আগের পর্বের জন্যঃ Click This Link
প্রথম পর্বের জন্যঃ Click This Link
বিজনেস প্রমোশনাল গিফটস ও স্থানীয় পর্যায়ে ব্যাবসায় উত্থান ও ধ্বসঃ
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে জনাব লোকমান নামে এক চামড়াজাত পন্য উৎপাদনকারী- কর্পোরেট ও মাঝারি/ছোট ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাবসা বা পন্যের প্রচারনার জন্য ক্রেতা বা স্টেকহোল্ডারদের উদ্বুদ্ধ করার নিমিত্তে যে উপহার সামগ্রী দিয়ে থাকে,তাদের সরবরাহের জন্য চামড়াজাত পন্য উৎপাদন শুরু করেন।
বিজনেস প্রমোশনাল গিফটস সাপ্লাইয়ের কিছু পূর্ব শর্ত থাকে;
প্রথমত নিজের কোম্পানীর নাম প্রচার করা যাবে না। পন্যের দাম ও ডিজাইনের গোপনীয়তা রক্ষা করা জরুরী।
যেই সকল কোম্পানী প্রোডাক্ট নিচ্ছে তার কোম্পানী নাম বা ব্রান্ডিং স্পষ্ট ও সুন্দর হওয়া জরুরি। আর প্রোডাক্টের প্যকেজিং ও হতে হয় দৃষ্টি নন্দন। যেহেতু ক্রেতা বাল্ক পণ্য নেন সেহেতু মুল্য হতে হবে সাশ্রয়ী-সেই সাথে সব পণ্যের গুনগত মানও একইরকম হতে হয়।
• আপনাদের যদি এই নিয়ে কারো জানার বেশি আগ্রহ থাকে বা এই ধরনে ব্যাবসায় জড়িত হওয়ার ইচ্ছা পোষন করেন তাহলে আমি বিস্তারিত পরে লিখব।
জনাব লোকমান উচ্চভিলাষি ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যাবসায়ী ছিলেন বলে আমার ধারনা। তিনি ও তার কোম্পানী ‘এবস্যুলেট লেদার’ বিজনেস প্রমোশনাল গিফটস এর পাইওনিয়ার( চামড়াজাত পণ্য) বলা যায়। কিন্তু তার কথা কোথাও লেখা নেই। এদের কথা ইতিহাসের পাতায় থাকে না।
তার মুলত ব্যাবসাক্ষেত্র ছিল; তৎকালীন মুষ্টিমেয় কিছু কর্পোরেট কোম্পানী, কিছু ঔষধ কোম্পানী ও স্থানীয় কিছু ব্যাক্তিমালিকানাধীন কোম্পানীতে। কিন্তু বাংলাদেশে এই ব্যবসার রমরমা বাজার শুরু হওয়ার আগেই তিনি মৃত্যু বরন করেন!
১৯৯৭ সাল গ্রামীনফোন নামে নরওয়ে ভিত্তিক টেলি কমিউনিকেশন কোম্পানী টেলিনরের হাত ধরে বাংলাদেশের কর্পোরেট যুগে প্রবেশ। (২০১২ সালে ‘গ্রামীন ফোনের সেকাল একাল’ নিয়ে দুটো পর্ব দিয়ে মাঠ ছেড়ে ভেগেছিলাম – কেউ চাইলে পেছনে গিয়ে পড়তে পারেন।)
গ্রামীনফোনের মত এদেশে এত দ্রুত অন্য কোন কোম্পানীর ব্যাবসায়িক উম্ফলন হয়নি- কথা খুব না বেশি ভেবে চিন্তে বলা যায়। গ্রামীনের অনেক দোষত্রুটি হয়তো অনেকে খুজে পাবেন কিন্তু ‘বিজনেস প্রমোশনাল গিফটস এর ব্যবসাটা এদেশে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে জিপি এটা স্বীকার করতেই হবে।
প্রায় সব বাঙ্গালীই মনে মনে প্রতিনিয়ত ব্যাবসার প্লান করে- একদিন ব্যাবসায়ী হবার সপ্ন দেখে কিন্তু ধৈর্য ও সৃষ্টিশীলতার খুব অভাব! আমাদের আরেকটা বড় সমস্যা হল 'দুরদর্শীতা'র অভাব। সেই সাথে অতি দ্রুত সহজ পথে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা আর সমষ্টিগত চিন্তা না করা,বড় ও ভাল ব্যাবসায়ী হওয়ার মুল প্রতিবন্ধক!
গ্রামীনের সেই রমরমা সময়ে কিছু ব্যবসায়ী অ-ব্যাবসায়ী বুঝে না বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়ল সেখানে। দিনের পর দিন দৌরাত্ব বাড়তে থাকল দালাল শ্রেণীর ব্যাবসায়ীদের- তাদের প্রভাবে স্মার্টনেস আর এডিকেটে মুল ধারার ব্যবসায়ীরা হালে পানি পায় না। এখানে শুধু চামড়া নয় দেশীয় সব ধরনের পণ্য সামগ্রী উৎপাদনের প্রতিষ্ঠানগুলো যুক্ত ছিল- এই ব্যবসায়।
ছোট ছোট চামড়া শিল্প ও অন্যান্য কুটির শিল্পের মুল সমস্যা ছিল এর উদ্যোক্তাদের শিক্ষার অভাব। এরা কর্পোরেটে গিয়ে সরাসরি পণ্য বিক্রি করতে পারছিল না। এখানে শুধু পণ্য উৎপাদনই তো নয়, এখানে ব্রান্ডিং, প্যাকেজিং, কনসেপ্ট, আইডিয়া অনেক কিছু জড়িত- তাছাড়া পুঁজি লগ্নির বিষয়টা তো আছেই। খুব কম কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান অগ্রীম টাকা দেয় মাল ডেলিভারি করলেই টাকা দেয়( এই টাকা পেতে ন্যুনতম ১৫ দিন থেকে ৩/৪ মাস লাগে) এতগুলো বিষয় নিয়ে সুক্ষভাবে কাজ করা উতপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য ভীষন অসুবিধার ছিল তাই তারা সমর্পিত হয় সেসব মধ্যস্বত্তভোগী,ভেন্ডর, সাপ্লাইয়ার বা দালালদের কাছে।
(বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশী বিজনেস প্রমোশনাল গিফটস ক্রয় করে ঔষধ কোম্পানিগুলো। এই গিফটসের একটা বড় অংশ চামড়াজাত পণ্য। )
গ্রামীনফোন থেকে অন্যান্য কর্পোরেটের বুদ্ধিমান বাঙ্গালী পারচেজ ও মার্কেটিং বসেরা দিন দিন কাকের মত বাড়তে থাকা ভেন্ডরদের দেখে খুশিতে মেনে মনে আকর্ণ হাসতে থাকেন।
শুরু হল দাম নিয়ে মুলোমুলি- কোয়ালিটি নিয়ে প্যাচাপ্যাচি আর সরবরাহের সময় কমিয়ে আনার জন্য চাপাচাপি।
সাপ্লাইয়াররা ঘোরেন হন্য হয়ে এর দুয়ার থেকে অন্য ম্যানুফ্যাকচারের দুয়ারে।মুল কোম্পানি যদি ঘুষি দেয় এরা দেয় গদা। মুল্য কমানোর জন্য বিভিন্ন ফন্দি ফিকির করে, কখনো নগদ টাকার লোভ- কখনো ব্যাপক কাজ দেবার সপ্ন।তারপরে খারাপ কাঁচামাল ব্যাবহারের জন্য প্ররোচনা। ওদিকে যে উৎপাদক গোষ্ঠী খুব ঈমানদার তাতো নয়- দু’টাকা লাভের আশায় হেন নীচ পন্থা নেই যা অবলম্বন করেনি।
সাপ্লাইয়ারদের কেউবা কারো কারো প্ররোচনায় না বুঝে নিজেরাই ফ্যাক্টরি খুলে বসল।
আর এক গ্রুপ এখানে সুবিধা করতে না পেরে অন্য দেশ থেকে মাল এনে সাপ্লাই দিতে উঠে পড়ে লাগল। এদের মুল লক্ষ্য চাইনিজ প্রোডাক্ট! আগে থেকেই এমন ধারার ব্যাবসায়ী গোষ্ঠী ছিল কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে সেটা হোল ম্যাসিভ।
কোণঠাসা হতে লাগল স্থানীয় উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো। পাশাপাশি ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠতে নতুন নতু ক্ষুদ্র কারখানা। অশিক্ষিত সাধারন কারিগরেরা স্তানীয় বাজার থেকে দুটো সেলাই মেশিন, আর কিছু কারিগরি সামানা কিনেই নতুন একটা নামমাত্র ফ্যাক্টরি দিয়েই ছূটতে শুরু করে সেইসব দালালদের পেছনে। সবাই সবাইওকে টেনে ধরে নামাতে চায় কেঊ উঠতে পারে। কেউ কেউ অতি উদ্যোগী হয়ে একটা সঙ্গঠন করার জন্য কিছু নীতিমালা নিয়ে এগিয়ে আসে কিন্তু এই বাঙ্গালীকে রোখে কার সাধ্যি। ছোট এক ছিদ্র পেলে সবাই একসাথে মাথা গলিয়ে দিতে চায়। ব্যাবসা করতে হবে টাকা কামাই করতে হবে। আমি চিনি আমারে আর কারো চিনিনা।
এই করে সব তাল্গোল পাকিয়ে এখন লাড্ডু।
ঔষধ কোম্পানিগুলো( মুলত দেশী- বিদেশী কিছু কোম্পানী দেশীয় কোম্পানীর উলম্ফনে টিকতে না পেরে পাততাড়ি গুটিয়েছে, আর কিছু কোম্পানী কোন গিফট নীতিগতভাবে অনুমোদন করে না। তারপরে কিছু বিদেশী কোমানী করে।) তাদের বার্ষিক বিক্রির ৫-১০ ভাগ নাকি বিভিন্ন গিফট,নগদ অর্থদান, বিদেশে প্লেজার ট্যুর সহ প্রমোশনাল গিফটসের মোড়কে ডাক্তারদের ঘূষ দিয়ে থাকেন। অবশ্য এর একটা অংশ প্যড কলম, মগ, চাবির রিং সহ ভিন্ন ভিন্ন পণ্য গিফটয়ের মোড়কে বিভিন্ন ফার্মাসী ও স্বশিক্ষিত ডাক্তার কম্পাউন্ডারদের কাছেও যায়। অবশ্য এর মাঝে কিছু দেশি ঔষূধ কোম্পানী অন্য দেশেও তাদের শাখা বিস্তার করায় এখান থেকে প্রোডাক্ট তৈরিয়ে বাইরের ডাক্তারদের কাছেও যাচ্ছে। নিজেদের স্বার্থে ই হোক আর যে ভাবেই হোক না কেন। এরা কিছুটা হলেও দেশীয় কোম্পানীকে প্রোমট করছে। যদিও এদের সাপ্লাইকৃত পণ্যের বড় একটা অংশ আসে চায়না ও ভারত থেকে। তবুও দেশের কয়েক শত ফ্যাক্টরি ও সাপ্লাইয়ার টিকে আছে এদের দয়ায়।
(বাংলাদেশে প্রমোশনাল গিফটস-এর বাজার বেশ বড়-ই। মোবাইল ও ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার, বিভিন্ন ব্যাঙ্ক, বীমা, সিমেন্ট, টাইলস কোম্পানী, ব্রোকারেজ হাউস, গার্মেন্টস, সরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান, সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যা ব থেকে শুরু করে বেসরকারি খাতের প্রায় সব বড় ও মাঝারি কোম্পানীগুলো সারা বছরই কিছু না কিছু উপহার সামগ্রী কিনে থাকেন।)
ধরে নেই টোটাল প্রমোশনাল গিফটস এর বাজার ২০০০ কোটি টাকার। এর মধ্যে ১০ ভাগ ও যদি চামড়াজাত পণ্য হয় তাহলে হবে ২০০ কোটি! যেখানে এখানে ২০০ ফ্যাক্টরি থাকলে তারা খেয়ে পড়ে বাচতে পারে সেখানে অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারী ফ্যাক্টরি মিলে মোত ফ্যাক্টরির সংখ্যা এখন প্রায় পাঁচ শতাধিকের উপরে। এরপরে আছে ভারতীয় চামড়াজাত ও চায়নিজ অ-চামড়াজাত পণ্যের আগ্রাসন!
এদের কামড়া কামড়িতে পণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়লেও মুল্য কমছে তার থেকে দ্রুত গতিতে। ১৯৯৮ সালে যেখানে একটা চামড়ার মানিব্যাগ সাপ্লাই হত ৪০০-৫০০ টাকায় সেটার মুল্য এখন নেমে এসেছে ২০০ টাকা বার তার থেকেও কম! ম্যানুফ্যাকচারার ও সাপ্লাইয়াররা এখন উন্মুক্ত কচ্ছে উর্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছে এই কর্পোরেট হাউস থেকে অন্যটায়। যেন তেন উপায়ে তাদের কাজ চাই।
চামড়া চাই এখন পানির দামে কিংবা তার থেকেও সস্তায়। ছোট ছোট ট্যানারির মালিকেরা তাদের অস্তিত্ব টিকেয়ে রাখার স্বার্থে পারলে নিজেদের গায়ের চামড়া খুলে ট্যান করে দেয়।
আজ আমরা পরাজিত নিজেদের স্বার্থের কাছে, নিজেদের লোভের কাছে। শিক্ষা,কুশিক্ষা,অশিক্ষা, ধর্মান্ধতা, অপ রাজনীতি, রাতারাতি ধনী হবার বাসনা, কুট চিন্তা,শুধু আমিত্ব, আমাদের মানুষ আর থাকতে দিল কই?
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ১০:৩১