক খাম্বার সাথে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল ।
কাদের লক্ষ্য করলো আলম এখনও দাড়িয়ে আছে । এখনই পালাতে হবে কিন্তু বেটা আলইম্যা আগুন জ্বলা দেখতেছে । কাদের ওর চোখে একটা পৈচাশিক আনন্দ দেখতে পাচ্ছে । দাঁত বের করে হাসছে । জ্বলন্ত বাসটা থেকে মানুষ জনের চিত্কার ভেসে আসছে আর আলম সেটা দেখছে আনন্দ নিয়ে ।
যেন কোথায় হারিয়ে গেছে । কাদের তখনই লক্ষ্য করল একটা ছায়ামুর্তি ওদের দিকে দৌড়ে আসছে ।
-ভাগ আলম ভাগ ।
কাদের আলমকে একটা ধাক্কা দিয়ে নিজে ঘুরে রমনা পার্কের দিকে দৌড় দিলো । কোন রকমে একবারে রমনা পার্কের গেটের কাছে পৌছানে পারলেই আর চিন্তা নেই ।
কাদের দৌড়াতে থাকলো । পেছনে আলম আসতেছে কি না সেদিকে ওর লক্ষ্য নেই ।
তানজিনার মেজাজটা চরম খারাপ হয়ে আছে । কি করবে ঠিক মত বুঝতে পারছে না । দীর্ঘ আধা ঘন্টা ধরে ও একটা বাসের জন্য অপেক্ষা করছে । কিন্তু একটা বাস যদি আসে ?
আর যে কটা আসছে সব ভর্তি হয়ে । অন্য দিন গুলোতে লোকাল বাস গুলো রাস্তা দাড়িয়ে দাড়িয়ে লোক নিত আর আজকে থামার নামই নেই ।
বোঝা যাচ্ছে অবরোধের জন্য কেউ বেশি সময় বাইরে থাকতে সাহস পায় না । কেউ তো বাইরেও বের হতে চায় না । কিন্তু বাধ্য হয়ে বেরই হতে হয় ।
তানজিনার জরুরী কাজ ছিল মত্স ভবনের পাশে । না আসলেই নয় । সন্ধ্যার আগ দিয়ে কাজ শেষ হয়েছে । সেই তখন থেকেই মত্স ভবনের কাছে দাড়িয়ে ছিল কিন্তু কোন বাসেই উঠতে পারে নি । শেষে না পেরে হাটতে শুরু করলো । শাহবাগে গেলে নিশ্চই কোন না কোন বাস পাওয়া যাবে । অন্তত একটা রিক্সা তো পাওয়া যাবে ।
তানজিন হাটতে থাকে । ইঞ্জিনিযারিং ইনস্টিটিউটের গেট টা পার হতেই হঠাত্ অন্ধকারের ভিতর থেকে দুজন লোক কে বের হতে দেখলো । লোক গুলোর হাটা চলা কেমন যেন সন্দেহ জনক । কেমন চোরের মত পা টিপে টিপে হাটছে । লোকট দুটো রাস্তা পার হয়ে ঐ পাশের রাস্তায় গিয়ে হাজির হল ।
তানজিনা ঠিক বুঝতে পারছিল না লোক গুলোকে এমন কেন মনে হচ্ছে কিন্তু তার কিছু একটা মনে হচ্ছে যেন কিছু একটা ঠিক হচ্ছে না । কিছু একটা সমস্যা হয়েছে কিংবা হতে যাচ্ছে ।
তানজিনার মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল ও দেখলো দুজন লোকের ভিতর একজন কাধে ঝুলানো ব্যাগ থেকে একটা বোতল বের করলো । কয়েক মুহুর্তের ভিতর সেই বোতলের মুখে আগুন জ্বলে উঠলো ।
তানজিনার আর বুঝতে বাকি রইলো না কি হতে যাচ্ছে । তানজিনা চিত্কার করে উঠল । কিন্তু পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া বাসটার হর্ণের আওয়াজে তানজিনার আওয়াজ টা ঢেকে গেল । তারপর তানজিনা যেন একটা ঘোরের ভিতর চলে গেল । চোখের সামনে বাসটার একপাশে আগুন লেগে গেল । বাসটা ধাক্কা খেল একটা খাম্বার সাথে । ঘটনা ঘটতে খুব বেশি হলে দশ থেকে পনের সেকেন্ড রাগলো ।
যখন তানজিনা আবার বাস্তবে ফিরে এল তখনও লোক দুটো দাড়িয়ে । একজন আবার দাত বের করে হাসছে । তীব্র একটা ঘৃণা জেগে উঠল তানজিনার ভিতর ।
মানুষ এমন পৈচাশিক আচরন করতে পারে । তানজিনা লোক দুটোর দিকে দৌড়াতে যাবে ঠিক তখনই লোকদুটোর একজন ঘুরে দৌড় দিল । একজন তখনও দাড়িয়ে । কিন্তু কয়েক মুহুর্ত ।
তানজিনা দেখলো দ্বিতীয় লোকটাও দৌড়াতে শুরু করেছে । কিন্তু দ্বিতীয় লোকটা খুব বেশি দুর যেতে পারলো না । অন্ধকারের ভিতর থেকে একটা ছায়ামুর্তি এসে লোকটাকে চেপে ধরেছে । দশ সেকেন্ডের ভিতর দ্বিতীয় জন ছায়ামুর্তির কাছ থেকে নিজে কে ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড় দিল । কিন্তু নিজের কাধের ব্যাগটা আটকে গেল ছায়া মুর্তির হাতে ।
ছায়ামুর্তি ব্যাগ নিয়ে নিয়ে লোকটার পিছনে দৌড়াতে শুরু করে দিল ।
তানজিনা নিঃশ্বাস বন্ধ করে এসব দেখছে । এদিক দিয়ে জ্বলন্ত বাস থেকে মানুষ জনের চিত্কার ভেসে আসছে ।
হঠাত্ করেই ছায়া মুর্তির হাতে একটা বোতল বের হয়ে এল । তানজিনার মাথায় আবার একটা ভয়ংকর চিন্তা কাজ করছে ।
ছায়ামুর্তি কি করতে যাচ্ছে ?
না । না ।
ছায়ামুর্তি হঠাত্ থেমে গেল । ততক্ষনে তার হাতের বোতলের মুখটাতে আগুন জ্বলে উঠেছে । ছায়ামুর্তি থেকে দ্বিতীয় লোকটা ততক্ষনে বিশ বাইশ হাত দুরে চলে গেছে । ছায়া মুর্তি আরও কয়েক মুহুর্ত দেরি করলো ।
তারপর আগুন সমেত বোতলটা ছুড়ে মাড়ল লোকটার দিকে । ঠিক যেমন ভাবে বাসটার গায়ে মুহুর্তের ভিতর আগুন লেগে গেছিল ঠিক তেমন ভাবে ছুটন্ত লোকটার গায়ে মুহুর্তের ভিতর আগুন লেগে গেল ।
তানজিনা ভাবতে পারছে না কি হল !
কেমন করে হল !
কয়েক মুহুর্ত তানজিনা কেবল দেখলো ।
তারপরই ঐ লোকটার আকাশ ছোঁয়া চিত্কার কানে এল ।
সত্যিই কি এটা হচ্ছে ?
তানজিনা নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছে না । একটা জ্বলন্ত মানুষ তার সামনে এদিক ওদিক ছোটা ছুটি করছে । আর চিত্কার করছে ।
এই লোকটাই একটু আগে বাসে আগুন ধরিয়ে দাত বের করে হাসছিল আর এখন ?
তানজিনা ছায়ামুর্তির দিকে তাকিয়ে দেখলো লোকটা আবারও অন্ধকারের ভিতর হারিয়ে গেল ।
ঐ দিকে বাসটার কাছে লোকজন ছুটে আসতে শুরু করেছে এই দিকে জ্বলন্ত মানুষটাও নিস্তেজ হয়ে পরেছে । একটু আগে এদিক ওদিক দৌড়াচ্ছিল এখন রাস্তার উপয়ে শুয়ে পড়েছে ।
তীব্র মাংশ পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে ।
তানজিনা আর নিতে পারছে না দৃশ্যটা । মুখ ঘুরিয়ে শাহবাগের দিকে হাটা দিল ।
ততক্ষনে পুলিশের কয়েটা জিপ পৌছে গেছে ঘটনা স্থলে ।
বেশ রাত । ঢাকা মেডিকেল কলেজের বহিঃবিভাগের পাশে একটা বড় কড়ই গাছ ।
রাশেদ অনেক্ষন সেই গাছটার নিচে বসে আছে চুপ করে । আজ অনেক দিন পরে ওর মনে একটু শান্তি অনুভব হচ্ছে ।
আজকে নিজের হাতে একটু কুকুরের বাচ্চার গায়ে আগুন ধরিয়ে দিতে পেরে ওর ভাল লাগছে ।
দেখ শালা কুকুরের বাচ্চা কেমন লাগে ?
কোন দিন ভেবে দেখেছিস কেমন লাগে যখন অন্য পুড়ে যায় তোদের ছোড়া ককটেল বোমায় ?
গত হরতালে ঠিক এমন একটা কুকুরের ছোড়া ককটেলের রাশেদের পাঁচ বছরের মেয়ে লামিয়ার বাঁ হাতটা পুড়ে গেছে । লামিয়া ওর মায়ের সাথে বের হয়েছিল সন্ধ্যা বেলা । কিছুতেই মেনে নিতে পারে নি রাশেদ ।
কিছুতেই না । কিছুতেই মেয়ে কষ্ট সহ্য করতে পারে নি । বুকের ভিতর একটা ভয়ংকর রাগ চেপে ছিল । আজকে কিছুটা হালকা লাগছে ।
একটু আগে মেডিক্যালে খোজ নিয়েছে । ঐ লোকটার শরীরের নব্বই ভাগে বেশি পুড়ে গেছে । কিন্তু কুকুরটা এখনও বেঁচে আছে ।
থাক বেঁচে থাক ।
রাশেদও চায় কুকুরটা বেঁচে থাকুক । এতো অল্প কষ্ট পেয়ে কেন মরবি !!
রাশের উঠে হাসপাতালের দিকে পা বাড়াল । লামিয়াকে একটু দেখতে মন বলছে ।