ববির ভাষায় সে চেষ্টার কমতি রাখেনি- বিশেষ করে ওর শিশু মেয়েটার দিকে তাকিয়ে সর্বোচ্চ ছাড় দেবার প্রতিজ্ঞা করেছিল। এমনকি রাশিয়ায় এত সমস্যা যেহেতু তাই সবকিছু ছেড়েছুড়ে স্থায়ীভাবে দেশে এসে বসবাসের অনুরোধ করেছিল। কিন্তু এলিনা তখন অন্যগ্রহের মানুষ পৃথিবীর কোন কিছুতেই তার আগ্রহ নেই তখন। বাইশ তেইশ বছরের একটা মেয়ে তখন মানুষের সব জটিলতা পঙ্কিলতা দেখে ফেলেছে-এই বয়সে তার বার্ধক্য এসে গেছে যেন!
সে কোন বাদ প্রতিবাদ তর্কে যায় না। একবার বলে দিয়েছে ববির সাথে আর থাকা সম্ভব নয়-শেষ! ববি উপায়ান্তর না দেখে ওর বান্ধবীকে গিয়ে ধরল, ওর বোন নাদিয়া আর তার মাকে ওডেসা থেকে ডেকে নিয়ে আসল।সবাই মিলে যতই বোঝায় এলিনা তার সিদ্ধান্তে অনড়।ওর বান্ধবীও অবশ্য ওর পক্ষে-সে তার সব কুকীর্তি সন্মন্ধে সম্যক অবগত।
অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে ভাঙ্গনের পথেই হাটতে হোল তার। কিন্তু গোল বাঁধল মেয়েকে নিয়ে। মেয়ে থাকবে কার কাছে?
আইনত ওই বয়েসী মেয়ে মায়ের কাছেই থাকার কথা। কোনভাবেই ববি মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে রাখতে পারবে না। কিন্তু আবেগ উচ্ছ্বাস প্রেম মমতাহীন একজন রমণীর সাহচর্যে কিভাবে সে বেড়ে উঠবে? এর উপরে তার কোন আয় রোজগার নেই, মাথার উপর ছাদ নেই। এমন চালচুলো-বিহীন একজন ভ্যাগাবন্ড মায়ের কাছে মেয়েকে সে কোনভাবেই রাখতে পারে না।
অবশেষে তার পরিবার বন্ধুদের সাথে অনেক দেন-দরবার করে সিদ্ধান্ত হোল মেয়েকে ববি বাংলাদেশে নিয়ে এসে তার পরিবারের হাতে তুলে দেবে মানুষ করার জন্য। আর এর বিনিময়ে এলিনাকে একটা স্থায়ী সম্পত্তি কিংবা মাথা গোঁজার ঠাই দিবে সে। যদিও সেই সময়ে মস্কোতে একটা ফ্লাট বড়ই মহার্ঘ্য, তবুও ওর পরিবারের চাপেই হোক সন্তানের মায়ের প্রতি মায়া-বোধেই হোক তার ফ্লাটটা এলিনার নামে লিখে দেবার সিদ্ধান্ত নিল। চাইলে সে এই ফ্লাট ভাড়া দিয়ে চলতে পারবে।
এলিনা ববির কোন কোন কিছু নিতেই রাজী ছিলনা। তা সেটা মেয়ের বিনিময়ে তো নয়ই। অনেক আলোচনার পরে, শেষমেষ কিভাবে রাজী হোল সেটা এক রহস্য!
অবশেষে এলিনা-ববির দাম্পত্য জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটল শুরুর চার বছরের মাথায়।
অলিখিত চুক্তি অনুযায়ী ইনফ্যান্ট মেয়েকে বাংলাদেশে আনতে হলে মায়ের সাহায্য প্রয়োজন। ববি একাকী তাকে কখনোই আনতে পারবে না। বিশেষ এই প্যাচটা সে আগে থেকেই জানত। পরে কোন গোল বাঁধে সেই শঙ্কায় সে ফ্লাটটা সে আগে থেকে লিখে দেয়নি। এলিনার পরিবারের সাথে মৌখিক চুক্তি করেছে, মেয়েকে বাংলাদেশে দিয়ে আসার পরে সে ফ্লাট লিখে দিবে।
সমস্যা শুধু বাচ্চাকে দেশে নিয়ে আসা নয়-সমস্যা একাকী ফিরে যাওয়াও। ফেরার পথে কি হবে সেটা এলিনাই বুঝুক। ববি আর সে নিয়ে ভাবতে চায় না। তার মুখ্য উদ্দেশ্য সিদ্ধ হলেই হয়।
এলিনা আবেগহীন পাথরের মত মুখ করে থাকে সারাক্ষণ! মৌখিকভাবে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে গেলেও দাপ্তরিক-ভাবে হয়নি। মেয়েকে দেশে না রেখে এসে সেটা সম্ভব ও নয়। ওর ভিতরে কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে তা বাইরে থেকে ঠাহর করা শুধু মুশকিল নয় অসম্ভব! মা বোনের শত প্রশ্ন শত অনুরোধ তাকে সামান্য টলাতে পারছে না। মুখে স্থায়ীভাবে কুলুপ এঁটেছে সে। মেয়ের নিত্য ব্যবহার্য পোশাক খেলনা থেকে শুরু করে দুধের কৌটা ন্যাপকিন নিপুণ হাতে গোছাচ্ছে সে। ওর মা বোন চাইলেও তাকে সাহায্য করতে পারছে না। নাদিয়ার একমাত্র ভাগ্নি আর ওর মায়ের প্রথম নাতি-সবার কত আদরের ধন। চিরতরে হয়তো এদেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে-রক্তের এই বন্ধন আলগা হতে হতে একদিন হয়তো খসে যাবে। পৃথিবীতে ওর এমন কিছু প্রিয়জন ছিল সে হয়তো জানবে না কোনদিন।
মেয়ের পাসপোর্ট করে বাংলাদেশের ভিসা প্রসেসিং করা বেশ ঝক্কির ছিল! ববি আগে থেকেই ভেবে রেখেছে দেশে এসেই রাশিয়ান পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলবে। রেমেনার( মেয়ের নাম) পেছনের স্মৃতি সব মুছে ফেলে ওকে চিরতরে বাঙ্গালী বানিয়ে ফেলবে। এলিনা ও ওর মা-বোন এসব কিছু বোঝেনি। এভাবে পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলে কারো আইডেন্টিটি পুরো মুছে ফেলা যায় এটা ওদের মাথাতেই আসেনি।
মেয়েকে নিয়ে আসার আগে শেষ-বেলায় এলিনা একবার মুখ খুলল। একটা মাত্র আবদার বা দাবি তার;
মেয়ের আঠারো বছর হলে তাকে তার অতীতের সব বলতে হবে। যদি ততদিন সে বেঁচে থাকে তাহলে মেয়ের সম্মতির পরিপ্রেক্ষিতে তার মায়ের সাথে কথা বলতে দিতে হবে। সে যদি চায় তবে মায়ের কাছে এসে থাকতে দিতে হবে।
ববি পড়ল তখন মহা ফাঁপরে! ঘাড় ত্যাড়া করে থাকা এলিনার সব শর্ত মানা ছাড়া তার উপায় নেই। এলিনা ববিকে রত্তি-মাত্র বিশ্বাস করেনা। সে একটা ডাইরিতে পুরো বিষয়টা টুকে রেখে ওর সই সাবুদ নিয়ে রাখল। ববি মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছে ভীষণ গোপনীয়তার সাথে। বাঙ্গালী কেউ ঘুণাক্ষরেও জানেনি।এয়ারপোর্টে শুধু এলিনার সেই বান্ধবী, মা আর বোন এসেছিল।
সেই বান্ধবীও এলিনার মত আবেগহীন- তবুও মেয়েটার জন্য শেষ মুহূর্তে তার দরদ উথলে উঠল। নিজের আবেগকে সংবরণ করা কষ্টকর হোল। শেষ মুহূর্তে রেমেনাকে এলিনার মা বোন দু'জনেই খানিকটা কাড়াকাড়ি করে কোলে নিয়ে ভীষণ আবেগে চুমু খেতে লাগল। দুজনের চোখের জলে বুক ভিজে গেছে। ওদিকে এলিনা নির্বিকার- তেমনি পাথুরে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটাকে শেষবার এলিনার কোলে দিয়ে নাদিয়া আর ওর মা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল। একটা সংসারে চারজন মাত্র নারী। পুরুষহীন এই পৃথিবীতে তারা আরো বেশী নিঃসঙ্গ হয়ে গেল।
ববি এলিনার পাশে বসে শেষবারের মত ভ্রমণ করল। মোট তের ঘণ্টার জার্নিতে এলিনা একটা মাত্র শব্দও করেনি। বিমানের খাবার পেট বক্স সেভাবেই পড়ে আছে- ছুঁয়েও দেখেনি। এক চুমুক জুস-তো দুরের কথা এক ফোঁটা পানিও পান করেনি।
আগের পর্বের জন্যঃ Click This Link
পরের পর্বের জন্যঃ Click This Link
প্রথম খন্ড প্রথম পর্বের জন্যঃ Click This Link