গত ১১ই জুন রাতে গিয়েছিলাম বান্দরবান, তারই গল্প লিখতে বসেছি এখন। গিয়েছিলাম আমরা সাড়ে চারজন, আমি ও মিসেস সাথে আমাদের দেড় বছরের মেয়ে, আরো ছিলো আমার বন্ধু ও বন্ধুপত্নী (নিউ কাপল)।
১১তারিখ রাতে বাসে চড়ে বসি আর পরদিন ১২ তারিখ সকালে পৌছাই বান্দরবানে। এখানে আমার এক খালু আমাদেরকে রিসিভ করেন বাসস্টপে। খালুর সহায়তায় হোটেলে উঠি বাসস্টপ থেকে একটু সামনে “হোটেল হিলবার্ড”-এ।
হোটেলে উঠার পরে সকলে ফ্রেস হয়ে সকালের নাস্তা করতে করতে খালুকে জানাই আমাদের আজকের ভ্রমণ তালিকায় রয়েছে দুপুরের আগে রাজবাড়ি ও উপজাতীয় জাদুঘর দেখা। আর দুপুরের পর মেঘলা, স্বর্ণ মন্দির ও সব শেষে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সঙ্গু নদে নৌভ্রমণ। আমাদের পরিকল্পনা শুনে খালু জানালেন, এখন কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বেড় হলেই চলবে, কারণ রাজবাড়ি আর জাদুঘর রিক্সানিয়ে খুব অল্পসময়েই দেখে ফেলতে পারবো। কিন্তু সাঙ্গুতে নৌভ্রমণের পরিকল্পনা বাদ দিতে হবে। কারণ গত দুদিন বৃষ্টি হওয়ার ফলে নদে প্রচণ্ড স্রোত থাকবে। তাছাড়া বর্ষার এই সময় এমনিতেই নৌকা চলাচল কমে যায়। তবে চাইলে হাসপাতালের সামনে তৈরি হওয়া নতুন ব্রীজ থেকে ঘুরে আসতে পারি।
খালুর কথা শুনে আমাদের মন একটু খারাপ হয়ে গেলো। নৌভ্রমণটা খুবই উপভোগ্য হতো। তাছাড়া আমি জানি সাঙ্গুর রূপের কথা, বেশ কবছর আগে আমি রুমা পর্যন্ত গিয়েছিলাম নৌকায়। সঙ্গু আর তার চারপাশের রূপের কথা লিখে বা বলে বুঝানো সম্ভব নয়। যাইহোক খালুর পরামর্শ মত আমরা বিশ্রাম নিয়ে রেডি হয়ে গেলাম বের হওয়ার জন্য। এখানে আমাদের পরিকল্পনা একটু চেন্জ করে প্রথমেই চলে আসি মেঘলাতে। বাজারের বেবীস্টেন্ড থেকে বেবী নিয়ে সকলেই চড়ে বসি তাতে। ভট-ভট শব্দে এগিয়ে চলে আমাদের বাহন পাহাড়ি উঁচু নিচু রাস্তা ধরে। রাস্তার একপাশে উঁচু পাহাড় আর একপাশে বিশাল খাঁদ। পাহাড়ে ফুটে আছে নাম না জানা নানান রং-বেরং এর ফুল, বিভিন্ন আকার আর আকৃতির। খাঁদের দিকে দূরে দেখা যায় আরো অনেক পাহাড়ের সারি, সারি সারি সবুজ গাছে ছাওয়া। বর্ষায় পাহাড়ের রূপ সত্যিই অনন্য, বৃষ্টি ভেজা পাহাড় যেন গাড়-ঘন সবুজ কার্পেটে মোড়া। এসব দেখতে দেখতেই একসময় পৌছে যাই মেঘলাতে। মেঘালে আছে বিশাল কৃত্তিম লেক আর লেকের স্বচ্ছ জল, আছে লেকের উপরে দুটি ঝুলন্ত সেতু যার একটি আবার ঝুঁকিপূর্ণ। আছে টিলার উপরে ছোট্ট কটি খাঁচায় পাখি, খরগোস, বাদর, ভালুক আর হরিণ। সিজনে থাকে লেকের জলে বোটিং ব্যবস্থা, আর ক্যান্টিনে খাবার বন্দবস্ত। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে মেঘলায় আছে জল-পাহাড় আর সবুজ প্রকৃতি। এখন সবুজে সবুজে সায়লাব হয়ে গেছে গোটা বান্দরবানের পাহাড় সারি, বাদ যায়নি মেঘলার পাহাড়গুলিও। বেবীটিকে এক ঘন্টার জন্য বসিয়ে রেখে আমরা ঢুকেপরি মেঘলাতে। গেট থেকে ঢালু পথ ধরে আসতে আসতে নামতে থাকি আমি মেয়েকে কোলে নিয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে পিচ্ছিল হয়ে গেছে নামার পথ। নিচে নেমে আসতে আসতে হেঁটে যেতে থাকি ঝুলন্ত সেতুর দিকে। ঝুলন্ত সেতু দিয়ে পার হওয়ার সময় এমন ভাবে দুলতে থাকেযে কিছুক্ষন পরে মনে হয় সেতু নয় বরং দুলছে নিচের লেকের কাকচক্ষু স্বচ্ছ জল। সেতুটি পার হয়ে কিছু সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে এসে বসি একটি ছাউনির নিচে। এখান থেকে আবার আরো কিছু সিঁড়ি টপকে উঠে পরি একটি টিলার চূড়ায়। এখান থেকে অনেকটা দূর পর্যন্ত দেখা যায় লেক আর পাহাড়। বর্ষার বৃষ্টি জল সবুজ পাহাড়ি গাছগুলিকে দিয়েছে নব যৌবন। এখান থেকে নেমে আমরা এবার গিয়ে বসি লেকের জলের ধারে। লেকের জলে খেলা করে যাচ্ছে মৃদু মন্দ হাওয়ায় তিরতিরে ঢেউ। এই মৃদু মন্দ হাওয়ায় নীল আকাশের বুকে সাদা মেঘেরা ভাসায় ভেলা অজানার পথে।
অনেকটা সময় পার হয়েছে এবার ফেরার পালা, যে ঢালু পথ ধরে নেমে এসেছি সেখান দিয়ে না উঠে পাশের সিঁড়ি বেয়ে উঠবো বলে এগুতে থাকি। এখানে কাঁঠাল গাছগুলিতে মাঝারি আকারের কাঁঠাল ধরে আছে, একটা কাঠাল দেখলাম কিছুটা খেয়ে ফেলেছে কোনো প্রাণীতে। পাশের গাছেই দেখা পেয়ে গেলাম সেই প্রাণীটির, কাঠবিড়ালি। এক ডাল থেকে আরেক ডালে ছুটতে ছুটতে একসময় আমাদের চোখের আড়াল হয়ে গেল। সিঁড়ির কাছেই একটি জাম গাছে দেখলাম জাম ধরে আছে, পেঁকেছেও কিছি কিছি নিচের দিকের ডালে। আমি আর আমার বন্ধু লাফিয়েই পেড়ে ফেলতে পারলাম কয়েটা জামের থোকা। এবার জাম খেতে খেতে সিঁড়ি বেয়ে উঠা ঘামতে ঘামতে। তারপর অপেক্ষমান বেবীতে উঠে ফিরে আসি হোটেলে।
হোটেলে ফিরে সকলেই ফ্রশে হয়ে বিশ্রাম নিতে গাঁ এলিয়ে দেয় বিছানায়। তার আগেই জানিয়ে দেয়া হয়েছে এবার আমরা বের হবো দুপুরের খাবার খেয়েই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কিন্তু বিধিবাম কপাল খারাপ। দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস না থাকায় আমাকে বিছানায় শুয়ে শুয়ে বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুনছি আর ভাবছি আজকের রুটিন আর বোধহয় ফিলাপ হলো না। একসময় বিছানা ছেড়ে উঠে আমি চলে আসি সামনের ঝুল বারান্দায়। দঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি দূর পাহাড়ে বৃষ্টির খেলা। বারান্দা থেকেই দেখা যায় একটু দূরের তিনটি পাহাড়ের চূড়া। এখান থেকেই দেখছি বৃষ্টি হচ্ছে একটি পাহাড়ের গায়ে, সেই বৃষ্টিই দেখতে দেখতে দ্বিতীয় তৃতীয় পাহাড় হয়ে এসে পড়লো নগরের কালো পিচের রাস্তায়। ভেজা রাস্তা আবারো ভিজলো, ভিজলো রাস্তায় চলতে থাকা রিক্সা আর পথচারীরাও। পাঁচ মিনিটের বৃষ্টি, যেমন এসেছিলো হঠাত করে তেমনি চলেও গেলো হঠাত করেই। আবার শুরু হতেও দেরি হয়না তার। ১০ মিনিদের মাথায় আবারো সেই দূরপাহাড় থেকে শুরু করে চলে আসে নগর পর্যন্ত ৫/৭ মিনিট পরে স্তব্ধ হয়ে যায় তেমনি ভাবেই। এভাবেই চলতে থাকে দুপুর থেকে। বাকিদের ঘুম না ভাঙ্গিয়ে আমি একা একাই এই খেলা দেখতে থাকি চুপচাপ। অনেকক্ষণ পর ইস্রাফিল এসে দাঁড়ায় আমার পাশে, এতোক্ষণে বৃষ্টি কিছুটা কমে এসেছে। অল্পক্ষণ পরে বৃষ্টি থেমে গেলে বাকিদের ঘুম থেকে তুলে সামনের এক রেস্টুরেন্টে যাই দুপুরের খাবার খেতে।
খাওয়া দাওয়া সেরে আবার সকলে বেরিয়ে পরি উপজাতী জাদুঘর আর রাজবাড়ি দেখতে। দুটি রিক্সা নিয়ে চলে আসি রাজবাড়িতে- হতাশা হতাশা হতাশা। কিচ্ছু নেই, শুধু আধুনিক একটি দালান দাড়িয়ে আছে দর্শকদের ব্যঙ্গ করতে। রাজবারি খচিত একটাই জিনিস আপনার চোখে পরবে, তাহলো একটি সিংহদ্বার। এখান থেকে হতাশ হয়ে রিক্সাওয়ালাদের বললাম উপজাতী জাদুঘরে নিয়ে যেতে। ওরা আমাদের নিয়ে এলো রাজবাড়ির নিকটেই একটি স্থানে যার নাম “কেংঘর”। রাজবাড়ি থেকেই এই কেংঘর সংলঙ্গন একটি বুদ্ধ কেং এর চূড়া আপনার চোখে পরবে। ছোট একটি টিলার উপরে আছে একটি বুদ্ধ মন্দির। এর ভিতরে জুতা খুলে যেয়ে দেখি রয়েছে বেশ বড় একটি বুদ্ধ মূর্তী। এখান থেকে বেড় হয়ে দ্বিতীয় একটি চূড়াতে দেখতে পেলাম বেশ কটি বুদ্ধ কেং। এই চূড়া থেকে নামরেই আমরা দেখতে যাই সামনের জাদুঘরটি। ভিতরে ঢুকতেই একজন বুদ্ধ ভিক্ষু আমাদের জানালো এটা জাদুঘর নয় বুদ্ধদের ধর্মীয় স্কুল। তাহলে যাদুঘর কোথায়? এখান থেকে খুব বেশী দূরে নয়। কিন্তু আমরা আর জাদুঘর দেখতে গেলাম না। খালুর জানানো হাসপাতালের কাছের সেই সেতু দেখতে যাওয়ার উদ্দেশ্যেই আবার রিক্সা নিলাম।
অল্প সময়েই পৌছে গেলাম ব্রীজে। চমৎকার লাগলো, কুছিটা সময় এখানে কাটাবো ভেবে রিক্সা ছেড়ে দিলাম। নাদের ঘোলা জল - পাড়ে তোলা ছিপছিপে নৌকা - দূরের বৃষ্টি জলে ভেজা সবুজ পাহাড়, সব কিছুই ছবির মত। ঘোলা জলের প্রচণ্ড স্রোত বুঝা যাচ্ছে এতটা উপর থেকেও। সেতুতে জানবাহন নেই বললেই চলে। আমার মেয়েটা গ্রীল ধরে পাঁ উঁচিয়ে দেখার চেষ্ঠা করছে নিচের বয়ে চলা পানি। পাশের এক ভদ্রলোকের সাথে আলাপ করে যানা গেল কাছেই একটা নৌকা ঘাট আছে কিন্তু কোনো নৌকা সেখানে পাওয়া যাবে না, কারণ এই সময় সমস্ত নৌকা পাড়ে তুলে ফেলে মেরামত করা হয়। হঠাত করেই মিসেস ডেকে বললো “দেখে যাও পাহাড়ে কি চমৎকার বৃষ্টি হচ্ছে।” সত্যিই চমৎকার দৃশ্য দূরের সবুজ পাহাড় ধীরে ধীরে ঢেকে যাচ্ছে বৃষ্টির সাদা চাদরে। যদিও পাহাড় আর বৃষ্টির খেলা চলছে দূরের পাহাড়ে কিন্তু সারা দুপুরের অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি এখনি এই বৃষ্টি আমাদের ভেজাতা ছুটা আসবে। মেয়েকে যাতে রদে কষ্ট পেতে না হয় এই ভেবে ছোট্ট একটা ছাতা নেয়া হয়েছিলো ঢাকা থেকেই যেটা এখনো আছে ওর মার পার্সেই। সেই ছাতা বেড় করতে করতেই বৃষ্টি চেলে এসেছে পাহাড়া ভিজাতে ভিজাতে সাঙ্গুর ঘোলা জলের মাঝা মাঝি। এবার শুধু আমার হাতে ছাতা আর কোলে মেয়ে। ব্রীজে উঠার মুখেই ছিলো একসারি ঝাঁকরা ঘন পাতাওয়ালা আম গাছ। আমারা ছুটছি সেই আম গাছের দিকেই, যদি একটু আশ্রয় মেলে। যখন আম্রকানন তলে এলাম আশ্রয়ের আশায় তখন সকলেই কাক ভেজা হয়ে গেছে পাহাড়ি বৃষ্টির ছাটে। আমাদের মতো আরো কয়েকজন স্থানীয় পাহাড়ি মহিলা আশ্রয় নিয়েছে গাছের নিচে। কিন্তু অল্প কিছুক্ষণ যেতে না যতেই পাতা ভিজে জল ঝরতে লাগলো সকলের গায়ে। শুধু আমি আর আমার মেয়ে ভিজছিনা ছোট্ট ছাতার কল্যানে। ভিজেই যখন যাচ্ছি তাহলে ভালো করেই ভিজি বলে বাকিরা সবাই নামলো বৃষ্টিতে ভিজতে, কিন্তু পাহাড়ি বৃষ্টি তার দুপুরের চরিত্রে আবারো অবতীর্ন হলো, দুমিনিট পরেই থেমে গেল ওদের আধ ভেজা রেখে।
এবার কি করা হবে! আধ ভেজা অবস্থায় স্বর্ণ মন্দির যাবো নাকি হোটেলে ফিরবো? স্বর্ণ মন্দির গেলে এখনই রওনা হতে হবে, কারণ বিকেল হয়ে গেছে অনেকক্ষণ, সন্ধার পরে স্বর্ণ মন্দির বন্ধ হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত স্বর্ণ মন্দির যাওয়ারই স্থির হলো। বেবী নেয়ার উদ্দেশ্যে একটু হেঁটে আমরা এসে দাঁড়ালাম হাসপাতালের সামনে। এখানে এসে মেয়েকে যেইনা নামিয়েছি নিচে ওমনি পিছলে পরে গেলো কাঁদা-বালিতে। সেই কাঁদা বালি মিনারেল ওয়াটারে ধুয়ে ব্যাটারি চালিতো একধরণের টেম্পোতে করে রওনা হলাম স্বর্ণ মন্দিরের উদ্দেশ্যে। একটু পরেই খালু ফোন করেন আমরা কোথায় জানার জন্য। বললাম যাচ্ছি স্বর্ণ মন্দির। খালু জানালেন ১৮০টি সিঁড়ি উঠতে হবে খুব সাবধানে, কারণ বৃষ্টিতে ভিজে পিচ্ছিল হয়ে আছে সেগুলি। আর রাতে যেন তার বাসায় খাওয়া দাওয়া করি তা বার বার মনে করিয়ে দিলেন। ১৮০টি সিঁড়ি উঠতে হবে শুনে একটু ভয় পেয়ে গেলাম। ১৮০০টি সিঁড়ি টপকে সীতাকুণ্ডের মন্দির দেখে এসেছি আমি কিন্তু এবারযে কোলে আছে আমার মেয়ে!
শব্দহীন এই ব্যাটারি চালিত টেম্পো খুব একটা জোড়ে ছুটতে পারে না, এক সময় তো মনে হতে লাগলো আজ আর সময় মত পৌছতে পারবো না স্বর্ণ মন্দির। কিন্তু না। এক সময় শেষ হয় এই নিঃশব্দ যাত্রা, ড্রাইভার জানায় এখান থেকে আমাদের হেঁটে যেতে হবে কিছুটা চড়াই, মন্দির দর্শনের পর আবার এখান থেকেই এই টেম্পোতেই ফিরবো আমরা। এবার হাঁটা শুরু, বেশ কিছুটা চড়াই বেয়ে উঠতে হচ্ছে আমাদের, আমার কোলে মেয়ে আর পেছন থেকে আমার গেঞ্জীর কোনা ধরে ঝুলে আছে মেয়ের মা। এমনিতেই মোটা মানুষ আমি, তাই একেবারে কাহিল অবস্থা। বন্ধু আর বন্ধুপত্নী তরতর করে উঠে গেছে আনেকটাই। নিচ থেকে ডেকে বললাম-“কাকা সিঁড়ির গোড়ায় গিয়ে থেমো, আমার মেয়েকে তুমি নিয়ে না গেলে আর উঠতে পারবো না চূড়ায়”। যাই হোক একসময় এসে পৌছাই সিঁড়ির গোড়ায়, মেয়েকে বন্ধুর কোলে দিয়ে এবার তার মাকে হাত ধরে টেনে টেনে তুলতে হয় সিঁড়ি দিয়ে। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে সন্ধ্যা হচ্ছে হচ্ছে অবস্থা, বন্ধ হয়ে যাবে মন্দিরের দ্বার। এক সময় শেষ হয় ১৮০ সিঁড়ি উঠা, এবার টিকিট কেটে ঢুকে যাই মন্দির চত্তরে। অলরেডি সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। দূর পাহাড়ে রাত তার কালো চাদর বিছিয়ে দিতে শুরু করেছে, এরই ফাঁকে যতটুকু দেখা যায় তাতেই মন ভেরে যায়, স্বর্থক মনে হয় কষ্ট করা। আর মন্দির? কি বলবো- বলে বা লিখে বোঝানো যাবে না, সত্যিই অসাধারন। ছবিও দিতে পারছি না কারণ তখনই আমার মোবাইলের ব্যাটারির চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছে। আর ডিজিটাল ক্যামেরা দিয়ে যে কটি ছবি তুরেছি তাও ভালো আসেনি, কারণ ফ্ল্যাস মন্দিরের চার ধারের সাদা টাইল্সে রিফ্লেক্স হয়ে ফিরে এসে ছবিগুলি সাদাটে করে দিয়েছে। চমৎকার সত্যিই চমৎকার এই স্বর্ণ মন্দির। এতো কষ্ট করে উঠার পরেও আমার মিসেস মন্তব্য করেছে-“বান্দরবানে যা দেখেছি তার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর এই মন্দিরটি।” আর এখানকারই এক বুদ্ধ ভিক্ষু আমাকে নামার সময় প্রশ্ন করেছিলো কেমন লাগরো মন্দির? বলে ছিলাম-“সুন্দর অসাধারন”। এই ভিক্ষই তখন জানালেন “বাংলাদেশে এই একটাই আছে স্বর্ণ মন্দির। আরো একটি তৈরি হচ্ছে এই বন্দরবানেই।” তখন সন্ধ্যা হয়েগেছে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে মন্দির। সব শেষ দর্শনার্থী হিসেবে বেরিয়ে এসেছি আমরা, তাই ইচ্ছে থাকা স্বত্তেও আরো কিছুক্ষণ আলাপ করা গেলো না তার সাথে। এবার সিঁড়ি বেয়ে নামার পালা। মেয়েকে কোলে নিয়ে নেমে আসলাম নিচে। এখান থেকে আরো কিছুটা পথ হেঁটে এসে চড়ে বসি টেম্পোতে। এতোক্ষনে চারধার অন্ধকার হয়ে গেছে, এবার হোটেলে ফেরার পালা।
হোটেলে ফিরে সকলে ফ্রেস হয়ে একসাথে বসেছি ফুটবল ওয়াল্ডকাপ দেখতে, আর্জেন্টিনার খেলা। দুপুরের সময় মাইকিং করা হয়েছে যেন সকলেই অপ্রয়োজনীয় লাইট বন্ধ রাখে ও অনেকে মিলে যেন একসাথে একটি টিভিতে খেলা দেখে। এতে করে বিদ্যুৎ কম খরচ হবে আর খেলা চলাকালিন সময় বিদ্যুৎ চলে যাবে না। ভালো উদ্যগ, আমরাও তাই করছি আমাদের রুমেই দেখা হচ্ছে খেলা। সন্ধ্যার পর থেকেই ঝিরিঝিরি ইলশেগুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কখনো তা বেড়ে গেলেও দ্রুতই সেই ইলশেগুড়ির রূপে ফিরে আসছে। এর মধ্যে আমাদের আবার রাতের দাওয়াত আছে খালুর বাসায়, খালু বার বার ফোন করছেন বৃষ্টি থামলেই আসবেন আমাদের নিতে, কিন্তু বৃষ্টি আর থামে না। খেলা যখন দ্বিতীয়আর্ধের চলছে তখন খালু চারটি ছাতা হাতে এসে উপস্থিত। তাই এবার খেলা ফেলে বের হই বৃষ্টি ভেজা পথে, রাস্তা ঘাট নির্জন শুনশান অন্ধকার নিশ্চুপ। পথে নেই কোনো লোকজন নেই কোনো যানবাহন, হেঁটে হেঁটই রওনা হতে হয় আমাদের। মেয়েকে কোলে নিয়ে এক হাতে ছাতা সমলাতে সামলাতে এগিয়ে চলি আমি বাকি সকলের সাথে। মিসের্সদের হাতে থাকা আপেলের প্যাকেট থেকে হঠাৎ করেই অনেকগুলি আপের পড়ে যায় রাস্তায়- গড়িয়ে যেতে থাকে ঢালু রাস্তার এদিকে সেদিকে। ছুটছুটি করে আবার সেই আপেল সংগ্রহ করে খালুর কাছে থাকা টর্চের আলোয়। একসময় খালুর অফিস বাংলাদেশ তুলা উন্নয়ন বোড পিছনে ফেলে আরো কিছুটা পথ হেঁটে পৌছে যাই গন্তব্যে। পৌছেই টিভি খুলে দেখি খেলা শেষ, আশা করি বুঝতে পেরেছেন কতটুকু হেঁটে এসেছি। যাইহোক একসময় চমৎকার রাতের খাবার খাওয়া শেষ করে নেমে আসি বৃষ্টি স্নাত অন্ধকার পথে, লোড সেডিং চলছে। আবার হাঁটতে হাঁটতে একসময় এসে পৌছাই হোটেলে এবং সাথে সাথেই এসে পরে বিদ্যুৎ। আমাদের পৌছেদিতে এবার খালুর সাথে খালাও এসেছেন এতোদূর।
অনেক রাত হয়েগিয়েছে এবার ঘুম, কালকে সকালেই আবার বের হবো চিম্বুকের উদ্দেশ্যে তাই এখনকার মত গুডনাইট। চিম্বুকের অন্য আরেকদিন করা যাবে।
বি.দ্র. এতো বড় একটি লেখা যদি আপনাদের বিরক্তির কারণ হয়ে থাকে তাহলে ক্ষমা চেয় নিচ্ছি, সেই সাথে অজান্তে হয়ে যাওয়া সকল ভুলগুলি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধও রইলো।
ছবি দেখতে চাইলে......
অযথা অনেক অবান্দর কথা লিখে বড় করেছি পোষ্টটি, কিন্তু যা বলা দরকার ছিলো তাই বলি নি।
কি করে যাবেন ও খরচ কেমন-
ঢাকা থেকে বান্দরবান চলে যাবেন রাতের বাসে, ভাড়া ৪৫০ টাকা।
বেবীস্টান্ড থেকে মেঘলার যাওয়া-আসার ভাড়া ২০০ টাকা।
রাজবাড়ি হয়ে উপজাতী জাদুঘর থেকে কেংঘর পর্যন্ত রিক্সা ভাড়া ২৫ টাকা।
কেংঘর থেকে হাসপাতালের সামনের ব্রীজ রিক্সা ভাড়া ৫/৮ টাকা।
বেবীস্টান্ড থেকে স্বর্ণ মন্দির বেবী ভাড়া যাওয়া-আসা ১৫০/২০০ টাকা। (ব্যাটারি চালিত টেম্পোতে গেলে আমাদের মত অনেকটুকু হাঁটতে হবে, বেবীতে গেলে হাঁটা পথটুকু বেঁচে যাবে।)
হোটেল ভাড়া ৪০০/৫০০ টাকা।
খাওয়া দাওয়ার জন্য কষ্ট করতে হবে। খাবার পছন্দ হবে না কোথাও, শুধু “রি সং সং” রেস্টুরেন্টের খাবারের মান চমৎকার। “রি সং সং” বানানটা ঠিক নেই কিন্তু উচ্চারন এটাই। রাজবাড়ির সামনে অবস্থান, খিঁচুড়ী, বিরানী বা চাইনিজ খাবার খেতে চাইলে আগে থেকে জানাতে হবে।