গাজীপুরের কোণাবাড়িতে ‘জেনুইন রেসিডেনসিয়াল’ নামে মোটামুটি নামকরা একটা স্কুলে পড়াতাম তখন। সময়টা ২০১৯ সালের প্রথমার্ধ। দুষ্টু ছেলেদের ক্লাস শেষ করে ৬ষ্ঠ শ্রেণির মেয়েদের ক্লাস করাতে গেলাম প্রথমবারের মতো। পুরো ৪৫ মিনিট ক্লাস করালাম (ইংলিশ সেকেন্ড পার্ট)। পড়ার বাইরে কোনো কথা নেই। এত আরাম আর কোনো ক্লাসে পাইনি। মেয়েগুলো এত ভদ্র আর পড়ুয়া, আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
প্রতিদিন চিল্লাপাল্লা করে অন্যসব ক্লাস করি। কিন্তু ৬ষ্ঠ শ্রেণির ক্লাসটা সবসময় নীরব। পড়াতে পড়াতে একদিন মনে হলো, প্রতিদিন তো পড়াই। একদিন ওদের সঙ্গে খোশগল্প করি, ওদের ভালো লাগা, মন্দ লাগা বুঝতে চেষ্টা করি। বাচ্চা মেয়েরা সারাক্ষণ পড়ালেখায় থাকে। ওদের তো একটু বিরতিও দরকার। তাই না?
ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে আলাপ করি। ওদের কথা শুনি। লক্ষ্য করলাম, আমি ওদের বেশ প্রিয় হয়ে ওঠেছি। আমি কোনো কথা বললে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনে যেমন, কোনোদিন স্কুল মিস করলে ওরা অন্য শিক্ষকদের কাছে আমার কথা জিগ্যেস করে।
এভাবে দিন গেল। বছরও পার হলো। ওরা ৬ষ্ঠ থেকে ৭ম শ্রেণিতে ওঠল। ততদিনে তাদের মধ্যে বেশ পরিবর্তনও এলো। আগের ভদ্র মেয়েরা একটু দুষ্টু হয়ে ওঠল। একদিন স্কুলে ঢুকব। রাস্তায় আছি তখনও। হঠাৎ ক্লাসের অধিকাংশ মেয়ে আমাকে দেখে দৌড়ে এলো। বলল, “বাবা, কেমন আছেন?” আশপাশে তাকিয়ে খেয়াল করলাম, অন্য কাউকে বলল কি না। দেখি, আমাকেই বলল।
আমি তো বিয়েই করিনি। এত সন্তান কবে জন্ম দিলাম! নিজেই দ্বিধায় পড়ে গেলাম। পরক্ষণে মনে হলো, আমার তো মাঝেমধ্যে স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে যায়। হয়তো ভুলে গেছি সবকিছু। যাহোক, আশপাশের লোকজন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। মহিলারাও অবাক। বোধকরি তারাও দ্বিধান্বিত।
অন্য একদিন মেয়েদের বললাম, “মায়েরা, সবার সামনে বাবা ডাকলে তো আমার বিয়ে হবে না। বাবা ডাকো ভালো কথা, শ্রেণিকক্ষেই ডেকো।”
এই যে ক্লাসের প্রায় সব মেয়েই আমাকে বাবা সম্ভোধন শুরু করল; এর কারণ হলো, আমি যখন ওদের রোল কল করতাম, মা সম্ভোধন করে নিতাম। যেমন: মা জেরিন, মা বিথি। বোধকরি আর কোনো শিক্ষক তাদের এভাবে আদর করেননি। এসব কারণেই হয়তো আমাকে তারা পছন্দ করত।
ওদেরকে সবসময় তুমি সম্বোধন করতাম। অথচ একদিন কী মনে করে তুই করে বললাম। তারা বলল, “স্যার, আপনি তুই করে বললেন?” তখনও পর্যন্ত অত রাগারাগি করতাম না ক্লাসে। শিক্ষার্থীরা আমার ভদ্রোচিত আচরণ দেখেই অভ্যস্ত। হঠাৎ একটু রাগান্বিত হওয়ায় ওরা একটু চিন্তিত। আমি বললাম, “তোমরা তো আমার মেয়ের মতোই। মেয়েদের তো তুই বলা যায়।”
একদিন ক্লাসে কয়েকজন পড়া পারেনি। লাবনী নামের একজনকে বললাম সামনে আসতে। সে ভয় পাচ্ছিল। আমি বললাম, “সামনে আয় বেটি। আমার বাপের জন্য পাত্রী দেখছি। তোরে আমার পছন্দ হয়েছে।” আমার ঠাট্টা-তামাশায় তার মুখে চওড়া হাসি।
মিথিলা নামের এক ছাত্রীকে শাশুড়ি ডাকতাম। একসময় দেখা গেল আমার সঙ্গে শাশুড়ির মতো আচরণ শুরু করল। মানে জামাইদের সঙ্গে যেমন করে আর কী। টিফিনের খাবার আমাকে জোর করে দেয়। একদিন বললাম, “শাশুড়ি, আমার মতো বুড়োর কাছে মেয়ে বিয়ে দেবেন?” সে বলল, “অবশ্যই দেব।”
মেয়েদের যে আমি অনেক ভালোবাসতাম, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারাও কম বাসত না। তবে একটা ঘটনা মনে পড়লে খুব আহত বোধ করি। এ ঘটনা এটাও সাক্ষ্য দেয় যে, আমি মাঝেমাঝে খুব রুঢ় হয়ে যেতাম।
আমাদের অফিসকক্ষের পাশে একটা রুমে তারা বসত। একদিন ক্লাসে কোনো শিক্ষক ছিলেন না। মেয়েরা খুব হট্টগোল করছিল। আমি গিয়ে ধমকালাম। একটু পর আবারও হৈচৈ। এবার লাঠি নিয়ে আচ্ছামতো পেটালাম।
অফিসে গিয়ে এত মন খারাপ হলো যে কান্না শুরু করলাম। ছাত্রীরা অফিসে এসে আমাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করল। বলল, “আমরা তো আপনার সন্তানের মতোই। শিক্ষক শাসন করবে না তো কে শাসন করবে?”
করোনার সময় স্কুলটা বন্ধ হয়ে যায়। আমি গ্রামে চলে আসি। করোনার পর যদিও স্কুল থেকে ডাক এসেছিল, কিন্তু আর যাওয়া হয়নি। আমি অন্য একটা চাকরিতে যোগদান করি।
স্কুলটা ছেড়ে এলেও বাচ্চাদের কথা প্রায়ই মনে পড়ে আমার। এমন এক মায়ায় ওরা আমাকে বেঁধেছিল, ওদের অনুপস্থিতিতে এখনও বুকের মধ্যে হাহাকার ওঠে।
ঢাকায় এখন একটা টিউশনি শুরু করি। ৩য় শ্রেণির বাচ্চা। ভিকারুননিসায় পড়ে। তার সঙ্গে তার ছোটো বোন প্লে এর বাচ্চাটাও পড়ে। ভারি দুষ্টু। পড়াই, পড়ে। মাঝেমাঝে লিখতে দেরি করলে তাড়া দিলে বলে উঠে, “লিখছি তো বাবা।” আমি তাকে মাঝেমধ্যে ভদ্রমহিলা, বৃদ্ধমহিলা- এরকম ডাকে সম্বোধন করি। সে এমন একটা ভাব নিয়ে থাকে যেন সত্যিই সে বৃদ্ধা। তার এ ভঙ্গিটা ভালো লাগে। মনে মনে ভাবি, আহা বাচ্চাটা। হয়তো একদিন আমিও এমন বাচ্চার পিতা হব।
ওর বড়ো বোন, মানে ৩য় শ্রেণির বাচ্চাটা একটু গম্ভীর। তার মা-বাবার সঙ্গেও তেমন কথা বলে না। আমি যখন প্রথম প্রথম পড়াতে যেতাম, মুখ ভারি থাকত। কয়েকদিন পড়ানো শুরু করার পর দেখি আমি যাওয়ার পর বেশ হাসিখুশি ভাব। বেশিরভাগ সময় দরজা নিজেই খুলে দেয়। ওর মা বলে, অন্য শিক্ষকেরা পড়াতে এলে ঘরের কোণায় লুকিয়ে থাকত, পড়তে চাইত না। আমি গেলে এত খুশি হয়, যা অভাবিত।
ছবি: ইন্টারনেট
স্কুল সংশ্লিষ্ট আরও পোস্ট: ১) বেলাশেষের গান
২) গাজীপুর শাইনিং পাথ হাইস্কুলে অতিবাহিত করা যৌবনের উত্তাল সাড়ে ছয়মাস একদিন
৩) জীবননদীর ঘাটেঘাটে
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৪