somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। পিকিংনামা , বেইজিং ল্যাঙ্গুয়েজ ইউনিভার্সিটি

১৪ ই নভেম্বর, ২০২২ সকাল ১১:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিএল ইউ ওয়েব



সেপ্টেম্বর ২০২২ আমার চীনে যাওয়ার ৪০ বছর পূর্তি । ভেবেছিলাম একটা ধারাবাহিক লেখা শুরু করব । অলসের কোন ধারাবাহিকতা নেই । পুরাতন লেখাই ছেপে দিচ্ছি । এরপর বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ঘটনা বর্ণনা করব অল্প পরিসরে ।

সেপটেম্বর ১৩,১৯৮২ । আমরা তিনজন চারুকলার ছাত্র প্রথমবারের মত চীনা সরকারী বৃত্তি নিয়ে বেইজিং পৌঁছলাম । ছোট দোতালা পুরানো একটি দালানে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস এর যাবতীয় কাজ হয় । যাত্রী এই এক প্লেন কাজেই খুব দ্রুত আমরা বাইরে এসে টেলিফোন আলাপ ও হেল্প ডেস্ক থেকে ট্যাক্সি ড্রাইভারের হাতে সমর্পিত হয়ে একটি কালো রঙের রাশিয়ার তৈরি গাড়িতে চলতে শুরু করলাম। ঈষৎ গরম এবং অচেনা শুকনো আবহাওয়ায় বড্ড অস্বস্তিতে ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্সটিটিউটের দিকে চলছি । ভাষার কারনে ড্রাইভারের সাথেও যোগাযোগ বন্ধ। আমাদের দুদিকে প্রচুর গাছের সারি মাঝ দিয়ে সরু রাস্তা। আমাদের আগে পিছে কোন গাড়ী টাড়ি নেই। রাস্তায় সাইকেল চালককে মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম। খুব কর্কশ চেহারা, মাথায় নীল টুপি, গায়ে নীল পোশাক , খুব নোংরা । একইভাবে এক তরুণী সাইকেল চালাচ্ছে । তার চেরি ফুলের মত গালের চারদিক আশাহত অপরিচ্ছন্ন । তার লালচে চুল জানান দিল চায়না রিকন্সট্র্যাক্ট পত্রিকায় যাদের ছবি ছাপা হয় তার সাথে এদের কোন মিলঝুল নেই। দূর থেকে দালান কোঠা দেখে বুঝলাম আমরা শহরের কাছে।
প্রশস্ত রাস্তা , ভিড় নেই, দুধারে পুরাতন দ্বিতল ও নতুন ৬ থেকে ১৪ তালা পর্যন্ত বাড়িঘর। এখানে সাইকেলের জন্য দুধারে আলাদা রাস্তা ।রাস্তায় ইলেকট্রিক চালিত বাস দেখে ভাল লাগলো । মস্কোর বাসের কথা শুনেছি তা দেখলাম বেইজিঙে । হংকঙে তিন দিন আটকে থাকার পর তার জৌলুশপূর্ণ জীবন দেখে বেইজিংকে এতিম এতিম লাগছে। আবারো ধেনো জমি দেখা গেলে বুঝলাম আমরা শহর পার হয়ে আরেকটি শহরতলীর প্রান্তে। আমি সাইদ বেবুল এযাবত কেউ কারও সাথে কথা বলিনি বোধ করি আশাপ্রদ বিদেশের কাম্য চিত্রের সাথে মিলঝুল হচ্ছিল না বলে।
আমি অবশ্য যে কোন পরিস্থিতির জন্য তৈরি হয়ে এসেছিলাম এবং তা পরিচিতজনদেরও বলেছিলাম। একটা কমিউনিস্ট দেশকে গাঁটের পয়সা খরচ করে দেখতে পাবো না কখনই – এরকম ইচ্ছায় আমি হাল তুলেছিলাম শক্ত হাতে। আসার আগে কেউ কেউ বলেছিল জেলখানায় যাচ্ছ, কিন্তু আমরা কেউই চীন সম্পর্কে জানিনা। চীনের প্রোপাগান্ডা পত্রিকাগুলোর চমৎকার সুদর্শন চাষি ও বালিকার কোন সন্ধান না পেয়ে আমি হতাশ হচ্ছিলাম।
একটা বিশাল পিঙ্ক রঙের দালানের সামনের গেটে আমরা দাঁড়ালাম । এগিয়ে আসা নোংরা সবুজ মাও কোটের থুরথুরে বুড়োকে ড্রাইভার অজানা ভাষায় কিছু বলল। বুড়ো প্রথমে উকি দিয়ে তিন আদমকে দেখে নিয়ে হাত তুলতেই বিশাল গেটের একটি ঘড়ঘড় করে একদিকে খুলে গেল। বেশ চমৎকৃত ব্যাপার । আমাদের পিছনেই রাস্তার অপর পাশে এরকম একটি ভবনের সামনে সাদা রঙের মাও জে তুং এর একহাত ওঠানো ভাস্কর্য। গাড়ি ভিতরে ঢুকতে যে সময় তার কয়েক সেকেন্ড ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিলাম এবং বললাম আছি যখন তখন দেখতে পাবো অহরহ । বিস্ময়ে অভিভুত হবার বিষয় বৃক্ষের সমাহারে । এত গাছ যে মনটাকে চাঙ্গা করে তুলল এই প্রথম। গাছের ফাকা দিয়ে ব্রিটিশ আমলের তৈরি দালান উকিঝুকি মারছে। দারুন ব্যাপার। দূর থেকে ওপরে টালি দেওয়া ইংলিশ কায়দার পুরনো দালান । ডানে গ্যালারিবিহিন একটা স্টেডিয়াম রেখে আমরা বায়ে ঢুকলাম । ডান হাতে দুটো টেনিস কোর্ট উচু করে ঘেরা। আবার ডানে ঘুরে বাস্কেট খেলার বিশাল চত্বরের পাশে পার্ক বেঞ্চে বসে সাদা এক যুবক বিড়ি ফুকছিল । তাকে ড্রাইভার সেই চাং চুং শব্দে কিছু বললে সেও চাংচুং এ উত্তর দিল । আমাদের টোটাল কনসেন্ট্রেশন এখন যা ঘটছে তার দিকে। সাহস বাড়িয়ে দিল যুবক যে, না আমরাও পারব ওর মত কথা বলতে । আমরা বুঝতে পারছি এই যে সারি দেওয়া দালান এগুলো ডরমিটরি । সিমেন্ট বাধান অসংখ্য বাস্কেট মাঠে সাদা এবং কালো সব রঙের ছেলেরা খেলছে ফুটবল । বায়ে ঘুরে আখরোট গাছের পাশ দিয়ে আমরা যে ভবনটির সামনে দাঁড়ালাম তার দরজার ওপর ইংরেজিতে লিউ লৌ লেখা , পাশে ৬ লেখাটাও আছে । এই লিউ লৌ শব্দটি সাদা যুবক ড্রাইভারকে বলেছিল । খাটো , চওড়া এক বয়স্ক লোক কোন হাঁকডাক ছাড়াই বেরিয়ে এল ভিতর থেকে, মৃদু হাসি তার মুখে । ড্রাইভার কথা না বলে দরজা খুলে ধরতেই আমরা বুঝলাম আমাদের ইস্পিত জায়গায় এসে পড়েছি । বুড়ো আমাদের নি হাও বলে মালপত্র হাতে তুলে দরজার কাছে অপেক্ষমান আর সাইদ ড্রাইভারের সাথে ইশারায় দাম নিয়ে আলাপ করছে। ওর হাতে একটা ছাপানো ফর্দ যাতে কোথা থেকে কোথায় কত ভাড়া তা লেখা। আমরা সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় ঠিক মাঝ বরাবর বারান্দা দিয়ে এগুলাম দারোয়ান আমাদের হাউ মাউ করে কিছু বলল আর আমরা বিজ্ঞের মত মাথা দুলিয়ে তা বুঝলাম। দুদিকে রুম , শাহনেওয়াজ হলের মত নয়। পাশাপাশি দুটি রুম খুলে দিল আমাদের। বেবুল আর আমি একটায় আর সাইদ পাশেরটায় । বিছানা হাসপাতালের খাটের মত লোহার তবে তাতে বিছানো নতুন চাদর আর পাট ভাঙা বালিশের কভার ওপরে ছোট তোয়ালে দিয়ে মোড়ানো। একটা কাঠের ওয়ারড্রব আর টেবিল চেয়ার তো আছেই। ফ্লোরে রাখা দুটি জিনিসের প্রতি আগ্রহ জন্মাল । এর একটা ঢাউস সাইজের নতুন ঝকঝকে ফ্লাস্ক আর দ্বিতীয়টির কাজ কি তা নিয়ে আমি এবং বেবুল নীরব গবেষণা করতে লাগলাম । হটাত বেবুল সেই বড় গামলা যাতে আমাদের হলে ভাত দেওয়া হত তা নিয়ে দৌড়ে পাশে সাইদের রুমে গেল বোঝার জন্য। ওরা দুজন খানিক বাদে আবার একযোগে হুড়মুড় করে আমার রুমে এসে সব কিছু হাতে ছুয়ে বলল নাহ শুধু আমাকে একা নয় তোদেরও দেখছি সব নতুন দিয়েছে । কিন্তু গামলার কাজটা কি ? আমরা সবাই বললাম আছি যখন তখন গামলা রহস্য জানা যাবে । সাইদ বলল যাই বিশ্রাম করি , যা ধকল গেছে তিন তিনটা দিন। বেবুলও গেল সাইদের সাথে। কেডস খুলে জানালার পাশে দাঁড়ালাম । বাইরের দৃশ্য মনোরম । রাস্তার দুদিকে সারি দিয়ে ঠিক কত হাজার বার্চ ট্রি আছে তা জানিনে তবে কয়েক কোটি ঝিঁঝিঁ পোকার ঐকতান কান খারাপ করে দিচ্ছে। সিগারেট ধরালাম একটা । রাস্তার ওপাশে বেড়ার অস্তিত্ব পাওয়া গেল । কজন মানুষের চলাচল দেখতে পেলাম তবে পাদুখানা দেখা যায় শুধু । ডাবল জানালা। একটা নেটের একটা গ্লাসের । নেট খুলে উকি দিলাম আকাশ দেখব বলে, দেখলাম নীল আকাশ , মেঘমুক্ত। সিগারেটে লম্বা টান মেরে ধুঁয়া বাইরে ছুড়ে দিলাম।
হটাৎ, হ্যা হটাৎই মনে এলো আমি এখন বিদেশ বিভুইয়ে । শিহরণ জাগল মনে ! আমি এখন এক ভিন্ন জাতি ও সমাজে । ইচ্ছে হলেই বাসে করে মাকে দেখতে যাওয়া যাবেনা খুলনাতে । ইচ্ছে হলেই বাগদত্তা বান্ধবীকে দেখা যাবেনা, খুব অসহায় মনে হল নিজেকে ।
এতগুলো দিন কাটবে কিভাবে ?
ঝরঝর করে কেদে ফেললাম । কান্নার গমক এত বেশি যে দৌড়ে বিছানার বালিশে উপুড় হয়ে মুখ চেপে ধরলাম। আমার এত জোরে চিৎকার করে কান্না আসছে যে আমি নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে পড়েছি । অঝোরে কেদে বালিশ ভেজালাম, রুদ্ধ ধরা গলায় মাথা উঠিয়ে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বললাম “মা আমি আবার কবে তোমায় দেখব” ?
পৃথিবীর তাবৎ দুঃখমালা আমার বালিশে এসে ঠাই নিল ।
জীবনের সবচে অসহায় সময় আমায় আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেধে ফেলল ।।

দুঃখ (অক্টোবর ২০১৫)
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই নভেম্বর, ২০২২ দুপুর ১২:০০
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×