শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে করে না।
ইচ্ছে করে কম্বল জড়িয়ে আর একটু ঘুমাই। শীত বড় অদ্ভুত এক ঋতু! অসংখ্য মানুষের প্রিয় ঋতু। তবে শীতকাল আমার জন্য দুখজনক। আমার পা ফেটে যায়। চামড়া খসখসে হয়ে যায়। মাঝে মাঝে মাথায় খুশকি হয়। ছোট বেলায় মা তেল পানি দিয়ে দিতো। আমার যথেষ্ট যত্ন নিতো। এখন কে যত্ন নিবে? শীতের দুই মাস আমার বেশ কষ্ট হয়। তবে শীতকালে আমাদের বাসায় অনেক রকম পিঠা তৈরি হয়। আমি মজা করে খাই। একটা পিঠা আছে, বিবিখানা নাম। চমৎকার পিঠা। দারুণ স্বাদ। বিবিখানা পিঠা আমাদের বিক্রমপুর অঞ্চলের। শীতের সকালে রান্নাঘরে বসে গরম গরম ভাপা পিঠা খেতে দারুণ লাগে। দাদী বানাতো আমি মজা করে খেতাম। ভাপা পিঠা গরম গরম খেতেই মজা।
শীতকালে বিয়ে সাদি বেশি হয়।
আমি প্রচুর বিয়ের দাওয়াত পাই। দাওয়াতে যাই। আগ্রহ নিয়ে খাই। মাঝে মাঝে রোস্ট একটা বেশি চেয়ে নিই। খাওয়া দাওয়া শেষ করে একটা খিলি পান মুখে দেই। তখন মনে হয়, লাইফ ইজ বিউটিফুল। পান খেয়ে নতুন স্বামী স্ত্রীর মাঝখানে বসে ছবি তুলি। ঘুরে ঘুরে অন্যদের খাওয়া দেখি, পোশাক আশাক দেখি। বাচ্চারা ছোটাছুটি করে। দায়িত্ব মনে করে বাচ্চাদের ধমক দেই।বাচ্চাদের বলি, অই আমিও তো তোমাদের মতো ছোট ছিলাম, এরকম লাফালাফি তো করি নাই। থাম যাও বাচ্চে লোগ। শীতের সকালে সাড়ে এগারোটার আগে রোদ উঠে না। রোদ উঠলেও, রোদের তেজ থাকে না। হাপানী রোগীদের শীতকালে বড় কষ্ট হয়। শীতকালে বেশির ভাগ মানুষের ঠান্ডা লেগে যায়।
ছোট কালে শীতকালে অর্থাৎ ডিসেম্বর মাসে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়।
হাতে অনেক সময়। চলে যেতাম গ্রামের বাড়ি। গ্রামের বাড়ি মানেই আনন্দ। গ্রামে দাদা দাদী আর চাচা ফুপু থাকেন। আমাদের গ্রামের বাড়িটা কাঠের। দোতলা বাড়ি। আমার দাদা হুট করে একদিন অন্ধ হয়ে যায়। তখন তার তেত্রিশ বছর বয়স। যাইহোক, শীতের সকালে কম্বলের নিচ থেকে বের হতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু আমার লাল চাচা। ঘুম থেকে ডেকে তুলেন। তিনি আমাদের পদ্মা নদী নিয়ে যাবেন। আমরা লাফালাফি করে গোছল করবো। নদীতে গোছল করার আসল মজা হলো, প্রথমবার ঠান্ডা লাগে, এর পর আর শীত করে না। এত মজা লাগে নদী থেকে উঠতে ইচ্ছে করে না। নদীতে গোছল করার মজাই আলাদা।
ভোরবেলা দাদা বাড়িতে প্রথম নাস্তা হচ্ছে লাল চা আর মুড়ি।
সেটা আবার উঠানে পাটিতে বসে খেতে হবে। দাদার বেশ কিছু কঠিন নিয়মকানুন আছে। যে দেরি করবে সে সকালের চা পাবে না। সকাল সাড়ে আট টায় দেওয়া হবে আসল সকালের নাস্তা। গরম ভাত, সাথে অনেক রকমের ভর্তা। ডিম ভাজি। মাছ ভাজা। অবশ্য আমি শহরের ছেলে সকালে ভাত খাই না। আমার জন্য পরোটার ব্যবস্থা করা হতো। সেই পরোটা আবার খাটি ঘি দিয়ে ভাজা হতো। দুপুরে দেশি মূরগী। আর মাছ। সবজি। আমার দাদীর রান্নার হাত দারুণ। যা রান্না করে খাই। মজা লাগে। অবশ্য বিক্রমপুরের মানুষের রান্না ভালো। আমার সব ফুপু দারুণ রান্না করে। রান্না ভালো হওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রান্না ভালো না হলে আমি খেতে পারি না।
শীতকাল মানে কুয়াশা। অল্প সময়ের জন্য সূর্য দেখা যায়।
শীতের কালে সূর্য আরামদায়ক। শীত কালে বৃষ্টি হয় না বললেই চলে। একবার শীতে এক বন্ধুর গ্রামের বাড়ি গিয়েছি। টিনের ঘরে শুয়ে আছি। অনেক রাত। ঘুম নাই চোখে। হঠাৎ শুনি টপ টপ শব্দ। শব্দ কেন হচ্ছে সেটা আমি নিজেই খুজে বের করলাম। জানালার পাশে বিশাল এক তেতুল গাছ। তেতুল গাছ তার সমস্ত ডালপালা মেলে দিয়েছে চারদিকে। কুয়াশা জমে জমে গাছের পাতা চুইয়ে টিনের চালে কুয়াশা পড়ে টপ টপ শব্দ হচ্ছে। শিয়াল ডাকছে, কুকুর ডাকছে। কুয়াশার একটা গন্ধ আছে। গন্ধে মাদকতা আছে। ভোরবেলা ঘাসে শিশির জমে থাকে। খালি পায়ে হাটতে দারুণ লাগে। মাকড়সার জালে শিশির জমে থাকে। দারুণ লাগে দেখতে।
একবার কুলাউড়া স্টেশনে বসে আছি। শীতের রাত।
অনেক শীত। ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি। ট্রেনের কখন আসবে কে জানে! বেঞ্চে বসে আছি। শীতে কাপছি। আমার পাশে একটা মেয়ে বসে আছে। মেয়েটার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ মেয়েটা বলল, আপনি শীতে কাপছেন। গরম গরম চা খেলে আপনার ভালো লাগবে। ট্রেন কখন আসবে ঠিক নাই। আমি উঠে গিয়ে দুকাপ চা নিয়ে এলাম। মেয়েটা আন্তরিক ভাবে চায়ের কাপ হাতে নিলো। চা খেতে খেতে মেয়েটার সাথে আমার খাতির হয়ে গেলো। যেন মেয়েটা আমার অনেক দিনের পরিচিত। আমাদের ট্রেন এসে গেলো। আমরা দুজন দৌড়ে ট্রেনে উঠলাম। মাঝে মাঝে সিনেমার মতো ঘটনা জীবনে ঘটে যায়। এজন্যই জীবন এত সুন্দর।
ট্রেন উঠতেই চেকার বললেন, শীতের রাত।
আপনারা ভিআইপি কামরায় চলে যান। খালি আছে। যাদের আসার কথা ছিলো, আসেনি। চেকারকে চা নাস্তার জন্য কিছু টাকা দিলাম। অবাক বিষয় মেয়েটা আমার সাথে এলো। তার মধ্যে কোনো জড়তা নেই। মেয়েটা ভীষণ সুন্দর। তারপর যা হবার তাই হলো। আমার কোনো দোষ নেই। আমি জোরজবরদস্তি করি নাই। আমরা দুজন দারুণ সময় পার করলাম। আহা! বারবার মনে হচ্ছিল লাইফ ইজ বিউটিফুল। অবিশ্বাস্য এবং অপ্রত্যাশিত থ্রিলার টাইপ যে আনন্দ পেলাম তার তুলনা হয় না। ঈশ্বরের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, মেয়েটা নেই। একটা চিঠি লিখে রেখে গেছে। আমার ভীষণ কষ্ট হলো। এখনো ট্রেনে করে কোথাও গেলে মনে মনে মেয়েটা খুজি।
আরেকটা ঘটনা বলে, আমি আমার শীতের সকাল রচনা শেষ করবো।
সুন্দরবন যাচ্ছি বিশাল এক জাহাজে করে। চারিদিকে পানি আর পানি। আশেপাশে কোনো বাড়িঘর দেখা যায় না। আমাদের জাহাজ ছুটছে। চারিদিকে গভীর কুয়াশা। প্রচন্ড শীত। এমন শীত যে বাতাস যেন গায়ে তীরের মতো বিধে। রাতে ঘুম আসছিলো না। জাহাজের ছাদে গেলাম। ছাদে যাওয়ার আগে তিন পেগ ভদকা খেয়েছি। সারা শরীর দুলছিল। মদ আমি খাই না। একজন বলল, সামান্য খাও তাহলে শীত কম লাগবে।জাহাজের ছাদে প্রচন্ড বাতাস। হঠাৎ দেখলাম কুয়াশা কেটে গেলো। চাঁদ দেখা গেলো। চাঁদের আলো পড়েছে সমুদ্রের গায়ে। পানি ঝিকমিক করছে। এত সুন্দর লাগছিলো যে, আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল আমি মরে যাই। সেই প্রথম আমার আত্মহত্যা করার ইচ্ছে হয়েছিল।