২০১৬ সালের কোনো একদিন সৌরভের সঙ্গে ত্রিশালে দেখা হয়েছিল আমার। কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে এসেছিল সে। আমি তখন ময়মনসিংহ শহরে থাকতাম।
ছোটোখাটো গড়নের ছেলেটা। শ্যামলা গায়ের রং। তামিল সিনেমার নায়কদের মতো গোঁফ। মুখে সবসময় আঠার মতো হাসি লেগে থাকে। আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরল সে। তারপর তার বুকের ভেতর জমিয়ে রাখা যত কথা, সব আমাকে বলল। একসঙ্গে চা খেলাম আর খোশগল্প করলাম। সাংস্কৃতিক সন্ধ্যেটা একসঙ্গে উপভোগ করলাম।
আমার এক সহপাঠিনী নিশাতের ছোটো ভাই ছিল সে। টুকটাক লেখালেখি করত। কীভাবে যেন আমার ফেসবুক আইডি পেয়েছিল সে। তারপর একদিন নক দেয় ইনবক্সে। চিনতে না পারলে তার বোনের পরিচয় দেয়। তখন আমি চিনতে পারি।
তার বোন আমাকে বোধকরি খুব একটা পছন্দ করত না। পড়ালেখার বাইরে সাহিত্য সংগঠনগুলোর দিকে বেশি ঝুঁকে গিয়েছিলাম। সৌরভের সঙ্গে আড্ডার একপর্যায়ে সে সৌরভকে তাড়া দিচ্ছিল যেন তাড়াতাড়ি চলে আসি। সে হয়তো চাচ্ছিল না তার ভাইও আমার মতো উচ্ছন্নে যাক।
সেটাই সৌরভের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। তাকে একবার বইমেলায় একটা স্টলে বই বিক্রি করতে দেখেছিলাম। ততদিনে সে বামরাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। তার একাধিক অনুবাদের বইও বেরিয়েছে।
তারও আগে একবার ময়মনসিংহে ছাত্রফ্রন্টের একটা অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। বামরাজনীতির প্রতি তার অসীম মুগ্ধতা ছিল। ফেসবুকে মাঝেমধ্যে এটা-সেটা নিয়ে কথা বলত। আমি তার চিন্তা-ভাবনার গভীরতায় মুগ্ধ হতাম।
ফেসবুকে আমার কী একটা লেখা পড়ে সে মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিল। সম্ভবত লিখেছিলাম, ঢাকা শহরে কাকের চেয়ে কবির সংখ্যা বেশি। আমি নিজেও তো কবিতা লিখি, কথাটা অপমানসূচক হলে তো আমার ওপরও অপমানটা বর্তায়। তাহলে সে কেন মন খারাপ করবে, বুঝতে পারিনি। এরপর আর কখনও সে আমাকে নক দেয়নি। বইমেলায় স্টলে যখন দেখলাম, একবার ভাবলাম দেখা করে আসি। ব্যস্ত মনে হওয়ায় আর এগোইনি।
একদিন কেউ একজন ফেসবুকে পোস্ট করল সৌরভ মাহমুদ আত্মহত্যা করেছে। অন্য কোনো সৌরভ ভেবেছিলাম আমি। ছবি দেখে বুঝতে পারলাম আমি যে সৌরভকে চিনতাম, আসলে সে-ই আত্মহত্যা করেছে। সৌরভের বন্ধু শান্ত আমার ফ্রেন্ডলিস্টে ছিল, আমি তাকে জিগ্যেস করতে পারতাম। তাছাড়া তার বোনও ফ্রেন্ডলিস্টে ছিল, তাকেও জিগ্যেস করা যেত। অথচ কাউকে জিগ্যেস করা হয়নি।
আসলে আমি সৌরভকে জীবিত ভাবতেই পছন্দ করতাম। এত কম বয়সি প্রাণোচ্ছল একটা ছেলে আত্মহত্যা করবে; কী এমন দুঃখ ছিল তার এটা ভাবতেই কষ্ট হচ্ছিল আমার। আসলে আমি চাচ্ছিলাম সে আমার কল্পনায় বেঁচে থাকুক।
আমার ধারণা সে হয়তো হতাশাগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিল। লেখালেখি নিয়ে তার যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল; সেটা হয়তো বাস্তবায়িত হচ্ছিল না। অথবা এমনও হতে পারে, সে যে রাজনৈতিক ভাবাদর্শে বিশ্বাসী; সেসব বাস্তবায়ন হওয়া অসম্ভব হওয়ায় হীনমন্যতায় ভুগত। পারিবারিক অথবা প্রেমঘটিত কোনো ব্যাপারও হতে পারে। আমি বেশি ঘাঁটতে যাইনি।
ছবি: ইন্টারনেট
মৃত্যু সংশ্লিষ্ট আরও লেখা: ১) কৈশোরে যে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘মরণ রে তুহুঁ মম শ্যাম সমান’, বার্ধক্যে সেই তিনিই আবার বলেছিলেন, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে’
২) আমি কারও মরামুখ দেখতে পারি না
৩) গোরস্তান (একটি কবরের আত্মকাহিনী)
৪) আত্মহত্যার আগে
৫) শ্মশানঘাট