ভূমিকম্প মানুষ এবং পরিবেশের উপর ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় ভাবেই প্রভাব ফেলতে পারে। আমরা ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দূর্যোগের ফলে শুধু ক্ষতির কথা চিন্তা করি। সেজন্যে, ভয় পেয়ে যাই। কিন্তু, প্রকৃতি থেকে সৃষ্টি হওয়া এই দূর্যোগের ইতিবাচক দিকটাও আমাদের ভেবে দেখতে হবে। এখানে ভূমিকম্পের কিছু সুবিধা এবং অসুবিধা আলোচনা করা হয়েছে:
ভূমিকম্পের ইতিবাচক দিকঃ
১) নতুন ভূমিরূপের সৃষ্টি:
ভূমিকম্পের ফলে নতুন ভূমির সৃষ্টি হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, দুটি টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষের ফলে হিমালয় পর্বতমালা তৈরি হয়েছিল। ২০১৫ সালে নেপালের ভূমিকম্প, যার মাত্রা ছিল ৭.৮, কিছু এলাকায় ৩ মিটার পর্যন্ত উল্লম্ব উত্থান ঘটায়, যা হিমালয়ের বৃদ্ধিতে আরও অবদান রাখে। ১৯৬৪ সালের গ্রেট আলাস্কা ভূমিকম্পটি নতুন ভূমিরূপ তৈরি করে যার মধ্যে উঁচু সৈকত এবং দ্বীপের সৃষ্টি হয়।
২) খনিজ এবং সম্পদের মুক্তি:
ভূমিকম্প খনিজসম্পদগুলিকে উঠিয়ে আনতে পারে যা পূর্বে পৃথিবীপৃষ্ঠের নীচে আটকে ছিল। উদাহরণস্বরূপ, চিলিতে ২০১০ সালের ভূমিকম্প ছিলো ৮.৮ মাত্রার। এই ভূমিকম্পের ফলে দেশটির ভূপৃষ্ঠ থেকে তামার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ উপরে উঠে আসার কারণ ছিলো, উল্লেখ্য যে, তামা চিলির প্রধান রপ্তানি পণ্যগুলির মধ্যে একটি। জাপানের কোবেতে ১৯৯৫ সালের ভূমিকম্পের ফলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাস মুক্তি পায়, যা শহরের পুনর্গঠনের প্রচেষ্টাকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করেছিল।
৩) বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান:
ভূমিকম্প অধ্যয়ন বিজ্ঞানীদের পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন এবং টেকটোনিক কার্যকলাপ আরও ভালভাবে বুঝতে সাহায্য করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, জাপানের উপকূলে ২০১১ সালের ভূমিকম্প, রিক্টার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ৯.০। এই ভূমিকম্প বিজ্ঞানীদের সাবডাকশন জোনের মূল্যবান তথ্য সরবরাহ করেছিল, যেখানে প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেট ইউরেশিয়ান প্লেটের নীচে চলে যায়।
৪) ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বৃদ্ধি:
ভূমিকম্প জল প্রবাহের জন্য নতুন পথ তৈরি করতে পারে, যা ভূগর্ভস্থ জলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ক্যালিফোর্নিয়ায় ১৯৮৯ সালের লোমা প্রিটা ভূমিকম্পের ফলে ভূ-পৃষ্ঠে নতুন ফাটল সৃষ্টির কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বৃদ্ধি পায়।
৫) উন্নত বিল্ডিং কোড:
ভূমিকম্প ভবিষ্যতের ভূমিকম্পকে আরও ভালভাবে মোকাবেলা করার জন্য বিল্ডিং কোড এবং নির্মাণ কাজ অনুশীলনে উন্নতি ঘটাতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, জাপানের কোবেতে ১৯৯৫ সালের ভূমিকম্পটি শ্বেই দেশের সরকারকে বিল্ডিং কোড এবং অবকাঠামো পরিবর্তনে বাধ্য করে যা পরবর্তী ভূমিকম্পের প্রভাব কমাতে সাহায্য করেছিল।
৬) জরুরী প্রতিক্রিয়া প্রস্তুতি:
ভূমিকম্প একটি দেশের জনগণকে এবং সেই দেশের প্রশাসনকে ভবিষ্যতের দুর্যোগের জন্য প্রস্তুত করতে সহায়তা করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ক্যালিফোর্নিয়ায় ১৯৯৪ সালের নর্থ্রিজ ভূমিকম্পের ফলে রাজ্যের জরুরি প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থার উন্নতি হয় এবং ভূমিকম্প সুরক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি পায়।
ভূমিকম্পের নেতিবাচক দিকঃ
১) সম্পত্তির ক্ষতি:
ভূমিকম্প ভবন, অবকাঠামো এবং অন্যান্য সম্পত্তির উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করতে পারে, যার ফলে একটি দেশের নাগরিকরা আর্থিক ভাবে এবং বাস্তুচ্যুত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১০ সালের হাইতি ভূমিকম্প, যার মাত্রা ছিলো ৭.০। এরফলে, ভবন এবং অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়, ১৫ লক্ষের বেশি মানুষকে গৃহহীন করে।
২) প্রাণহানি:
ভূমিকম্পের কারণে মানুষ আহত হয়, প্রাণহানিও ঘটতে পারে। বিশেষ করে মানহীন বিল্ডিং কোড বা অবকাঠামো আছে এমনসব এলাকায় এমনটা ঘটে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, জাপানে ১৯৯৫ সালের কোবে ভূমিকম্পের কথা বলা যায়, যার মাত্রা ৬.৯ ছিল। এই ভমিকম্পের ফলে জাপানের মতো উন্নত দেশেও ৬,৪০০-জনের বেশি মৃত্যু এবং হাজার হাজার মানুষ আহত হয়।
৩) জাতীয় সম্পদের ক্ষতি:
ভূমিকম্পের ফলে বিশেষ ধরণের বিপদ হতে পারে, যেমন ভূমিধস, সুনামি এবং অগ্নিকাণ্ড, যা ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট ক্ষতিকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, জাপানে ২০১১ সালের তোহোকু ভূমিকম্প এবং ৯.০ মাত্রার সুনামি ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করেছিল এবং ফুকুশিমা দাইচি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে একটি পারমাণবিক বিপর্যয় ঘটায়।
৪) অর্থনৈতিক প্রভাব:
ভূমিকম্পগুলি জাতীয় অর্থনীতিকে ব্যাহত করতে পারে, বিশেষ করে সেটা যদি পর্যটন বা কৃষির উপর বেশি নির্ভরশীল এলাকায় ঘটে। উদাহরণস্বরূপ, মধ্য ইতালিতে ২০১৬ সালের ভূমিকম্প, যার মাত্রা ছিল ৬.২। এই ভূমিকম্প ঐতিহাসিক ভবন এবং ল্যান্ডমার্কগুলির উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করেছে, যা এই অঞ্চলের পর্যটন শিল্প প্রভাবিত হয়েছিলো।
যে কোন দেশের মানুষের জন্যে ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দূর্যোগ খারাপ ফল বয়ে আনতে পারে। সেজন্যে, প্রস্তুত থাকা প্রয়োজন।