দেশ ভাগের আগের কথা।
মোয়াজ্জেম হোসেন মাসের অর্ধেকের বেশি সময় থাকেন কলকাতায়। কলকাতায় তার বিরাট ব্যবসা। নিউজ প্রিন্ট কাগজের ব্যবসা। নিজের তিনতলা বাড়ির নীচ তলা ব্যবসার কাজে ব্যবহার করেন। তিনি থাকেন দোতলায়। তিন তলাটা পুরোটাই খালি থাকে সারা বছর। ইচ্ছা করলে তিনি ভাড়া দিতে পারেন। কিন্তু সেই ঝামেলায় তিনি যান না। তার টাকার অভাব নেই। তিনি কলকাতায় ব্যবসা করলেও তার বাড়ী বিক্রমপুর। বিক্রমপুরের জমিদার তারা। যদিও এখন জমিদার প্রথা নেই। তবু তাকে তার গ্রামের মানুষ জমিদার বলেই মানে। জানে। মোয়াজ্জেম হোসেন, মাসে একদিন তার বৈঠক খানায় বসেন। তখন গ্রামের সমস্ত দরিদ্র মানুষেরা তার কাছে আসে। তিনি সবার অভাবের কথা মন দিয়ে শুনেন। এবং সাহায্য সহযোগিতা করেন। কলকাতা থেকে গ্রামের মানুষের জন্য শাড়ি লুঙ্গি নিয়ে যান। দুই হাতে বিলান। গ্রামের মানুষ মোয়াজ্জেম সাহেবের উপর খুশি।
গ্রামের অর্ধেক জমিই মোয়াজ্জেম হোসেনের।
যদিও সব বর্গা দেওয়া। এসব জমি তার বাপ দাদার আমলের। এসব জমি চাষবাস করে গ্রামের দরিদ্র পরিবার গুলো খেয়েপরে বেঁচে আছে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা পাশের গ্রামে স্কুলে পড়তে যায়। দুঃখের বিষয় তার গ্রামে কোনো স্কুল নেই, মাদ্রাসা নেই। তবে একটা মসজিদ আছে। একটা মন্দির আছে। মসজিদ এবং মন্দিরের অবস্থা ভালো না। যেকোনো সময় ভেঙ্গে পড়বে- এমন অবস্থা। গ্রামের হিন্দু আর মুসলমানেরা ঠিক করেছে এবার মোয়াজ্জেম সাহেব গ্রামে এলে তাকে অনুরোধ করবে যেন মসজিদ আর মন্দিরটা মেরামত করে দেন। মোয়াজ্জেম সাহেব ভালো মানুষ তাকে বললেই তিনি করে দিবেন- এটা গ্রামবাসী জানেন। শোনা যাচ্ছে, মোয়াজ্জেম সাহেব কলকাতায় আরেকটা বাড়ি কিনেছেন। ব্যবসায় তিনি যে সাফল্য পাচ্ছেন, তাতে মনে হচ্ছে- তিনি তার বাপ দাদার সম্পত্তি থেকেও অনেক বেশি করে ফেলবেন। তার মন মানসিকতা উন্নত।
মোয়াজ্জেম সাহেবের বন্ধু নরত্তম চক্রবর্তী।
লেখাপড়ায় বেশ ভালো। কলকাতায় ডাক্তারি পড়ছেন নরত্তম। বন্ধুর লেখাপড়ার সমস্ত খরচ দিচ্ছেন মোয়াজ্জেম সাহেব। এমনকি নরত্তম মোয়াজ্জেম সাহবের কলকাতার বাড়িতে থেকে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন। লেখাপড়ার ফাঁকে সময় পেলে বন্ধুর ব্যবসার হিসাব দেখাশানা করেন। একদিন সত্যি সত্যি নরত্তম ডাক্তারি পাশ করে ফেলল। খুশিতে বন্ধু মোয়াজ্জেমকে জড়িয়ে ধরলো এবং কিছুক্ষন কান্না করলো। নরত্তম চক্রবর্তীর দুনিয়ায়তে কেউ নেই। নরত্তম বলল, বন্ধু আমি কলিকাতায় বা ঢাক্কাতে চেম্বার করিব না। আমি আমাদের গ্রামে চেম্বার করিব। আমাদের গ্রামে কোনো ডাক্তার নাই। গ্রামের মানুষ চিকিৎসার জন্য কবিরাজ দেখায়, লতাপাতা খায়। আমি তাদের চিকিৎসা করবো। মোয়াজ্জেম বললেন, গ্রামের মানুষ তো তোমাকে ভিজিট দিতে পারবে না। ডাক্তার নরত্তম বলল, ভিজিট আমার দরকার নেই। মানুষের সেবা করতে পারলেই আমি খুশি। এরচেয়ে ভালো কাজ দুনিয়াতে দ্বিতীয়টি নেই।
মোয়াজ্জেম হোসেন এবং নরত্তম চক্রবর্তী গ্রামে ফিরলেন।
মোয়াজ্জেম গ্রামে একটা স্কুল করলেন, কলকাতা আর ঢাকা থেকে শিক্ষক নিয়োগ দিলেন। মসজিদ, মন্দির মেরামত করলেন। মাদ্রাসা করলেন। ডাক্তার নরত্তমকে একটা চেম্বার করে দিলেন। এত এত রোগী গ্রামে ছিলো তা ধারনা করতে পারেন নি নরত্তম। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রোগী আসতেই থাকলো। এমন কি আশে পাশের গ্রাম থেকেও রোগী আসতে থাকলো। দীর্ঘদিন নানান রকম রোগে ভূগতে থাকা রোগীরা অবাক! তাদের রোগ এই হিন্দু ডাক্তার ভালো করে দিচ্ছেন। কোনো টাকা পয়সা নিচ্ছেন না। এমনকি ওষধ পর্যন্ত ফ্রি দিচ্ছেন। মোয়াজ্জেম হোসেন একদিন তার বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, বন্ধু তুমি একজন খাটি মানুষ। তুমি আসলেই একজন ভালো ডাক্তার। ডাক্তারি পাশ করে মানুষের সেবা করে যাচ্ছো! নরত্তম বললেন, বন্ধু তুমিও কম না।
কামারগাও গ্রাম হয়ে উঠলো আদর্শ গ্রাম।
আশে পাশের সমস্ত মানুষ কামারগাও গ্রামকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। সত্যি সত্যি গ্রামটা আনন্দময় একটা গ্রাম হয়ে গেছে দুইজনের চেষ্টায়। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখছে। সবাই চাষবাস করছে। গ্রামে একটি পরিবারও না খেয়ে থাকে না। সবাই ভালো চিকিৎসা পাচ্ছে। মোয়াজ্জেম সাহেব দূর্গা পূজার সময় কলকাতা থেকে মূর্তি গড়ার কারিগর নিয়ে আসেন। বিরাট বড় করে দূর্গা পূজা করেন। অনেক খানাপিনার ব্যবস্থা করা হয়। বেশ ধূমধাম করে পূজা উৎসব করা হয়।
আবার ঈদের সময় সমস্ত গ্রামবাসীকে নতুন জামা দেওয়া হয়। এই গ্রামে ঝগড়া হয় না। এঁকে অন্যের বিপদে এগিয়ে আসে। গ্রামের ছেলেরা ফুটবল খেলে। হাডুডু খেলে। সব মিলিয়ে গ্রামের মানুষ গুলো ভালো আছে। সহজ সরল ভাবে সুন্দর জীবন পার করছিলো। কিন্তু মানুষের কপালে মনে হয় সুখ বেশি দিন সয় না। দেশভাগের কারনে পুরো গ্রাম ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেলো। মোয়াজ্জেম সাহেব তার কলকাতার বাড়ি আর ব্যবসা হারালেন। ডাক্তার নরত্তম চক্রবর্তীকে গ্রামে ফিরে যেতে হলো।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ১:০৪