somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমি আর আমার দুষ্টু ছাত্রীরা

২১ শে মে, ২০২৩ রাত ১১:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


গাজীপুরের কোনাবাড়িতে মোটামুটি নামকরা একটা স্কুলে পড়াতাম তখন। সময়টা ২০১৯ সালের প্রথমার্ধ। দুষ্টু ছেলেদের ক্লাস শেষ করে ৬ষ্ঠ শ্রেণির মেয়েদের ক্লাস করাতে গেলাম প্রথমবারের মতো। পুরো ৪৫ মিনিট ক্লাস করালাম (ইংলিশ সেকেন্ড পার্ট)। পড়ার বাইরে কোনো কথা নেই। এত আরাম আর কোনো ক্লাসে পাইনি। মেয়েগুলো এত ভদ্র আর পড়ুয়া, আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

প্রতিদিন চিল্লাপাল্লা করে অন্যসব ক্লাস করি। কিন্তু ৬ষ্ঠ শ্রেণির ক্লাসটা নীরব। পড়াতে পড়াতে একদিন মনে হলো, সবসময় তো পড়াই। একদিন ওদের সঙ্গে খোশগল্প করি, ওদের ভালো লাগা, মন্দ লাগা বুঝতে চেষ্টা করি। বাচ্চা মেয়েরা সারাক্ষণ পড়ালেখায় থাকে। ওদের তো একটু বিরতিও দরকার। তাই না?

ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে আলাপ করি। ওদের কথা শুনি। লক্ষ্য করলাম, আমি ওদের বেশ প্রিয় হয়ে উঠেছি। আমি কোনো কথা বললে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনে যেমন, কোনোদিন স্কুল মিস করলে ওরা অন্য শিক্ষকদের কাছে আমার কথা জিগ্যেস করে।

এভাবে দিন গেল। বছরও পার হলো। ওরা ৬ষ্ঠ থেকে ৭ম শ্রেণিতে উঠল। ততদিনে তাদের মধ্যে বেশ পরিবর্তনও এল। আগের ভদ্র মেয়েরা একটু দুষ্টু হয়ে উঠল।

একদিন স্কুলে ঢুকব। রাস্তায় আছি তখনও। হঠাৎ ক্লাসের অধিকাংশ মেয়ে আমাকে দেখে দৌড়ে এল। বলল, "বাবা, কেমন আছেন?" আশপাশে তাকিয়ে খেয়াল করলাম, অন্য কাউকে বলল কি না।
দেখি, আমাকেই বলল।

আমি তো বিয়েই করিনি। এত সন্তান কবে জন্ম দিলাম! নিজেই দ্বিধায় পড়ে গেলাম। পরক্ষণে মনে হলো, আমার তো মাঝেমধ্যে স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে যায়। হয়তো ভুলে গেছি সবকিছু।

যাহোক, আশপাশের লোকজন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। মহিলারাও অবাক। বোধকরি তারাও দ্বিধান্বিত।

অন্য একদিন মেয়েদের বলেছিলাম, "মায়েরা, সবার সামনে বাবা ডাকলে তো আমার বিয়ে হবে না। বাবা ডাকো ভালো কথা, শ্রেণিকক্ষেই ডেকো।"

এই যে ক্লাসের প্রায় সব মেয়েই আমাকে বাবা সম্ভোধন শুরু করল; এর কারণ হলো, আমি যখন ওদের রোল কল করতাম, মা সম্ভোধন করে নিতাম। যেমন: মা জেরিন, মা বিথি। বোধকরি আর কোনো শিক্ষক তাদের এভাবে আদর করেনি। এসব কারণেই হয়তো আমাকে পছন্দ করত।

ওদেরকে সবসময় তুমি সম্বোধন করতাম। অথচ একদিন কী মনে করে তুই করে বললাম। তারা বলল, "স্যার, আপনি তুই করে বললেন?"
তখনও পর্যন্ত অত রাগারাগি করতাম না ক্লাসে। শিক্ষার্থীরা আমার ভদ্রোচিত আচরণ দেখেই অভ্যস্ত। হঠাৎ একটু রাগান্বিত হওয়ায় ওরা একটু চিন্তিত।
আমি বললাম, "তোমরা তো আমার মেয়ের মতোই। মেয়েদের তো তুই বলা যায়।"

একদিন ক্লাসে কয়েকজন পড়া পারেনি। লাবনী নামের একজনকে বললাম সামনে আসতে। সে ভয় পাচ্ছিল। আমি বললাম, "সামনে আয় বেটি। আমার বাপের জন্য পাত্রী দেখছি। তোরে আমার পছন্দ হয়েছে।"
আমার ঠাট্টা-তামাশায় তার মুখে চওড়া হাসি।

মিথিলা নামের এক ছাত্রীকে শ্বাশুড়ি ডাকতাম। একসময় দেখা গেল আমার সঙ্গে শ্বাশুড়ির মতো আচরণ শুরু করল। মানে জামাইদের সঙ্গে যেমন করে আর কী। টিফিনের খাবার আমাকে জোর করে দেয়। একদিন বললাম, "শ্বাশুড়ি, আমার মতো বুড়োর কাছে মেয়ে বিয়ে দেবেন?"
সে বলল, "অবশ্যই দেব।"

মেয়েদের যে আমি অনেক ভালোবাসতাম, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারাও কম বাসত না। তবে একটা ঘটনা মনে পড়লে খুব আহত বোধ করি। এ ঘটনা এটাও সাক্ষ্য দেয় যে, আমি মাঝেমাঝে খুব রুঢ় হয়ে যেতাম।

আমাদের অফিসকক্ষের পাশে একটা রুমে তারা বসত। একদিন ক্লাসে কোনো শিক্ষক ছিলেন না। মেয়েরা খুব হট্টগোল করছিল। আমি গিয়ে ধমকালাম। একটু পর আবারও হৈচৈ। এবার লাঠি নিয়ে আচ্ছামতো পেটালাম।

অফিসে গিয়ে এত মন খারাপ হলো। কান্না শুরু করলাম। ছাত্রীরা অফিসে এসে আমাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করল। বলল, "আমরা তো আপনার সন্তানের মতোই। শিক্ষক শাসন করবে না তো কে শাসন করবে?"

করোনার সময় স্কুলটা বন্ধ হয়ে যায়। আমি গ্রামে চলে যাই। করোনার পর যদিও স্কুল থেকে ডাক এসেছিল, কিন্তু যাওয়া হয়নি। আমি অন্য একটা চাকরিতে যোগদান করি।

স্কুলটা ছেড়ে এলেও বাচ্চাদের কথা প্রায়ই মনে পড়ে। এমন এক মায়ায় ওরা আমাকে বেঁধেছিল, ওদের অনুপস্থিতিতে এখনও বুকের মধ্যে হাহাকার উঠে।

ঢাকায় এখন একটা টিউশনি করি। ৩য় শ্রেণির বাচ্চার সঙ্গে তার বোন প্লে এর বাচ্চাটাও পড়ে। ভারি দুষ্টু। পড়াই, পড়ে। মাঝেমাঝে লিখতে দেরি করলে তাড়া দিলে বলে উঠে, "লিখছি তো বাবা।" আমি তাকে মাঝেমধ্যে ভদ্রমহিলা, বৃদ্ধমহিলা- এরকম ডাকে সম্বোধন করি। সে একটা ভাব নিয়ে থাকে যেন সত্যিই সে বৃদ্ধ। তার এ ভঙ্গিটা ভালো লাগে। মনে মনে ভাবি, আহা বাচ্চাটা। হয়তো একদিন আমিও এমন বাচ্চার পিতা হব।

ওর বড়োবোন, মানে ৩য় শ্রেণির বাচ্চাটা একটু গম্ভীর। তার মা-বাবার সঙ্গেও তেমন কথা বলে না। আমি যখন প্রথম প্রথম পড়াতে যেতাম, মুখ ভারি থাকত। কয়েকদিন পড়ানো শুরু করার পর দেখি আমি যাওয়ার পর বেশ হাসিখুশি ভাব। বেশিরভাগ সময় দরজা নিজেই খুলে দেয়। ওর মা বলে, অন্য শিক্ষকেরা পড়াতে এলে ঘরের কোণায় লুকিয়ে পড়ত, পড়তে চাইত না। আমি গেলে এত খুশি হয়, যা অভাবিত।

ছবি: ইন্টারনেট

স্কুল সংশ্লিষ্ট আরও পোস্ট: ১) বেলাশেষের গান
২) গাজীপুর শাইনিং পাথ হাইস্কুলে অতিবাহিত করা যৌবনের উত্তাল সাড়ে ছয়মাস একদিন
৩) জীবননদীর ঘাটেঘাটে


সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০২৩ ভোর ৬:১৯
১৫টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পরিণতি - ৩য় পর্ব (একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস)

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১২:২৮



( পরিণতি ৬১ পর্বে'র একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস ।)

তিন


আচানক ঘুম ভেঙ্গে গেলো ।

চোখ খুলে প্রথমে বুঝতে পারলাম না কোথায় আছি । আবছা আলোয় মশারির বাহিরে চারপাশটা অপরিচিত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইফতার পার্টি মানে খাবারের বিপুল অপচয়

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৩



গতকাল সরকারি ছুটির দিন ছিলো।
সারাদিন রাস্তাঘাট মোটামুটি ফাকাই ছিলো। ভাবলাম, আজ আরাম করে মেট্রোরেলে যাতায়াত করা যাবে। হায় কপাল! মেট্রো স্টেশনে গিয়ে দেখি গজব ভীড়! এত ভিড়... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×