বাঙালিরা বানিজ্য করতে বিদেশ গেছে শোনা যায়, কিন্তু উপনিবেশ স্থাপন করতে বিদেশ গেছে তেমন শোনা যায়নি । বরং যুগে যুগে বিভিন্ন ধর্মের, রঙের বিদেশীদের দ্বারা শাসিত হয়েছে । এর দ্বারা একটা বিষয় পরিস্কার যে বাঙালিরা মোটেও কোন যোদ্ধা জাতি নয়। জীবন জীবিকার অনুকুল জলমাটিবাতাস যুগ যুগ ধরে বাঙালির প্রকৃতি নির্মাণ করেছে । জীবন ধারণের মৌলিক প্রয়োজনে তাকে কখনো তেমন করে পরদেশের দিকে তাকাতে হয়নি । সেই কারণেই কি তার প্রকৃতি নরম, কিংবা অন্যের দ্বারা সহজে প্রভাবিত হওয়ার একটা ব্যাপার থেকে গেছে ?
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে বাঙালিদের অবদান অসামান্য। কিন্তু ভারতবর্ষের ক্ষমতা- কেন্দ্রে তখন তার উপস্থিতি খুবই সামান্য । সেখানে অবাঙালি তথা আপকান্ট্রির হিন্দু এবং মুসলিমদেরই রমরমা । আর এই আন্দোলন কেন্দ্র করেই বাঙালির পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্টের ক্ষেত্রেও এই দুই কিসিমের অবাঙালিদের অবদান অস্বীকার করা যাবেনা । অস্বীকার করা যাবেনা কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের অবদানও । আপকান্ট্রির হিন্দু এবং মুসলমান উভয় ধর্মের মানুষেরাই বাঙালি হিন্দু এবং মুসলমানদের এটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে তারা হিন্দু বা মুসলমান হিসেবে ততটা উৎকৃষ্ট নয় যতটা যার যার ধর্ম দাবি করে । এটা একটা সাংঘাতিক ধর্ম বিচ্যুতি । কারণ ভগবান বা আল্লা বাঙালি চেনেনা । চেনে হিন্দু বা মুসলমান । নরম মনের বাঙালির বোধ হয় এটা বিশ্বাস করতে অসুবিধে হয়নি ।
আসলে এসব সম্পর্ক নষ্ট শুরু হয়েছিল সে দিন থেকে, যে দিন থেকে আমরা ভাবতে শুরু করেছিলাম আমরা প্রথমে হিন্দু তারপর বাঙালি বা আমরা প্রথমে মুসলমান তারপর বাঙালি । বাঙালি জাতিসত্বাটার নির্মাণ কবে থেকে প্রয়োজন বা শুরু হয়েছিল তার সন তারিখ এর হিসেব না থাকলেও জিনিষটা ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিসরে মোটেই গুরুত্ব পায়নি কখনোই । কারণ তার একদিকে ধর্ম আর এক দিকে ভারতীয়ত্ব । তাদের বিপরীত মুখী টানে আমরা চটপট গিলতে পেরেছিলাম দ্বি-জাতি তত্ব, দেশভাগ---ইত্যাদি । আর তা যে বাঙালি জীবনে কত ভয়ানক এক অভুতপূর্ব বিপর্যয় নামিয়ে এনেছিল তা বলা বাহুল্য । যদিও পরবর্তীতে এই বিপর্যয়ের ভিতর থেকেই এক অংশের বাঙালির মধ্যে এক মহৎ স্বপ্নের জন্ম হয়েছিল । আর সেই স্বপ্নটির নাম "বাংলাদেশ"। আর এসবই আমদের খুব নিকট ইতিহাস ।
(চলবে)