৩। উতঙ্ক, পৌষ্য ও তক্ষক
গুরুর অনুমতি পেয়ে বেদ নিহ গৃহে ফিরে এলেন। সেখানে তাঁরও তিনটি শিষ্য হল।
কিছুকাল পরে জনমেজয় এবং পৌষ্য নামে আর এক রাজা বেদকে উপাধ্যায়ের পদে নিয়োগ করলেন। একসময় বেদ পুরোহিতের জন্য বিদেশে যাবার সময় তাঁর শিষ্য উতঙ্ককে বলে গেলেন তাঁর বাড়ির সমস্ত কিছু দেখেশুনে রাখতে।
উতঙ্ক গুরুগৃহে থেকে সকল কর্তব্য পালন করতে লাগলেন।
একদিন আশ্রমের নারীরা উতঙ্ককে বললো- "তােমার উপাধ্যায়ানী ঋতুমতী হয়েছেন কিন্তু উপাধ্যায় এখানে নেই; তুমি উপাধ্যায়ানী সাথে মিলিতো হও, যাতে ঋতু নিস্ফল না হয়।"
উতঙ্ক উত্তর দিলেন- "আমি স্ত্রীলােকের কথায় এমন কুকাজ করবো না। গুরু আমাকে কুকাজ করবার আদেশ দেন নি।"
কিছুদিন পরে বেদ ফিরে এলেন এবং সকল কথা শুনে বললেন- "বৎস উতঙ্ক তুমি ধর্মানুসারে আমার সেবা করেছ, তােমার সকল কামনা পূর্ণ হবে। এখন তুমি স্বগহে যেতে পার।"
উতঙ্ক বললেন- "আমি আপনার গুরু দক্ষিণা দিতে ইচ্ছা করি।"
বেদ বললেন- "তুমি বহুবার আমাকে দক্ষিণার কথা বলেছ; গৃহমধ্যে গিয়ে উপাধ্যায়ানীকে জিজ্ঞাসা কর কি দিতে হবে।"
তখন উতঙ্ক গুরুপত্নীর কাছে গিয়ে জানতে চাইলেন কি দক্ষিণা দিতে হবে।
গুরুপত্নী বললেন- "তুমি রাজা পৌষের কাছে যাও, তার পত্নী যে দুই কুণ্ডল (কানের অলংকার) পরেন তা চেয়ে আনো। চার দিন পরে পুণ্যক ব্রত হবে, তাতে আমি ঐ কুণ্ডল পরে ব্রাহ্মণদের খাবার খাওয়াবো। তুমি আমার এই ইচ্ছা পূর্ণ করো, তাতে তােমার মঙ্গল হবে, কিন্তু যদি না করও তবে অনিষ্ট হবে।
উতঙ্ক কুণ্ডল আনার জন্য যাত্রা করলেন। পথে যেতে যেতে তিনি প্রকাণ্ড এক ষাঁড়ের উপর বসা বিশাল আকৃতির এক পুরুষকে দেখতে পেলেন। সেই পুরুষ বললেন- "উতঙ্ক, তুমি এই ষঁড়ের বিষ্ঠা (গোবর) ভক্ষণ করো। তােমার গুরুও এটা খেয়েছেন। তখন উতঙ্ক ষঁড়ের মলমূত্র খেয়ে দ্রুত রাজা পৌষ্যের নিকট হাজির হলেন।
উতঙ্ক রাজা পৌষ্যের কাছে রাণীর কুণ্ডল প্রার্থনা করলে রাজা বললেন- "আপনি অন্তঃপুরে গিয়ে মহিষীর কাছে চেয়ে নিন।"
অন্তঃপুরে গিয়ে রাণীর কাছে সব জানিয়ে তার কুণ্ডল প্রার্থনা করলে রাণী উতঙ্ককে কুণ্ডল দুটি দিয়ে দেন। এবং জানান যে এই কুণ্ডলের উপরে নাগরাজ তক্ষকের নজর আছে।
উতঙ্ক কুণ্ডল নিয়ে রাজা পৌষের কাছে এলেন।
পৌষ্য বললেন- "সৎপাত্র সহজে পাওয়া যায় না, আপনি গুণবান অতিথি, আপনাকে আপ্যায়ন করতে ইচ্ছা করি।"
উতঙ্ক বললেন- "গহে যে অন্ন আছে তাই শীঘ্ন নিয়ে আসুন।"
অন্ন আনা হলে উতঙ্ক দেখলেন তা ঠাণ্ডা এবং তাতে চুল রয়েছে।
উতঙ্ক বললেন- "আমাকে অশুচি অন্ন দিয়েছেন অতএব আপনি অন্ধ হবেন।"
পৌষ্য বললেন- "আপনি নির্দোষ অন্নের দোষ দিচ্ছেন এজন্য আপনি নিঃসন্তান হবেন।"
উতঙ্ক বললেন- "অশুচি অন্ন দিয়ে আবার অভিশাপ দেওয়া আপনার অনুচিত"।
রাজা দেখলেন খাবার আসলেই ঠান্ডা এবং খাবারের মধ্যে একটি চুলও রয়েছে, তাই রাজা ক্ষমা চাইলেন।
উতঙ্ক বললেন- "আমার বাক্য মিথ্যা হয় না, আপনি অন্ধ হবেন, কিন্তু শীঘ্রই আবার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন। আমাকে যে শাপ দিয়েছেন তাও যেন না ফলে। এই বলে তিনি কুণ্ডল নিয়ে চলে গেলেন।
উতঙ্ক যেতে যেতে পথে এক নগ্ন সন্ন্যাসীকে দেখতে পেলেন, সে মাঝে মাঝে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিলো।
উতঙ্ক কুণ্ডল দুটি পারে রেখে স্নানের জন্য পুকুরে নামলেন। সেই সুযোগে সন্ন্যাসী কুণ্ডল নিয়ে পালাতে লাগলো।
স্নান শেষ করে উতঙ্ক দৌড়ে গিয়ে সন্ন্যাসীকে ধরতে গেলেন। সন্ন্যাসী তখনই নাগরাজ তক্ষকের রুপ ধারণ করে গর্তে প্রবেশ করে নাগলােকে চলে গেল।
উতঙ্ক সেই গর্ত খুঁড়ে বড় করবার চেষ্টা করে ক্লান্ত হয়ে পরলেন। তা দেখে ইন্দ্র গর্তটিকে বড় করে দিলেন। উতঙ্ক সেই গর্ত দিয়ে নাগলােকে পৌছে গেলেন। সেখানে দেখলেন, দুই জন স্ত্রীলোক কিছু সাদা ও কিছু কালো সুতো দিয়ে তাঁতে কাপড় বুনছেন। ছয়জন কুমার বারোটি পাখিযুক্ত একটি চক্র ঘুরাচ্ছেন। সেখানে একজন সুদর্শন পুরুষ একটি চমৎকার ঘোড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। উতঙ্ক তাদের সকলের প্রশংসা করে গান গাইলেন।
উতঙ্কের প্রশংসায় সেই পুরুষ খুশী হয়ে বললেন- "তুমি কি চাও?"
উতঙ্ক বললেন- "নাগগণ আমার বশীভূত হক।"
পুরুষ বললেন- "তুমি এই ঘোড়ার পিছনে (পায়ুপথে) ফু দাও।"
উতঙ্ক ফু দিলে ঘোড়ার সমস্ত ইন্দ্রিয়দ্বার থেকে অগ্নিশিখা নির্গত হয়ে সমস্ত নাগলােকে ছড়িয়ে পরলো। তখন নাগরাজ তক্ষক ভয় পেয়ে তাঁর বাসভবন থেকে বেরিয়ে এসে উতঙ্ককে কুণ্ডল দুটি ফিরিয়ে দিলো। কিন্তু ততোক্ষণে অনেক দেড়ি হয়ে গেছে। আজই উতঙ্ককের গুরুপত্নীর পণ্যক ব্রত। এতো দূর থেকে কিছুতেই যথা সময়ে গুরুগৃহে পৌছানো সম্ভব নয়। তখন সেই পুরষটি উতঙ্ককে বললেন ঘোড়ায় চড়তে। ঘোড়ায় চড়ার সাথে সাথেই সেটি উতঙ্ককে গুরুগৃহে পৌছে দিলো। উতঙ্ক গুরুপত্নীকে প্রণাম করে কণ্ডল দিলেন।
তারপর উতঙ্ক গুরুর কাছে গিয়ে সকল ঘটনা জানালেন।
গুরু বললেন- "তুমি যে দুই স্ত্রীকে দেখেছ তাঁরা ধাতা ও বিধাতা। সাদা ও কালো সুতা হচ্ছে দিন ও রাত্রি। ছয় কুমার হচ্ছে ছয় ঋতু। চক্রটি হচ্ছে সংবৎসর (পূর্ণ এক বৎসর)। বারোটি পাখি হচ্ছে বারো মাস। যিনি পরুষ তিনি স্বয়ং ইন্দ্র। ঘোড়াটি হচ্ছে অগ্নি। যাবার সময় পথে যে ষাঁড় ছিলো সে ঐরাবত (ইন্দ্রের বাহন)। তার আরােহী ইন্দ্র স্বয়ং। তুমি যে গোবর খেয়েছো তা অমৃত। নাগলােকে তোমার বিপদ হয় নি, কারণ ইন্দ্র আমার বন্ধু, তাঁর, অনগ্রহে তুমি কুণ্ডল আনতে পেরেছ। তোমাকে অনুমতি দিচ্ছি স্বগৃহে যাও, তোমার মঙ্গল হবে।"
উতঙ্ক তক্ষকের উপর প্রতিশােধ নেবার সংকল্প করে হস্তিনাপুরের রাজা জনমেজয়ের কাছে গেলেন। জনমেজয় তখন তক্ষশিলা জয় করে ফিরে এসেছেন।
উতঙ্ক রাজাকে আশীর্বাদ করে বললেন- "মহারাজ আপনার পিতা মহাত্মা পরীক্ষিতের চিকিৎসার জন্য কাশ্যপ আসছিলেন কিন্তু তক্ষক তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। তাই আপনার পিতার মৃত্যু হয়। আপনি শীঘ্র সর্পসত্র যজ্ঞ করে তক্ষক নাগকে আগুনে পুরিয়ে মেরে আপনার পিতার মৃত্যুর প্রতিশােধ নিনি।
উতঙ্কের কথা শুনে জনমেজয় তক্ষকের উপর অতিশয় ক্ষুব্ধ হলেন। তিনি মন্ত্রিদের কাছে তার পিতার মত্যু সম্পর্কে সব কিছু জানতে চাইলেন।
সূত্র :
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস কৃত মহাভারত : অনুবাদক - রাজশেখর বসু
বিশেষ ঘোষণা : হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ মহাভারতের কথা আমরা সকলেই জানি। আমি এটিকে পড়ছি একটি কল্পকাহিনীর সাহিত্য হিসেবে, ধর্মগ্রন্থ হিসেবে নয়। এই গ্রন্থে প্রচুর উদ্ভট কল্পকাহিনী রয়েছে। সেগুলিই আমি এই সিরিজে শেয়ার করবো। যারা মহাভারত পড়েননি তা এখান থেকে ধারাবাহিক ভাবে সেগুলি জেনে যাবেন।
=================================================================
সিরিজের পুরনো পর্বগুলি দেখতে -
মহাভারতের গপ্পো - ০০১,
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুলাই, ২০২১ সকাল ১০:৪৫