এখন যদি কাউকে সরাসরি জিগ্গেস করা হয় আপনার অনর্্তজগতের কি হালচাল, তাহলে প্রথমে তিনি হয়ত প্রশ্নটিকে বুঝতে পারবেন না; সৌভাগ্যক্রমে তিনি যদি মনোযোগী শ্রোতা হন তাহলে হয়ত একটু বোঝার চেষ্টা করবেন এবং মোটামুটি শতভাগ েেত্র আপনার প্রশ্নটি অনেকগুলো ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলবে। বিষয়টি এমনও হয়ে উঠতে পারে যে যাকে প্রশ্ন করা হল তিনি কিঞ্চিত অপমানিত বোধ করলেন এবং বাস্তব জগতের বাইরে কোন অযৌক্তিক ও দূরহ প্রসঙ্গ উত্থাপনের মধ্য দিয়ে আপনি তাঁর বোধজগতকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছেন কিনা এমন সন্দেহও তার মধ্যে দাঁনা বাঁধতে শুরু করতে পারে।
আমরা আমাদের অনর্্তজগত সম্পর্কে কখনোই তেমন সচেতন থাকিনা। সাধারনভাবে
অনর্্তজগত বলতে আমরা চেপে রাখা দু:খ, কষ্ট, অপরাধবোধ বা অন্যভাবে গোপন সুখ, অভিসার বা ণিক উত্তেজনার বাইরে কোন কিছুকে চিহি্নত করতে ব্যার্থ হই। এর একটি বড় কারণ হল আমাদের অনর্্তজগতের এলাকাটি এখনো অনেক দরিদ্র। কেউ কেউ এমনও আছেন যারা অনর্্তজগত বলতে একটি ধর্মীয় আবেশের আত্মিক সংবেদনের সন্ধানে থাকেন। কিন্তু অনেক খুঁজেও আপনি আত্মাকে আসলে চিহি্নত করতে পারবেন না। কেননা যা
অস্তিত্বহীন তাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। এমনকি কবি সাহিত্যিক অথবা প্রথাগত স্পিরিচুয়ালিজমের চর্চাকারী কারো উপলব্ধিই খুব সহজ ভাবে বললে তার শরীর ও মগজের বাইরে নয় অথবা আরো স্পষ্ট করে বললে তার শরীরের বাইরের কিছু নয়। যদিও মানুষ দীর্ঘকাল এই ভ্রান্তিতে ভুগেছে এবং এখনো ভুগতে ভালোবাসে যে তার অনেক কিছুই মগজ ও শরীরের পরপারের একটা কিছু। এটা এক ধরণের মহত্ব আরোপণ। আত্মপুঁজা প্রবণতারও এটি একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে অনর্্তজগত বলতে আমরা কি বুঝব। খুব সহজভাবে বললে
অনর্্তজগত হল আমাদের উপলব্ধির জগত, আমাদের বোধের জগত, নতুন চিন্তাভাবনা ও সৃষ্টির জগত এবং কখনো কখনো ভুল ও অপ উপলব্ধির জগতও বটে। বিভিন্ন মানুষের
অনর্্তজগত পরিমাপের যেহেতু কোন প্রমিত পদ্ধতি বা মান নেই সেহেতু আমরা যেটা করতে পারি সেটি হল আমরা তুলনা করতে পারি এবং তুলনার মাধ্যমে আমরা ধারনা পাবার চেষ্টা করতে পারি। যেমন আমরা সবাই নিশ্চিত করে বলতে পারি যে একজন শামসুর রহমান ও একজন বাবর মন্ত্রীর মধ্যে নি:সন্দেহে শামসুর রহমানের অনর্্তজগত বাবরের চাইতে সম্মৃদ্ধতর, আলোকিত, বিকশিত এবং সর্বপোরি উন্নত। হয়ত কেউ কেউ বলতে চাইবেন এই দুইয়ের মধ্যে তুলনাই করা উচিৎ নয় কেননা প্রথম জনের তুলনায় দ্বিতীয় জন এমনকি পাশাপাশি দাঁড়ানোর যোগ্যতা রাখেন না। আমি প্রসঙ্গটি এজন্যই এনেছি যাতে আমরা
অনর্্তজগত ও বাস্তব জগতে সাফল্যের বিষয়টিকে বুঝতে পারি। বাস্তব জগতে একজন বাবর একজন শামসুর রহমানের চাইতে অনেকগুনে শক্তিশালী। তার রয়েছে বহুবিধ মতা অর্থ, পদ মর্যাদা, যোগাযোগ, পেশীশক্তি এবং আরো অসংখ্য।
আবারো পূর্বের প্রসঙ্গে ফিরি, যদি উপস্থিতির কথা চিন্তা করি তাহলে আমরা দেখব যে মানুষের অনর্্তজগত ও বাস্তব জগত একই সাথে ক্রিয়াশীল, আবার যদি প্রয়োজনীয়তার কথা বুঝতে চাই তাহলে দেখব যে ভবিষ্যৎমুখী হবার জন্য, নতুন ও সৃষ্টিশীল কিছু করার জন্য আমাদের অনর্্তজগতের চর্চা করা আবশ্যক। কিন্তু ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে অনর্্তজগতের চর্চা করেছেন এমন মানুষের সংখ্যা সকল কালেই খুব বেশি নয়। বিপুল জনসংখ্যার তুলনায় তা সামান্য। কিন্তু এমন মানুষেরাই বদলে দিয়েছেন পৃথিবীর চেহারা এবং বারবার নতুন ধারনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।
অনেকে এই অনর্্তজগত ও বাস্তবজগতের মধ্যে একটি স্পষ্ট বিভেদ রেখা টানতে চান, যা আমার কাছে সমস্যাজনক মনে হয়। কেননা এদুটো যেমন পরস্পর সম্পর্কিত তেমনি বৈশিষ্ট্যগত অর্থে পরস্পর বিযুক্তও বটে। ফলে কোন একটি সংঙ্গায়নে স্পষ্ট করা সম্ভব নয় দুই জগতের মধ্যকার বৈপরীত্য ও মিলগুলিকে। একটু মনোযোগ দিলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে প্রথাগত সংঙ্গায়নের সীমাবদ্ধতা এবং আমরা বুঝতে পারি যে পুরো বিষয়টিকে অনুধাবন করতে হলে আমাদের প্রথমে সেটি উপলব্ধি করতে হবে। মজার বিষয় হল অনর্্তজগত কি এ প্রশ্নের উত্তরে কোন প্রথাগত সংঙ্গা পর্যাপ্ত নয় এর জন্য একই সাথে প্রয়োজন একটি সম্মৃদ্ধ অনর্্তজগত।
আমাদের অনর্্তজগতের বৈধব্য দীর্ঘকালের, বেঁচে থাকার মত চিন্তাশীল হওয়াও যে একটি আবশ্যিক বিষয় তা আমাদের অধিকাংশের ধারণায় থাকে না। এর একটি প্রধান কারণ হল শিা ব্যাবস্থা ও অনর্্তজগতের চর্চার অনাভ্যাস। এই দুটোই অবশ্য কোন সমাজের মূল প্রবণতাকে চিহি্নত করে। পাঠাভ্যাসের সাথে সাথে চিন্তাশীলতার অনভ্যাস বহু জাতিকে দীর্ঘকাল একটি নতুনত্বহীন বদ্ধ সময়ের মধ্যে আটকে ফেলে। আবার মানুষ নিজের প্রয়োজনেই এই স্থবিরতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং চিন্তাশীলতা ও সৃষ্টিশীলতার ধারাকে পুর্নবার সচল করতে সচেষ্ট হয়। কিন্তু অনর্্তজগত একবার দরিদ্র হয়ে পড়লে সেটিকে আবার সম্মৃদ্ধ করে তোলা খুবই কষ্টকর ব্যাপার। এরজন্য কখনো কখনো মানুষের রক্তেরও প্রয়োজন পড়ে এবং সেটিতেও কাজ হয় না।
অনর্্তজগতের চর্চাকে অনেকে বেশ সহজ কাজ বলেও মনে করেন; কিন্তু দীর্ঘকাল স্থুল
বাস্তবতাগ্রস্থ ব্যক্তির জন্য এটি প্রায় কাঁধ দিয়ে পাহাড় ঠেলার মত। যেটির সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হল বিভিন্ন শক্তিমানের মধ্যে চাগিয়ে ওঠা কবি খ্যাতির লালসা। এদের উৎপাদনগুলো এমনকি অনর্্তলোকের ভাগারে থাকারও যোগ্য নয়। ইতিহাসের একটি বিদ্রুপ হল সাধারণত সমাজের তৃতীয় শ্রেণীর মানুষ সবচেয়ে বেশি মতাধর হন এবং প্রথম শ্রেণীর মানুষকে তাদের নির্দেশে চলতে হয়।
অনর্্তজগতের বৈধব্য কাটানোর জন্য সবসময় রামমোহন, বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহে উৎসাহ দিয়ে যাবেন এমন নয়। আমাদের নিজেদেরই এগিয়ে যেতে হবে নিজেদের অনর্্তজগতকে সম্মৃদ্ধ করার প্রচেষ্টা নিয়ে। বৃহত্তর অর্থে বাস্তব জগত ও অনর্্তজগত পরস্পরের রূপকার ও সৃষ্টি তাই উভয়ের সম্মৃদ্ধি ও পুষ্টির জন্য অনর্্তজগতের বিকাশ ঘটানো আবশ্যক।
তবে বরাবরের মত এেেত্রও আমরা যদি দীর্ঘকালের অতৃপ্ত বৈধব্যের তাড়ণায় জীবাণু সম্মৃদ্ধ সঙ্গমে মেতে থাকি তাহলে প্রত্যাশিত ঘটনাটি সম্ভবত ঘটবে না। তবে কুঁড়ে ঘরের দুয়ারে বসে বিষণ্ন কান্নার বদলে বরং যাত্রার নর্তকী হওয়া উত্তম।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



