আজ অফিস থেকে বাসায় ফিরতে অনেক দেরী হয়ে গেল।
ক্লান্ত বিধ্বস্ত অবস্থায় ঘরে ঢুকে দেখি সুরভি নেই। মনে পড়ল, সুরভি গিয়েছে তার বাবার বাড়ি। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। মন ভাল করতে গেলাম মাছের বাজারে। মাছের বাজারে ঘোরাঘুরি করতে আমার খুব ভালো লাগে। একসময় প্রতিদিন কোন না কোনো মাছের বাজারে না গেলে ভাল লাগত না।
সন্ধ্যার পর খিলগাও রেললাইনের পাশে বিশাল মাছের বাজার বসে। সেখানে কত রকমের যে মাছ !! বাজারে কোনো মাছের অভাব নেই। মাছ দেখেই মনটা খুশিতে ভরে উঠল। সুরভির কথা একেবারেই ভুলে গেলাম। কুচিকুচি করে কাটা বরফের উপরে কি সুন্দর করেই না ইলিশ মাছ গুলো সাজিয়ে রেখেছে। সাদা লাইটের আলোতে ইলিশ গুলো ঝকমক করছে। মনে হচ্ছে এই মাত্র নদী থেকে তুলে আনা হয়েছে। ইলিশ মাছের খুব বেশী দাম। নিজের দেশের মাছ তারপরও এত দাম কেন?
আমি লক্ষ্য করে দেখেছি, ইলিশ মাছ বিক্রেতারা সব সময় খুব হাসিখুশি হয়। মাছের মতোন তাদের চেহারাও ঝকমক করে। একলোক দেখলাম কোনো দরদাম না করে চারটা ইলিশ কিনে নিল চার হাজার টাকা দিয়ে। আমি লোকটার পেছনে অনেকক্ষন ঘুরলাম, দেখার জন্য সে আর কি কি মাছ কিনে। আজ অন্যান্য মাছের বিক্রীও খুব ভাল। ঘুরে-ঘুরে আমি মাছ দেখছি, মাছের বেচাকেনা দেখছি। খুব ভাল লাগছে। সবার মধ্যে একধরনের ব্যস্ততা।
আমার সবচেয়ে ভাল লাগে মাছ কাটা দেখতে।
রেললাইনের পাশে যে ছেলেটা মাছ কাটে তার নাম মকবুল। মকবুল আমার পূর্ব পরিচিত। কোনো কারন ছাড়াই সে আমাকে খুব পছন্দ করে। আমি এক হাজার টাকা বাজি ধরে বলতে পারি সারা ঢাকা শহরে মকবুলের মতোন আর কেউ মাছ কাটতে পারবে না। মকবুল মাছের দিকে না তাকিয়ে খুব দ্রুত বড় বড় মাছ মুহূর্তের মধ্যে কেটে ফেলে। বিশাল এক রুই মাছ পাঁচ মিনিটের মধ্যে কেটে ফেলে!
মকবুল আমাকে দেখে ইশারায় বসতে বলল। সে আমার উপর খুব রাগ। কারন অনেকদিন তার সাথে দেখা করিনি। মাছ কাটতে কাটতে মুকবুল আমার সাথে টুকটাক কথা বলব। মকবুলের এসিস্ট্যান্ট আমাকে চা-টা এনে দিল। এসিস্ট্যান্টের কাজ হলো- জ্যান্ত মাছের মাথায় একটা বাড়ি দেয়া। পানিতে লাফানো মাছ মুহূর্তের মধ্যে মরে যায়, তারপর সে আঁশ ফেলে ওস্তাদের (মকবুল) কাছে দেয়। এক ঘন্টা মকবুলের মাছ কাটা দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে বাসায় ফিরলাম।
অনেকদিন আগে একটা বই পড়েছিলাম, আর্নেস্ট হেমিংওয়ের 'দ্যা ওল্ড ম্যান এন্ড দ্যা সি'। অত্যন্ত চমৎকার একটি উক্তি বুড়ো সান্তিয়াগোর মুখ দিয়ে হেমিংওয়ে আমাদের বলেনঃ ‘Man is not made for defeat. Man can be destroyed, but not defeated!' আসলেই, মানুষের জন্ম তো হার স্বীকারের জন্য নয়। মানুষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, কিন্তু কখনো পরাজিত হয় না। শত প্রতিকূলতা, কুৎসিতের মুহূর্মুহু আক্রমণ, একে অপরের থেকে ক্রমাগত বিচ্ছিনতা, - এই চরম হতাশার মাঝেও তবু আমাদেরকে বেঁচে থাকতে হয়।