(চতুর্থ)
আমি যে সময়পরিসরে দাঁড়িয়ে আমার কথাগুলো বলছি তা ৫০/৬০ দশকের সময়কার কথা। আর যে জায়গায় দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছি তা বর্তমান বাংলাদেশের একটি প্রান্তিক অঞ্চল । তখনকার দিনেও তা হয়তোবা ছিল সবচাইতে অনুন্নত অঞ্চল । ছোটবেলায় সেখানে কোনো চাকার ব্যবহার দেখিনি। সারা গ্রামের সবেধন নীলমনি ছিল একটি টিউবওয়েল। খেলাধূলা শেষে ক্লান্ত পিপাসার্ত সবাই দল বেঁধে তার ঠান্ডা মিষ্টি জল কত যে খেয়েছি। কিন্তু সেও কখনো কখনো বিগড়ে যেত। আর সেই সুত্রেই গ্রামে আসতো একটি বাইসাইকেল । চালক এবং বাহন দু’ই আমাদের চোখে ছিলো অপার বিস্ময়। চালকের পোশাকও আমাদের দেখা প্রথম প্যান্ট শার্ট। তাও আবার গুজে পরা। মাথায় হ্যাট। সাইকেলের রডে ঝোলানো তার ব্যাগে থাকতো নানা যন্ত্রপাতি। তাই দিয়ে তিনি আমাদের দেখা সবচে বিস্ময়কর মানুষের মত টিউবওয়েলটা সারাই করতেন। তার যত সময় লাগতো আমরা ততসময়ই তাকে ঘিরে বড়দের নানা বকাঝকা উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকতাম। ততসময়ই আমাদের অনেকগুলো কচি হাতের স্পর্শ পেতে থাকত তার সাইকেলটিও। কাজ শেষে বাড়ির বড়দের সংগে কথা বলে তিনি যখন হাত মুছতে মুছতে তার সাইকেলের হ্যান্ডেলে হাত রাখতেন তখন আমরা মনে মনে প্রকৃতই ভেঙ্গে পড়্তাম। কিন্তু বড়রা তখন আমাদের জোর ধমক দিত। কারণ তখনও আমাদের কারও কারও হাত তার সাইকেল ছুঁয়েই আছে।
অবশেষে তিনি সাইকেলে চড়ে কিছুটা দূর গিয়ে আমাদের ভয় জাগানো জঙ্গলের পথে মিলিয়ে যেতেন। আমরা সব বাধা উপেক্ষা করে তার পিছুপিছু কিছুটা গিয়ে জঙ্গলঢাকা পথটাকে অভিশাপ দিয়ে ফিরে আসতাম।
আমাদের এইসব প্রান্তিকতাগুলো যত সময় পেরিয়েছি ততই আমাদের ধরতে চেয়েছে চেপে আর আমরা চেয়েছি তার থেকে মুক্তি ।
আর তখন এই মুক্তির স্বপ্নটি যার মাধ্যমে আমাদের সংসারে ঢুকে পড়লো এবং কালক্রমে ডালপালা ছড়িয়ে ফেলল তিনি আমার মা । তখনকার প্রথা অনুযায়ী অধিকাংশ নারীদের মত আমার মা’ও প্রায় নিরক্ষর ছিলেন। কিন্তু তিনি স্বাক্ষরতার ভবিষ্যতটা বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন। ফলে ছেলেরা বড় হয়ে গেলে প্রতিবেশীদের ঘরে যেখানে লেখাপড়া ছেড়ে জমিজিরেতের কাজে লেগে যেত সেখানে তিনি তাঁর ছেলেদের শতকষ্ট হওয়া সত্ত্বেও আত্মীয়স্বজনদের বাড়ীতে রেখে পড়াশোনা করিয়ে যাচ্ছেন । এরজন্য গঞ্জনাও তাঁকে কিছু কম শুনতে হয়নি ।
যাক্ খুব ভালো ছাত্র না হলেও আমরা ভাই বোনরা মা’য়ের কষ্টের একটা মূল্য তৈরি করতে পেরেছিলাম ঠিকঠাক পাশটাশ করে। ফলে যাবতীয় গঞ্জনার একটা নীরব উত্তর মা’র কাছে তৈরি ছিলই।যদিও তিনি সন্তানের কোনো সাফল্যের কথা নিজ মুখে কোনো দিনই বলতেননা। এব্যাপারে তাঁর একটা সংস্কার ছিলো যে মা’য়ের মুখে নিজের সন্তানের সাফল্যের কথা বললে সন্তানের অমঙ্গল হয়।