গণজাগরণ মঞ্চের প্রথম জন্মদিন গেল। জন্মদিনে আমার শুধু হুমায়ূন আহমেদের 'তিনি' লেখাটাই বারবার মনে পড়েছে। লেখাটি আগে একবার দিয়েছিলাম, সময়ের দাবীতে আবার দিলাম...
তিনি
__হুমায়ূন আহমেদ
রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।
আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায় চকচক করছে। ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না। বিখ্যাত মানুষরা যে আমাকে একেবারেই টেলিফোন করেন না তাতো না। মেয়ে এত উত্তেজিত কেন?
‘বাবা তুমি কিন্তু আবার বলতে বলবে না যে তুমি বাসায় নেই। তোমার বিশ্রী অভ্যাস আছে বাসায় থেকেও বলো বাসায় নেই।’
আমি বললাম, টেলিফোন কে করেছে মা?
আমার মেয়ে ফিসফিস করে বলল, জাহানারা ইমাম।
এই নাম ফিসফিস করে বলছ কেন? ফিসফিস করে বলার কি হল?
‘বাবা উনি যখন বললেন, তার নাম জাহানারা ইমাম তখন আমি এতই নার্ভাস হয়ে গেছি যে, তাকে আসস্লামালাইকুম বলতে ভুলে গেছি।’
‘বিরাট ভুল হয়েছে। যাই হোক দেখা যাক কি করা যায়।’
আমি টেলিফোন ধরলাম এবং বললাম, ‘আমার মেয়ে আপনাকে সালাম দিতে ভুলে গেছে এই জন্যে সে খুব লজ্জিত। আপনি তাকে ক্ষমা করে দেবেন। সে আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।’
ওপাশ থেকে তার হাসির শব্দ শুনলাম। হাসতে হাসতেই বললেন, ‘আমি কিন্তু আপনাকে টেলিফোন করেছি কিছু কঠিন কথা বলার জন্যে।’
‘বলুন।’
‘আপনি রাগ করুন বা না করুন কথাগুলো আমাকে বলতেই হবে।’
‘আমি শংকিত হয়ে আপনার কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছি।’
‘আপনি স্বাধীনতাবিরোধীদের পত্রিকায় লেখেন কেন? আপনার মত আরো অনেকেই এই কাজটি করে । কিন্তু আপনি কেন করবেন?’
তিনি কথা বলছে নিচু গলায়, কিন্তু বলার ভঙ্গিতে কোন অস্পষ্টতা নেই। কোন আড়ষ্টতা নেই।’
আমি হকচকিয়ে গেলাম। আক্রমণ এইদিক থেকে আসবে ভাবিনি। তবে পত্রিকায় লেখা দেয়ার ব্যাপারে আমার কিছু যুক্তি আছে। খুব যে দুর্বল যুক্তি তাও না। যুক্তিগুলো তাকে শোনালাম। মনে হল এতে তিনি আরও রেগে গেলেন। কঠিন গলায় বললেন, ‘আপনার মিসির আলী বিষয়ক রচনা আমি কিছু কিছু পড়েছি, আপনি যুক্তি ভালো দেবেন তা জানি। কিন্তু আমি আপনার কাছ থেকে যুক্তি শুনতে চাচ্ছি না। আপনাকে কথা দিতে হবে ওদের পত্রিকায় লিখে ওদের হাত শক্তিশালী করবেন না। আপনি একজন শহীদ পিতার পুত্র। ‘তুই রাজাকার’ শ্লোগান আপনার কলম থেকে বের হয়েছে। বলুন আর লিখবেন না।’
আমি সহজে প্রভাবিত হই না। সে রাতে হলাম । বলতে বাধ্য হলাম, আপনাকে কথা দিচ্ছি আর লিখব না। এবার বলুন আপনার রাগ কি কমেছে? তিনি হেসে ফেললেন। বাচ্চা মেয়েদের এক ধরণের হাসি আছে – কুটকুট হাসি, বড়দের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে যে হাসি তারা হাসে সেই হাসি।
আমি বললাম, ‘আমি সবসময় লক্ষ্য করেছি আপনি আমাকে আপনি আপনি কবেন। নিজেকে খুব দূরের মানষ মনে হয়। দয়া করে আমাকে ‘তুমি’ করে বলবেন।’ তিনি বললেন, ‘আচ্ছা বলব। এখন থেকে বলব।’
তিনি কিন্তু আমাকে ‘তুমি’ কখনই বলেননি। যতবারই মনে করিয়ে দিয়েছি ততবারই বলেছেন, ‘হ্যাঁ এখন থেকে বলব।’ কিন্তু বলার সময় বলেছেন ‘আপনি’। হয়তো তিনি আমাকে কখনোই কাছের মানুষ মনে করেননি।
তার অনেক কাছের মানুষ ছিলো আমার মা। আমার ছোট ভাই জাফর ইকবাল। জাফর ইকবালের উল্লেখ তার লেখাতে পাই। ব্যাক্তিগত আলাপেও জাফর ইকবালের প্রসঙ্গে তাকে উচ্ছ্বসিত হতে দেখি। শুধু আমার ব্যাপারেই এক ধরণের শীতলতা। হয়তো তার ধারণা হয়েছিল, যে মহান আন্দোলনের নেতৃত্ব তিনি দিচ্ছেন আমি সেই আন্দোলন এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছি। যে ১০১ জনকে নিয়ে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আদি যাত্রা, আমি সেই ১০১ জনের একজন। অথচ পরে আমার আর কোন খোঁজ নেই। কাজেই আমার ভূমিকায় অস্পষ্টতাতো আছেই। তিনি আমার প্রতি শীতল ভাব পোষণ করতেই পারেন। সেটাই স্বাভাবিক।
আরেক দিনের কথা, তিনি টেলিফোন করেছেন। গলার স্বর অস্পষ্ট। কথা কেমন জড়িয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। আমি বললাম, ‘আপনার শরীর কি খারাপ করেছে?’
তিনি ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘শরীর আছে শরীরের মতই। আপনাকে একটা ব্যাপারে টেলিফোন করেছি।’
‘বলুন কি ব্যাপার।’
‘এই যে একটা আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি এতে অর্থ ব্যায় হচ্ছে। আমাকে চলতে হচ্ছে মানুষের চাঁদায়। আপনি প্রতি মাসে একটা নির্দিষ্ট অংকের চাঁদা দেবেন।’
‘অবশ্যই দেব।’
‘আমি একজনকে পাঠাচ্ছি। এ মাসের চাঁদা দিয়ে দিন।’
‘জ্বি আচ্ছা, কত করে দেব?’
‘আপনি আপনার স্বামর্থ্য মত দেবেন। মাসে দু’হাজার করে দিতে পারবেন?’
‘পারব।’
একজন এসে চাঁদা নিয়ে গেলো। পরের দু’মাস কেউ চাঁদ নিতে এলো না। আমার মন একটু খারাপ হল। মনে হল হয়ত সিদ্ধান্ত হয়েছে আমার কাছ থেকে চাঁদা নেয়া হবে না। তৃতীয় মাসে তিনি টেলিফোন করে বললেন, ‘কি ব্যাপার আপনি আপনার চাঁদার টাকা দিচ্ছেন না কেন?’
আমি বিনীতভাবে বললাম, ‘কেউ তো নিতে আসেনি।’
‘আমার এত লোকজন কোথায় যে পাঠাবো! আপনি নিজে এসে দিয়ে যেতে পারেন না? আপনিতো এলিফেন্ট রোডেই থাকন। দু’মিনিটের পথ।’
‘আমি আসছি। ভালো কথা আপার সাথে রাগারাগি করার মত একটা ঘটনা ঘটেছে। আমি এসেই কিন্তু রাগারাগি করব।’
তিনি বিস্মিত হলে বললেন, ‘আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘এসে নেই তারপর বুঝবেন।’
‘না এখনই বলুন।’
‘আমার বড় মেয়ে নোভার ছিল মাথা ভর্তি চুল। আপনি হচ্ছেন তার আদর্শ। আপনার মাথার ছোট ছোট চুল তার খুব পছন্দ। সে আপনার মত হবার প্রথম ধাপ হিসেবে তার মাথার সব চুল কেটে ফেলেছে।’
‘সত্যি।’
‘বাসায় আসুন। বাসায় এসে দেখে যান।’
একেবারে কিশোরী গলায় তিনি অনেকক্ষণ হাসলেন। তারপর বললেন, ‘আপনার মেয়েকে বললেন লম্বা চুল আমার খুব প্রিয়। আমি যখন তার বয়সী ছিলাম তখন আমার হাঁটু পর্যন্ত লম্বা চুল ছিল। ছবি আছে। আমি আপনার মেয়েকে দেখাব। চুল কেটে ছোট করতে হয়েছে ক্যান্সারের জন্য। কেমোথেরাপির কারণে চুল পড়ে যাচ্ছিলো। কি আর করব?’
তিনি একবার আমার বাসায় আসার ইচ্ছা পোষণ করলেন। আমার মেয়েদের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করবেন। তার গল্প করতে ইচ্ছা করছে। গাড়ি পাঠিয়ে তাকে আনালাম। গ্রহ যেমন সূর্যকে ঘিরে রাখে আমার মেয়েরাও তাকে সেই ভাবে ঘিরে গোল হয়ে বসে পড়ল। তিনি তাদের বললেন তার শৈশবের কথা। আমি আসরে যোগ দিতে চেয়েছিলাম। তিনি বললেন, আপনি আসবেন না। এই আসরে আপনার প্রবেশাধিকার নেই।
অন্যান্য ফ্ল্যাটে খবর চলে গেছে। ছেলেমেয়েরা আসছে। তারাও গল্প শুনতে চায়।
আমার স্ত্রী ব্যস্ত হয়ে পড়ল, অতি সন্মানিত এই মানুষটিকে সে কি খাওয়াবে? তিনি তো কিছুই খেতে পারেন না।
তিনি আমার স্ত্রীকে আশ্বস্ত করলেন, শুধু মুখে যাবেন না। কিছু খাবেন। পাকা পেঁপে থাকলে ভালো হয়।
ঘরে পাকা পেঁপে নেই। আমি ছুটলাম পাকা পেঁপের সন্ধানে। লিফট থেকে নামতেই এক ভদ্রলোক চোখ বড় বড় করে বললেন, জানেন, আমাদের এই ফ্ল্যাটের কোন এক বাড়িতে জাহানারা ইমাম এসেছেন।
আনন্দে আমার মন দ্রবীভূত হল। এই মহীয়সী নারী কত অল্প সময়ে মানুষের হৃদয় দখল করে নিয়েছেন।
তার মৃত্যু সংবাদ আমাকে দেন আসাদুজ্জামান নূর।
বাসায় তখন ক্যাসেট প্লেয়ার বাজছে। আমার মেয়েরা জন ডেনভারের গান শুনছে ‘রকি মাউন্টেন হাই, কলারাডো।’ সঙ্গে সঙ্গে গান বন্ধ হয়ে গেলো। মেয়েরা তাদের নিজেদের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। আমার মা আমার কাছে জানতে চাইলেন, আন্দোলন এখন কে এগিয়ে নিয়ে যাবে? আমি তাকে বললাম, দ্বিতীয় জাহানারা ইমাম আমাদের নেই। জাহানারা ইমাম দু’টা তিনটা করে জন্মায় না। একটাই জন্মায়। তবে কেউ না কেউ এগিয়ে আসবেই। অপেক্ষা করুন।
মা জায়নামাজে বসলেন।
আর আমি একা একা বসে রইলাম বারান্দায়। এক ধরনের শূণ্যতা বোধ আমার ভেতর জমা হতে থাকল। কেবলি মনে হতে লাগল একটা মস্ত ভুল হতে গেছে। কি পরিমান শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা এই মানুষটির প্রতি আমার ছিল তা তাকে জানানো হয় নি। আমার একটাই স্বান্ত্বনা মৃত্যুর ওপাশের জগত থেকে আজ তিনি নিশ্চয়ই আমার বিপুল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অনুভব করতে পারছেন। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি সবসময়ই তার পাশে ছিলাম। যে ক’দিন বেঁচে থাকবো তাই থাকব। বঙ্গ-জননীর পাশে তার সন্তানরা থাকবে না তা কি কখনো হয়?
বাংলার পবিত্র মাটিতে তার পায়ের চিহ্ন আর পরবে না। স্বাধীনতাবিরোধীদের এই সংবাদে উল্লসিত হবার কিছু নেই। বাংলার হৃদয়ে তিনি জ্বেলে দিয়েছেন অনির্বাণ শিখা। ঝড়-ঝাপ্টা যত প্রচন্ডই হোক না কেন সেই শিখা জ্বলতে থাকবে। কি সৌভাগ্য আমাদের, তিনি জন্মেছিলেন এই দেশে।