ঘুম থেকে উঠে আবার ক্ষুধা লেগে গেলো । ফ্রেন্চ টাইপে রান্নায় দেখলাম ক্রিমের ব্যবহার অনেক বেশি । আর যেটুকুই রান্না করে , যত্ন করে আর সুন্দর ভাবে পরিবেশন করে ।
এখানে একটা মজার ব্যাপার বলা ভালো -- এ ধরনের ফ্রেন্চ প্রচলিত অন্চলে আমারই সবচে ইংরেজি জানা লোক । ফ্রেন্চ ভাষা বেশ চমৎকার --
কার বই এ পড়েছিলাম -- বাংলা হলো উপমহাদেশের ফ্রেন্চ --
যদিও কোন মিল খুজে পাই নাই -- ফ্রেন্চ বলার মধ্যে লালিত্য আছে একটা -- এক্সোটিক । তো আমরা বেশ ভাব গম্ভীর ভাব নিয়ে লোকজনের সাথে কথা বলছিলাম -- আর কথায় কথায়
"মার্সি" "মার্সি" । "বনজোর" আর "মার্সি" পর্যন্তই আমাদের ফ্রেন্চের চালান । কালো চামড়া লোক তাদুসসাকের যাওয়ার রাস্তার মধ্যে একটাও নজরে পরে নাই -- আমরাই একমাত্র নিদর্শন -- প্রথমে ভেবেছি লোকজনের ব্যবহার কেমন না কেমন হবে -- ভুল ভেবেছিলাম । মানুষজন খুবই বন্ধুবাৎসল --টুরিজম ই এখানকার প্রধান আয় -- সুতরাং বন্ধবাৎসল না হয়ে উপায় নেই ।
পেটপুজো সেরে এবার ঘুরতে বেরুলাম -- যাওয়ার তো তেমন কোন জায়গা নাই -- তাছাড়া গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিলো । এক জায়গা দেখলাম বেশ হৈ হুল্লোড় হচ্ছে -- আমরাও ভীড়ে গেলাম সেখানে -- লোকজন গিটার নিয়ে গালি গলায় গান গাচ্ছিলো --
ফ্রেন্চ তো জানি না -- সুর গুলো মন্দ না ।
আবার কিছুক্ষন পর ডিজে একটা ভাংগা প্লেয়ার দিয়ে বিভিন্ন ভাষার গান নিয়ে হাজির হলো -- কেউ কেউ দেখলাম নাচ শুরু করে দিসে -- এক লোকের সাথে পরিচয় হলো -- তার কাছে হোটেলে থাকার পয়সা নাই -- মোটর সাইকেলে করে দেশ ভ্রমনে বের হয়েছে -- ফ্রান্স থেকে আসা কিছু পোলাপানের সাথে কথা হলো ।
এরপর শুরু হলো যেটা কখনো দেখবো বলে ভাবিনি --
"বেলী ডান্স" । তবে ইরোটিক কিছু না -- ভদ্র গোছেরই বলা যায় -- আমার তো আক্কেল গুরুম অবস্থা -- । কোন এক ফ্রেন্চ কাউন্টিতে এসে বেলী ডান্স দেখবো স্বপ্নেও ভাবিনি ।
তারপর শুরু হলো সামনের ইয়ার্ডের আগুনের খেলা -- ওরা আসলে এত দূরে আসা আমাদের মতো পাবলিকদের এন্টারটেইন করতে চায় ।
কাল সকালে উঠতে হবে তাই তাড়াতাড়ি ফেরত এসে ঘুমিয়ে পড়লাম ।
সকালে উঠেই টিকেট কেটে সোজা জাহাজে। বেশ বড় জাহাজই ।২০০ জনের এরেন্জমেন্ট । মেঘলা আবহাওয়া ক্যান্সেল করে দিবে কিনা চিন্তা করছিলাম । এর মধ্যে গাইড কে প্রশ্ন করে করে অস্থির করে ফেল্লাম দুজনে --- কোন আবহাওয়া তিমি দেখা যায় -- ও কই থাকে -- টুরিষ্ট সিজন শেষ হলে কি করে -- কতদূর যাওয়া লাগবে তিমি দেখতে যেতে -- কোন কোন ধরনের তিমি দেখা যায় -- ছেলেটা বেশ আন্তরিক ভাবেই উত্তর দিলো ।
জাহাজে সবাই ক্যামারা নিয়ে রেডি। ছবি তোলার উৎসব শুরু হয়েছে -- আমি তাড়াতাড়ি জাহাজের পিছনের দিকে ছাউনীর কোনায় একটা সুবিধা মতো জায়গা ঘাপটি মারলাম । কারন পূর্বঅভিজ্ঞতা থেকে জানি শেষে ভীড়ে কাছে ঘেসা যাবে না । তাছাড়া বড় বড় ঢেউ ছিলো -- এটা মোহানার মধ্যে হলেও অপর পাড় দেখা যাবার প্রশ্নই উঠে না -- মাঝ সাগরে মতো লাগছিলো -- কেউ কেউ দেখলাম দুলুনী সহ্য করতে না পেরে সীটে আশ্রয় নিয়েছে -- জাহাজে মন্ট্রিয়াল থেকে আশা কিছু বাংগালী আর ভারতীয় ছিলো -- এরা দিনের ট্রিপ সেরে দিনেই ফিরে যাবে ।
আধ ঘন্টা চলার পরই এনাউন্সেমেন্ট এলো -- ঘড়ির কাটার ১ টার দিকে একটা তিমিকে শ্বাস নিতে দেখা যাচ্ছে --
বলা মাত্র সব হুড়মুর করে এক দিকে এসে পড়লো। প্রথমে বুঝতে পারিনি -- ১:০০ টা ৫:০০ টা -- ৭:০০ টা বলে কি বোঝাতে চাইছে -- আসলে জাহাজের নাকটাকে ১২ টা ধরে ওরা ঐ দিকে দেখতে বলছিলো --- তারপরই দেখলাম একটা তিমি কে শ্বাস নিতে -- জাহাজ থেকে ২০০ মিটার দূরে হবে ।
ছোট খাট বাষ্প ইন্জিনের মতো ফোস করে শ্বাস ছাড়ছে ।
ছবি তুলতে গিয়ে মুশকিল হলো - - দেখতে দেখতে শ্বাস নিয়ে ডুবে যায় তিমি গুলো -- একটাও পোজ দেয় না ঠিক মতো ।
বাচ্চার মতো খেলা করছে একেকটা -- আবার একটা জাহাজের পাশ দিয়েই বের হয়ে গেলো ব্রেষ্ট ষ্ট্রোকের ভংগীতে ।
বিশাল সাইজ দেখে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম ।
বেশীর ভাগ তিমিই মিংকি , কয়েকটা হাম্পব্যাকে কথাও বলল -- আমাদের অনভিজ্ঞ চোখে অবশ্য সব গুলো একরকম লাগছিলো । একটা তিমি অবশ্য বাচ্চা নিয়ে এসেছিলো -- একটা সীল ও চোখে পড়লো ।
জাল দিয়ে না ধরি -- ক্যামারা আর চোখ দিয়ে বিশাল প্রানী গুলো বন্দী করে ফেলেছি
ভিডিও :
আমাদের জাহাজ এখান থেকে ওখানে বাচ্চাদের মতো ছোটাছুটি করছিলো । একটা তিমি ১ বার শ্বাস নিয়ে ২০-৪০ মিনিট পানির নিচে ডুব দেয় । সুতরাং ক্যামেরা তাক করে বসে ছাড়া আর গতি নাই -- শেষে দেখলাম ছবি তুলতে গেলে আমার দেখাই হবে না ঠিক মতো -- তাই ধুত্তরি ছাই বলে
ওদের খেলা দেখলাম ।
আমাদের নদীতে যারা শুশকের ডুব দেখছেন -- তেমনই -- আরো অনেক বড়ো ভার্শন আর কি ।
তিমির বাচ্চাটা দেখে ছোট বেলায় পড়া "তিমির প্রেম" বইটার কথা মনে পড়লো । কি হৃদয়বিদারক কাহিনী ছিলো ।
বড়ো বড়ো ঢেউ এসে ভিজিয়ে দিছ্ছিলো আর খোলা বাতাসে ঠান্ডাও লাগছিলো -- শেষের দিকে জাহাজের দুলুনীতে একটু খারাপ লাগা শুরু হলো -- ততক্ষনে খেলা শেষ --
ফেরার পথে চুপচাপই বসে রইলাম দারুন একটা অভিজ্ঞতা সংগী করে ।
বাড়ী ফেরা পথ নির্ঝন্জাট ই কাটলো । তখন ঐ পাহাড়ের উপর থেকে সাগর দেখার রাস্তাটা ভিডিও বন্দী করে ফেল্লাম ।
ছোটবেলা অনেক কিছু ইচ্ছে করতো -- আমাজন যাবো --
কিংবা আফ্রিকা । মিশরের পিরামিড , তাহিতির নীল সমুদ্র ,
হাওয়াই এর বিশাল ঢেউ -- বৈকাল হ্রদ , অষ্ট্রেলিয়ার রং বদলানো পাহাড় -- গ্রান্ড ক্যানিয়ন --- আরো কতো কিছু । তিমি দেখার ও স্বপ্ন ছিলো -- বয়স একটু বাড়ার পর বুঝলাম স্বপ্ন আর বাস্তবের মতো বিস্তর ফারাক করে রেখেছে টাকা-পয়সা।
তিমি দেখতে পারবো সত্যি সত্যি ভাবিনি কখনো । এখন মনে হচ্ছে আরে হতেও তো পারে -- বাস্তব মাঝে মাঝে দু:স্বপ্নের চে খারাপ হতে পারে -- আবার তেমনি হতে পারে স্বপ্নের চে রংগীন ।
তাজমহল আর চীনের প্রাচীর দেখা হয়েছে -- কোন একদিন মিশরের পিরামিড ও দেখে ফেলতে পারি !! কে জানে --
এখন যদি অসম্ভব মনে হচ্ছে অনেক কিছুই ।
কে জানে ভবিষৎ এর গর্ভে কোন লুকানো উপহার রাখা আছে ।