৬)
তৎকালীন রীতিতে সমাজ সংসারে একজন মহিলা খুব দৃশ্যমান ছিলেননা। বিশেষত বর্ণহিন্দু অথবা উঁচু শ্রেণীর মুসলমান সমাজে। বাড়িঘরের কাজ, সন্তান উৎপাদন ইত্যাদিতে তাঁরা অন্তঃপুরেই বেশীরভাগ ব্যস্ত থাকতেন। আর এই সুত্রেই তাদের সক্ষমতার উপর নির্ভর করত তাঁদের স্বীকৃতির প্রশ্নটি। অন্তত হিন্দু সমাজে দেখেছি এই স্বীকৃতির প্রশ্নটি খুবই নির্মম। গা গতরে পরিশ্রমী, সন্তান উৎপাদনে পারদর্শী—নীরোগ—স্বল্পাহারী–ইত্যাদি অবশ্য গুনগুলো থাকা জরুরী। এসবের পরে আসে যৌথ পরিবারে সবার মন জুগিয়ে চলা। আর তারপরই তার স্বীকৃতি। মানবিক সম্পর্কের শুরুটা কার ভাগ্যে কতটুকু জুটবে তা ঈশ্বর জানেন। তবে নিতান্ত জৈবিক কারণে সন্তানের সঙ্গে হয়তো তা একরকম তৈরি হত। স্বামী স্ত্রী সম্পর্ক একটা চক্ষুশূল সম্পর্ক। এটা ভালো হলেও জ্বালা । খারাপ হলেও জ্বালা। কৃষিজীবী সংসারে তৎকালীন সময়ে প্রেম ভালোবাসা খুবই অচেনা বিষয় ছিলো। বিশেষতঃ পূর্ববঙ্গীয় গ্রাম সমাজে বঙ্গজীবনের কোনো রকম সংস্কার আন্দোলন তথা রেণেঁসার স্পর্শ ছিলোনা। নানান অচলায়তনের বাসভূমি হিসেবেই তা নির্দিষ্ট ছিলো। নারী পুরুষের সম্পর্কটা যেন কৃষিজীবী জীবনের সার্থকতার আর দশটা ব্যবহারিক উপকরণের একটা । এখানে চাহিদা –যথাসম্ভব সন্তান দাও–আর সেটা অবশ্যই পুত্র সন্তান–মনে রেখো পুত্রে লাভ কন্যায় ক্ষতি—। এটা যেন গর্ভধারিনীর ইচ্ছানির্ভর বা ক্ষমতানির্ভর। তখন কন্যাভ্রূণ গর্ভে নষ্ট করার কারিগরীটা জানা ছিলোনা ভাগ্যিস! জানা থাকলে —।
আবার ক্ষেত্র বিশেষে দক্ষতার অভাব হিসেবে দেখা নিঃসন্তান মহিলার কপ[লে জুটতো বিশেষণ–”বাঁজা মাইয়াছেলে”। যার মুখ দেখে ঘর থেকে বেরোনো সাক্ষাৎ অমঙ্গল। তা ছাড়া সমাজ সংসারে অনেক শুভ কাজে তার উপস্থিতি নিষিদ্ধ। সন্তানহীনতার দায় মাথায় নিয়ে পুরুষ নয় একজন নারীকেই সারাজীবন অতিবাহিত করতে হয় আত্মহত্যার আগের ধাপটিতে বসবাস করে।
ঘটনা চক্রে আমার মা’, আগেই বলেছি, সংসারের চাপে কখনই অন্তঃপুরবাসিনী ছিলেননা । জ্ঞান হওয়ার পর থেকে তাঁকে দৃশ্যামানই দেখেছি। কারণ সন্তান ছাড়াও কৃষিনির্ভর পরিবারের সব দায় তাঁকেই মেটাতে হতো। দু’তিন বছরের তফাতে যে সন্তানেরা তাঁর গর্ভ থেকে কোলে এসে উঠে পড়েছে তাদের জন্য তাঁর দায় যেন নিছক দায় ছিলোনা–ছিল তারও কিছু বেশি । এটা তাঁর অস্তিত্বের প্রশ্নও ছিলো। শুধু যেন বেঁচে থাকা নয়–বেঁচে থাকার মধ্যেও এক সঠিক লক্ষ্যে বেঁচে থাকার জেদ যেন তাঁকে শত ক্লান্তি বিরক্তিতে লক্ষ্যচ্যুত হতে দেয়নি । কর্মবিমুখ স্বামীর সংসারে নিরুপায় তিনি তাই যেন শুধু ভবিষ্যতই দেখতে চাইছিলেন । আর এই দেখতে দেখতেই কবে যে তাঁর যৌবন কেটে গেছে—কবে যে তাঁর প্রৌঢ়ত্ব এসে গেছে, তা বোধ করার হয়তো অবকাশও পাননি।
সুন্দরী নয়, হয়তো সুশ্রী ছিলেন সকলের চোখে। ফর্সা ছিলেননা । হয়তো গভীর জলের মত শ্যামলী ছিলেন। রুগ্ন ছিলেননা। ছিলেন নিখুঁত স্বাস্থ্যবতী । গড়নে শক্তি এবং আত্মবিশ্বাসের একটা গভীর মিশেল —যার মধ্যে একটা মাতৃত্বের প্রলেপ যা বোধ হয় তাঁর স্বভাবের কথাই বলত ।
এই সব মানুষেরা সংসার থেকে খুব সামান্যই নেন। কিন্তু দিয়ে যান অনেকটাই । অনেকদিন পর আজ আবার মনে পড়ছে যে মা’র কোনো বড় অসুখের কথা শুনিনি কখনো। প্রায় ৮৬ বছর বেঁচে থাকা মানুষটির মৃত্যুর বছর দশেক আগে ধরা পড়েছিলো শুধু রক্তে সুগার। যাকে মা’ কখনোই কোনো অসুখ বলে মনে করতেননা। ঠাকুরের প্রসাদী মিষ্টি খেতে বারণ করলে বলতেন –ডরাইছনা–আমার এইতায় কিছু অইতনা—ঠাহুরের প্রসাদ—।