(প্রথম)
আমার মা'য়ের জন্ম গ্রামটির নাম 'দশাল'। ময়মনসিং থেকে মোহনগঞ্জ পর্যন্ত রেলপথের বারহাট্টা নামক স্টেশনে নেমে মাইল তিনেক দক্ষিণে যেতে হয়। ফলে আমার মামারবাড়ি থেকে একটু উত্তরে তাকালে বিস্তির্ণ শস্যপ্রান্তরের পরেই দীর্ঘ উঁচু রেলপথ আমরা ছোটবেলাতেই দেখেছি। দিনে দুবার রেলগাড়ির যাওয়া আসা দেখাটা ছিলো আমাদের পরম প্রাপ্তি।
মা'য়ের কাছে শুনেছি তাঁর ছোটবেলায় নাকি এই রেললাইন পাতার কাজ হয়েছিলো। এবং কাজ শেষে হয়ে চলেছিলো রেলগাড়ি । তো মায়ের ছোটবেলা কোন সন হতে পারে? মা বেঁচে থাকলে এখন বয়স হতো নব্বইএর বেশী। তাহলে ছোটবেলা বলতে ধরা যাক পঁচাশি বছর আগে । আজ থেকে পঁচাশি বছর আগে মানে মোটামুটি ১৯২৫ সন। আরো শুনেছি প্রথম প্রথম রেলগাড়ি দেখতে আবালবৃদ্ধবনিতা দৌড়োত রেললাইনের দিকে । কিন্তু বিশাল প্রান্তর পার হতে হতেই রেলগাড়ি মিলিয়ে যেত।
পরবর্তী জীবনে আমাদের জন্মের পর মা এই রেলের বেশ নিয়মিত যাত্রী ছিলেন। কারন তাঁকে তখন বাপের বাড়ি আসতে হতো সংসারের নানা সংস্থানের জন্য। আমাদেরও প্রথম রেলযাত্রা বলতে মোহনগঞ্জ থেকে উঠে মাঝখানে ছোট্ট স্টেশন 'অতিথপুর' এবং তারপরই বারহাট্টা। এই সামান্য রেলযাত্রায় ছোটবেলাতেই অতৃপ্তি ছিলো বেশ। বাড়ি থেকে চার মাইল পা'য়ে হেঁটে এসে মাত্র এইটুকু রেলযাত্রা। তারপর নেমে আবার তিনমাইল হাঁটা।
মা'য়ের বাপের বাড়ি অর্থাৎ আমার মামার বাড়ি বলতে যা বোঝায় তখন আর সেসব কিছুই নেই। আমার দাদু মারা যাবার পর দিদিমা কলকাতা চলে যান এই জীবনের মত। ওখানে ওনার ছেলেরা মানে আমার মামারা থাকতেন। ফলে ফেলে যাওয়া যৎসামান্য জমিজমা যা ছিলো তা আমার মাকেই দেখা শোনা করতে হতো। আসলে এর থেকে কিছুটা আয় হতো যা ঐসময় আমাদের সংসারে খুবই প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিলো। আমার কর্মবিমুখ বাবার আমরা মোট নয় জন সন্তান ছিলাম। তাদের ভরণপোষণের দায়দায়িত্ব কেমন করে যেন আমার মা'র উপরেই বর্তে ছিলো। আসলে সন্তানের জন্ম এবং তাদের বেঁচে থাকার পারস্পরিক দায় ঐযুগে একলা মা'কে বহন করতে হয়েছিলো কেন তা নিয়ে আমি মনে মনে বাবার প্রতি অপ্রসন্ন ছিলাম সেই ছোটবেলা থেকেই।
প্রায় নিরক্ষর একজন মা' নিয়মিত আয়শূন্য একটা সংসার কীভাবে যে টেনেছেন তা আজ ভাবলে অবাক লাগে। শুধুত খাওয়া পরা নয় অসুখে বিসুখে শোকে দু্খে বিশাল দুই ডানা দিয়ে যেন আগলে রেখেছিলেন। তাঁর এই পাহাড় প্রমাণ দায়ভার থেকে মুক্তি পেলেন পৌঢ় বয়সে এ । ৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যখন সীমান্ত পার হয়ে আরো অনেকের সংগেই চলে এসেছিলেন তার বড় ছেলের কাছে। পরবর্তীতে আমার বাবা যখন আবার দেশে ফিরে গিয়েছিলেন তখন আর মা' যাননি সংগে। তার এই না যাওয়া নিয়ে ঐ সময়ে আমাদের সমাজ সংসারে অনেক সমালোচনার ঝড় উঠেছিলো । মা' তার চরিত্র অনুযায়ী সেসব গ্রাহ্য করেননি । আমরা যারা আরো অনেক আগে প্রায় শৈশবেই দেশ ছেড়েছিলাম পরবর্তীতে তাদের মধ্যে অন্ততঃ আমার সেই ফেলে আসা দেশবাড়ীর জন্য মন ব্যাকুল হলেও মাকে দেখেছি শেষ বয়সে তার ঐ পিছুটান ছিলোনা। কখনই কি তার নিজের হাতে গড়া বাড়িঘরসংসারের অবশিষ্টগুলো দেখার সাধ জাগেনি? মনে হয় জাগলেও তার প্রকাশ তিনি রুদ্ধ রেখেছিলেন কোনো কারণে। (ক্রমশঃ)
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মে, ২০১০ সকাল ১১:৫০