সোনার হরিণ
"আমার চাকুরীটা হলে দেখো অন্তত এক টাকা হলেও তোমার বেতনের বেশি হয়। যতোই হোক তুমি তো আমার ছাত্র"। জীবনানন্দ দাশ
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সহপাঠি, জনৈক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আলফাজ হঠাৎ করেই একটা বেসরকারি কোম্পানিতে সিভি ইমেইল করতে বললো। সাতপাঁচ ভেবে ইমেইল করলো তমাল। আলফাজ বললো, দুয়েকদিনের মধ্যেই ইন্টারভিউএর জন্য ডাকা হবে। তমাল যেন যথাসময়ে ইন্টারভিউ দিতে যায়।
"গাজীপুর শাইনিং পাথ হাইস্কুল" এ ক্লাস নিচ্ছিলো তমাল। সময়টা ঠিক দুপুর। এমন সময় ফোনটা এলো। তমালের কাছে জানতে চাওয়া হলো, সে ওখানে ইন্টারভিউ দিতে আগ্রহী কি না। তমাল জানালো, সে ইন্টারভিউ দেবে।
তারা তাকে তারিখ, সময় আর কোম্পানির অবস্থান বলে দিলো।
ইন্টারভিউ এর কোনপ্রকার প্রিপারেশন নেই। স্কুলের কাজকর্মেই ব্যস্ত থাকতে হয় সারাদিন। এইচআর রিলেটেড কোন বইপত্রও নেই যে একটু উল্টেপাল্টে দেখবে, হালকা-পাতলা পড়ালেখা করবে। সব বাড়িতে রেখে এসেছে। দু বছর আগে কী পড়েছে না পড়েছে কিছুই মনে নেই। ইন্টারভিউতে প্রশ্নের উত্তর কী করে দেবে? এই প্রতিযোগিতার বাজারে নিজেকে ঠিকমতো মেলে ধরতে না পারলে চাকুরি হবে? কোম্পানি নিশ্চয়ই তার মুখ দেখে নিয়োগ দেবে না। দুনিয়া বড় কঠিন, আবেগ-অনুভূতি দিয়ে দুনিয়া চলে না। এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো তমাল।
২
সকাল থেকেই প্রচন্ড মাথাব্যথা, সাথে গলাব্যথাও। একদম টিকতে পারছিলো না তমাল। মাথাব্যথা হঠাৎ হলেও গলাব্যথাটা আগে থেকেই ছিল কমবেশি। টনসেল এর সমস্যা আছে। কিছু করার নেই। আজ ইন্টারভিউ। রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে।
গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে বাসে উঠলো তমাল; কন্ডাকটরকে বললো, গড়গড়িয়া মাস্টারবাড়ি নামিয়ে দিতে।
গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে গড়গড়িয়া মাস্টারবাড়ি খুব বেশি দূরে নয়।
পৌনে এক ঘন্টায় পৌঁছে গেল মাওনায়। তাকে বলা হয়েছিলো, মাওনা ফ্লাইওভার থেকে ঢাকার দিকে একটু এগোলেই রাস্তার পশ্চিম পাশের বড় বিল্ডিংটাই কোম্পানির। বড় করে লেখা আছে "মেঘনা নিট কম্পোজিট কোম্পানি লিমিটেড"। পৌঁছতে কোন তেমন সমস্যা হলো না।
ইন্টারভিউ এর জন্য এসেছে," বলতেই দাড়োয়ান গেট খুলে দিলো। পাশেই একটা জায়গায় বসতে দিলো। আরও অনেকের আসার কথা। সবাই আসার আগ পর্যন্ত তাকে এখানেই অপেক্ষা করতে হবে।
কিছুক্ষণ পর এক ভদ্রলোক আসতেই বলা হলো, একজন ক্যান্ডিডেট এসেছে।
ভদ্রলোক তমালের দিকে তাকালেন এবং একটা বিল্ডিং এর দোতলায় নিয়ে গেলেন।
৩
অনেক্ষণ হলো বসে আছে তমাল। অফিসের সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। কিছুটা অসহায় বোধ করছিলো সে। একেবারে নিশ্চুপ এক জায়গায় কতক্ষণ বসে থাকা যায়?
ডেস্কে বসা একজন তাকে এইচআর ম্যানেজারের কাছে যেতে বললেন। উনি পাশেই আর একটা ডেস্কে বসা। এর মধ্যে বয়স্কগোছের এক লোক এককাপ লাল চা দিয়ে গেলেন তমালকে। এ মুহুর্তে চা খুব দরকার ছিল। গলাটা খুসখুস করছিলো কি না।
ম্যানেজার সাহেব ব্যস্ত ছিলেন। একটু ফ্রি হয়েই তমালের মুখোমুখি বসলেন। সিভিটা হাতে নিয়ে প্রশ্ন করা শুরু করলেন।
প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, তমাল নার্ভাস কি না।
তার চেহারা-ছুরত দেখেই উনি বোধহয় বুঝে গিয়েছিলেন সে কিছুটা নার্ভাস। সাহস নিয়ে বললো, না, স্যার।
-আপনাকে দেখেই কিন্তু নার্ভাস মনে হচ্ছে। যাহোক, আমাকে এমনকিছু বলুন যা আপনার সিভিতে উল্লেখ করেন নি?
তমাল একটু থতমত খেলো। কী বলবে ঠিক বুঝতে পারছিলো না। বললো, ঠিক বুঝতে পারি নি, স্যার!
ম্যানেজার ভাবলেন, তমাল ইংরেজিটা বোধহয় বুঝতে পারি নি। যখন বাংলায় জিজ্ঞেস করলেন, তখনও সে নিরুত্তর। উত্তরটা কী হতে পারে?
ভেবেচিন্তে বললো, আমার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের কথা সিভিতে উল্লেখ করি নি।
তমালের উত্তরটা উনার পছন্দ হলো না মনে হয়।
জিজ্ঞেস করলেন, আপনার ফ্রেন্ডলিস্ট এ কয়জন ফ্রেন্ড, আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে কি না; এগুলো কি উল্লেখ আছে?
তমাল না সূচক উত্তর করতেই উনি তার সিভি থেকে খুঁজে খুঁজে দুটো ভুল বের করলেন। ভুলগুলো আগে খেয়াল করে নি তমাল।
এবার তমালের স্টেন্থ কী জানতে চাইলেন ম্যানেজার। সততা, সময়ানুবর্তিতা, কর্তব্যপরায়ণতা কঠোর পরিশ্রম আরও কী কী যেন বললো।
'পরিশ্রম' শব্দটা বোধহয় উনার পছন্দ হয় নি। বললেন, রেজাল্ট খারাপ কেন? তমাল একটু বিব্রত হলো।
বললো, স্কুলে পড়ানোর কারণে পড়ালেখা তেমন করতে পারি নি, স্যার।
-আপনার উইকনেস কী?
সরলতা, মানুষের প্রতি বিশ্বাস আরও কয়েকটা বললো।
উনি বললেন এগুলো দুর্বলতা না।
এবার তমালকে জিজ্ঞেস করলেন, লামসাম পে মানে কী?
তমাল বললো।
কমপেনসেশন ম্যানেজমেন্ট থেকে আরও একটা প্রশ্ন করলেন (কমপারেটিভ পে সিস্টেম কী?)। তমালের উত্তরে উনি সন্তুষ্ট হলেন বলে মনে হলো না।
তমাল এখন কোথায় আছে, কী করছে এরকম আরও অনেক প্রশ্ন করলেন। সে উত্তর দিলো।
হঠাৎ একটা জরুরি ফোন আসায় উনি বাইরে চলে গেলেন। যিনি তমালকে দোতলায় নিয়ে গিয়েছিলেন, তিনি এবার প্রশ্ন করা শুরু করলেন। যথাসম্ভব উত্তর দিচ্ছিলো তমাল। একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলো, তার বেশিরভাগ উত্তর উনার মনঃপুত হচ্ছে না, আগেরজনেরও হয় নি। কী এক বিপদ!
এবার জিজ্ঞেস করলেন, এক্সপেকটেড সেলারি কত?
তমাল একটা পরিমাণ বললো। এ প্রশ্নের উত্তরও ঠিকমতো হয় নি। উনি নির্দিষ্ট একটা রেঞ্জ বলতে বললেন, তাই বললো তমাল। এর আগে তার পোস্ট কী হবে সেটা জেনে নিলো। উনি জানালেন, জুনিয়র এইচআর এক্সিকিউটিভ।
সেলারি কত হতে পারে? জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ফ্রেশার তো, শুরুতে দশ হাজার এর মতো পড়বে।
এরপর জিজ্ঞেস করলেন, তমাল কবে জয়েন করতে পারবে?
তমাল জানালো, সে সবসময়ই প্রস্তুত। সম্ভব হলে দুয়েকদিনের মধ্যেই।
পরিশিষ্টঃ বলা হয়েছিলো শীঘ্রই তমালকে জানানো হবে সে সিলেক্টেড হয়েছে কি না। তমালও মোটামুটি আশাবাদী ছিল, যেহেতু ফ্রেশার নিচ্ছে, একটা সুযোগ হয়তো পেতেও পারে; কোন অভিজ্ঞতা তো আর এখানে লাগছে না।
কয়েকমাস কেটে গেল, কোন ফোন বা ইমেইল আসে নি। তমাল অপেক্ষায় ছিল। অবশেষে দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহর বুঝি ফুরালো।
না, চাকুরিটা তার হয় নি, হবেও না মনে হয়। কীভাবে বোঝা গেল? দুদিন আগে ফেসবুকে তার ভার্সিটির এক বান্ধবী স্ট্যাটাস দিলো যে সে "মেঘনা নিট কম্পোজিট" এ এইচআর এক্সিকিউটিভ পদে যোগদান করেছে। তার মানে, তমাল যে পোস্ট এ ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলো, সে-ই পোস্ট এ সে-ও ইন্টারভিউ দিয়েছে। আর ওখানে তার চাকুরিটা হয়ে গেছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৯:৩৯