ছোট বেলায় আমাদের ইংরেজীতে ট্রান্সেলেশান করতে হত “ডাক্তার আসিবার পূর্বেই রোগীটি মরিয়া গেল” এবং এটা কোন টেন্স? খুবই কমন একটা বাক্য ছিল আমাদের জেনারেশানের স্কুল পাঠ্যতে। আজকে যে মহামারী সারা বিশ্বে আঘাত হানছে সেখানে এই বাক্যাটিও এক রকম অচল। ডাক্তার না আসিতে চাওয়ায় বিনা চিকিৎসায় রোগী মারা গেল। না আমি ডাক্তারদের কোন দোষ দিচ্ছি না বর্তমান পরিস্থিতিতে, অন্তত আমাদের দেশে পরিপ্রেক্ষিতে। নিজে বাচলে বাপের নাম এই অপ্ত বাক্যটিই এখন আমাদের বাঁচার এখন এক মাত্র উপায়।
করোনা হঠাৎ করে আসেনি, গত তিন মাস যাবত ধীরে সুস্থে সারা বিশ্ব পরিভ্রমন করে করোনা আমাদের আতিথ্য গ্রহন করছে। এখন অতিথি যে এই দেশে আসবে সেটা আমাদের দায়িত্বশীলরা উপলদ্ধিই করতে পারেনি, আর পারেনি বলেই অতিথি আপ্যায়নের যথাযথ ব্যাবস্থা নেয়া হয়নি, যার কারনে আমরা এখনো জানি না আমাদের এই মহা ক্ষমতাধর অতিথি তার যথাযথ আগমন উপলক্ষ্যে অনেক আগে থেকে এদেশের দায়িত্বশীলদের তার আগমনের বার্তা পাঠানোর পরও যেহেতু কোন পাত্তা দেয়নি সেহেতু সে যে কতখানি ক্রোধান্বিত হয়েছে তার নিদর্শন সামনে বোঝা যাবে।
যতটুকু বুজলাম এই অতিথি অনেকটা দুর্বাশা মুনির মত অত্যান্ত রগচটা টাইপের। তার প্রতিশোধের স্পৃহা অত্যান্ত মারাত্মক। যাই হোক দায়িত্বশীলদের অবহেলায়, ভোগান্তি এবং মৃত্যুর মুখোমুখি আমরা সাধারনজনরা। অবশ্য আমাদের মত সাধারনের প্রানের মূল্য নিতান্তই সামান্য সে এই মহামান্য অতিথি এবং আমাদের দায়িত্বশীলদের কাছে।
আজকে প্রান ধারনের জন্য কর্ম উপলক্ষ্যে প্রায় সারাদিন বাইরে থাকতে হয়েছে, সুযোগ হয়েছে ঢাকার বুকে প্রান হাতে করে চলা সাধারন মানুষের প্রান হারানোর আত্ংকে শুকনো মুখ দেখার। বাসা থেকে বের হবার আগে বাসার কর্ত্রী এবং মায়ের কড়া নির্দেশ অনুযায়ী আমাকেও নতুন জামাই যেমন মুখে রুমাল দিয়ে চলাফেরা করে আমাকে রুমাল না হলেও মাস্ক নামক এক বিদঘুটে জিনিস মুখে দিয়ে বের হতে হয়েছে, বের হয়ে মুখোমুখি হতে হয়েছে আমার মফস্বলের এক ফিচেল দোস্তের, তার প্রথম ডায়লগই ছিল “কিরে গরুর নাহান মুখে ঠুলি দিয়ে বাইর হইছস?” গ্রাম গঞ্জে যারা বড় হয়েছেন তারা জানেন আগেকার দিনে ধান মাড়াইয়ের জন্য গরুর মুখে ঠুলি (এক ধরনের মুখ বন্ধ যা গরুর মুখে দেয়া হত যাতে সে ধান খেতে না পারে) পড়িয়ে ধান বিছিয়ে তার ওপর চক্রাকারে ঘুরানো হত আর ধান গাছ থেকে ধান আলাদা হত। যাই হোক আমিও ঠুলি পড়ে মোটামুটি সারাদিন বাইরে কাজ করছি।
এক পর্যায়ে একজন ফোন দিল, “ভাই পারলে কিছু ম্যালেরিয়ার ওষুধ কিনে রাখেন?” আমি বললাম “কেন?” সে জবাব দিল "আরে ভাই করোনা হইলে ম্যালেরিয়ার ওষুধে ভাল হয়ে যায়, গুলশান বনানীতে এক পাতা কুইনাইন জাতীয় ওষুধের এক এক ষ্ট্রিপ নাকি ২২০০/২৩০০ টাকায় বিক্রয় হচ্ছে” ফোনের ওপাশ থেকে উত্তেজিত কন্ঠ। আমি কিছুটা হতভম্ভ হয়ে জিজ্ঞেস করলাম “কুইনাইন যদি করোনার প্রতিষেধক হয় তবে ইউরোপ আমেরিকার বলদা ডাক্তাররা কি করছে, তারা কি এই গোপন ওষুধের খোজ পায়নি?” দেখুন যারা ২২০০/২৩০০ টাকা দিয়ে এক পাতা কুইনাইন কিনছে তারা কিন্তু গ্রামেগঞ্জের অশিক্ষিত না, যারা থান কুনি পাতা খেয়ে থান কুনি পাতার প্রজাতিই প্রায় শেষ করে দিয়েছে, এবং আপনাদের মত শিক্ষিত মানুষদের ট্রলের শিকার। যারা ২২০০/২৩০০ টাকা দিয়ে কুইনাইনের এক ষ্ট্রিপ কিনছে এরা আপনার আমার থেকেও অতি শিক্ষিত অতি সচেতন!
রাস্তায় দেখলাম পুলিশ সদস্যরা মুলতঃ যারা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রন করে অতি সাদাসিধা ভাবে ডিউটি দিচ্ছে অবশ্য কারো কারো মুখে মাস্ক আছে, তবে সেগুলো যে কতটা করোনা আটকায় আমার নিজেরই সন্দেহ আছে, প্রায় কারো হাতেই দেখলাম না গ্লাভস। অথচ আমার ধারন মাস্কের থেকেও অতি জরুরী হ্যান্ড গ্লাভস। অবশ্য আমি মুর্খ টাইপের মানুষ আমার ধারনায় কিছু যায় আসে না।
গত তিন মাসে দেশে সোয়া ছয়লাখ বিদেশী আসছে, তখন তাদের খোজ নাই, গত দেড় দুই সপ্তাহ ধরে তাদের ব্যাপারে টনক নড়ছে এখন অনেক জায়গায় তাদের বাড়ী বাড়ী লাল পতাকা টানিয়ে দেয়া হয়েছে, সবাই এখন এই সব প্রবাসীদের দোষ ধরছেন, অথচ শুরু থেকে যাদের দায়িত্ব ছিল এই সব প্রবাসীদের কোয়ারান্টাইন কনফার্ম করা তারা তখন কোথায় ছিলেন?
মহামান্য শ্রদ্ধেয় করোনা স্যার দেশে আসছে, তিন মাস সময় পেয়েছি তাকে রিসেপশান দেবার অথচ যারা ফ্রন্ট লাইনে তাকে রিসেপশান দেবে এয়ার টাইট পিপিই পড়ে সেই ডাক্তারদেরই নাকি এখন পর্যন্ত এয়ার টাইট পিপিই দেয়া হয় নাই, করোনা স্যার কি তাতে রাগ করবে না? অবশ্যই তার রাগ হবার যথাযথ কারন আছে। এখন সেনাবাহিনী নামছে, এই সেনাবাহিনীর সদস্যদের কি যথাযথ পিপিই আছে? আমি আশা করতে পারি অবশ্যই আছে, কারন তারা সুশৃঙ্খল বাহিনী।
পিপিই কি শুধু ডাক্তারদেরই লাগে? অন্যান্য জরুরী সেবা যারা দিচ্ছে তাদের কি লাগবে না? আপনার অফিসের যে ছেলেটি আপনাকে চা বানিয়ে খাওয়াচ্ছে তার কি লাগবে না? রিকশাওয়ালারা এখন আর দরদামের মাঝে খুব একটা যাচ্ছে না, “দিয়েন স্যার ন্যায্য ভাড়া যা হয়” ভীষন করুন মুখে বলছে। রিকশা সংখ্যা আজকে খুবই কম।
আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে যারা দিন আনে দিন খায় সেই মানুষ গুলা কিভাবে খাচ্ছে? না শুধু কিউরিসিটি না, ওখান থেকে শিক্ষাও নিতে চাই তাদের সারভাইব টেকনিকটা, তেলাপোকা নাকি নিউক্লিয়ার বোমা বিস্ফোরনের তেজস্ক্রিয়তা থেকেও বেচে থাকে। দেখুন দেখি অবস্থাটা নিকেতনে গৃহকর্মী ও চালকদের প্রবেশ নিষেধ। করোনাে যেন এই টাইপের নিম্ন শ্রেনীর মানুষদের ওপর দিয়েই যায়, গুলশান, বনানী, বারিধারা, নিকেতন যেন বেঁচে থাকে!
তিন মাস হয়ে গেল কোথাও গেলে যে শান্তিপূর্ন ভাবে করোনা টেষ্ট করা যায় তার কোন হাদিস নাই। সব থেকে মজা লাগছে, টিভিতে টকশো গুলো। যারা এক সময় সরকারের গুন গানে তৈল মর্দনে পুরা তেলের ফ্যাক্টরি ঢেলে দিত, তারাই আজকে এক একজন মাননীয় মন্ত্রীকে ভব্যতার সীমা অতিক্রম করে প্রশ্নবানে জর্জরিত করছে। আহা! দেখলেও মায়া লাগে বেচারা মন্ত্রী বা জন প্রতিনিধিদের মুখের অসহায় ভাব দেখে, সারা দিন কত কষ্ট করে জন সেবা করছে গত তিনটা মাস কি প্রানান্তকার ভাবে মুখ দিয়ে করোনা স্যার কে ঠেকিয়ে রেখেছে তাদেরই কিনা তাদের এক সময়ের পা চাটা সেবাদাসরা অপ্রীতিকর প্রশ্ন বানে জর্জরিত করছে! ভেরী স্যাড। ভেরী স্যাড।
চীনে যে ডাক্তারটা প্রথম করোনা ভাইরাসের কথা প্রথম তাদের ফেসবুক গ্রুপে বলছিলো, সেই ব্যাটা ডাক্তারকে চীনা সরকার গ্রেফতার করছিলো গুজব ছড়ানোর অপরাধে। পরে অবশ্য তার কাছে কর্তৃপক্ষ মাফ চায় কিন্তু ততদিনে সে ডাক্তারটাও করোনায় আক্রান্ত হয়ে গেছে এবং এক সময় করোনায় মরিয়াই প্রমান করছে সে দেশে করোনা এসেছে, এ যেন অনেকটা “কাদম্বিনী মরিয়াই প্রমান করিয়াছে কাদম্বিনী মরে নাই।” অবশ্য চীন একটা অগতান্ত্রিক অনেকটা স্বৈরাচারী সরকার। ভাগ্যিস আমাদের সে রকম সরকার না আমাদের রাষ্ট্র গনতান্ত্রিক।
টিভিতে কিছু মানুষের টকশোতে দেখলাম যারা আমার জানামতে জীবনে মনে হয় আল্লাহ খোদার নাম নেয় নাই, অবিশ্বাসী। তারাও দেখলাম কি সুন্দর আল্লাহর নাম নিচ্ছে। অবশ্য আমি তো আর তাদের সাথে সব সময় থাকি না আমার অজানায় নিতেও পারে, কিন্তু কিছু দুষ্ট লোক বলে অমুক অবিশ্বাসী তমুক নাস্তিক।
আহ গ্লোবাল ভিলেজ! ইয়া নফসী, ইয়া নফসী। হাশরের মাঠ, কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না, না পারতে, আজকে একজনের সাথে আলাপ হল অভ্যাস মত হাত বাড়াইয়া দিছিলাম, মনে হল সে যেন সাপ দেখছে, আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যেন আমি খুনী টুনী টাইপের, আমি নতুন বউর মত লজ্জায় লাল টাল হয়ে একশেষ। প্যান্টের পশ্চাতদেশে আবার হাত খানা ঘষে পরিস্কার করে হাত বাড়াইয়া দিলাম ভাবলাম এইবার তো হাত মুচছি, নিশ্চয়ই হাত মিলাবে, ওমা পারলে মারে আর কি! কি আর করুম। দিলটাই ভাইঙ্গা দিছে ওই ব্যাটার এই নির্মমতা।
এখনো টিভিতে আমাদের সচেতনতা বাড়ানোর জন্য প্রতি মুহুর্তে মুহুর্তে উপস্থাপিকা বিভিন্ন সাহস আর উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে, আমরাও সেগুলো শুনতে শুনতে মুখস্থ করে ফেলছি, পরীক্ষা প্রার্থনীয়। কিন্তু যাদের দায়িত্ব কিছু করার তাদেরকে কি যথাযথ উপদেশ দেয়া হচ্ছে, অবশ্য আজকে পেপারে দেখলাম বিদেশী রাষ্ট্রদুতদের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে তাদের চিকিৎসা দেবার জন্য সর্বাধুনিক ব্যাবস্থা নেয়া হয়েছে তারা যেন ভয় না পায়, কিন্তু আমাদের চিকিৎসা কি হবে? সাধারন সর্দি জ্বর আর কাশির। করোনা স্যারের কথা বাদই দিলাম।
সারাদিন পর বাইর থেকে ঘরে আসার পর গিন্নীর চোখ রাঙ্গানীতে সুড়সুড় করে বাথরুমে ডুকে এই ঠান্ডার মাঝেও সাবান ঘসে আবার গোসল করতে হল, কি অমানবিক! এদিকে আবহাওয়াও যেন ফাইযলামি শুরু করছে জীবনে যা না তাই হচ্ছে শেষ রাতে এই চৈত্রের ৯/১০ তারিখ কম্বল গায় দিতে হচ্ছে। অথচ এই সময় থাকে কাকফাটা রোদ্দুর।
আচ্ছা প্রান্তিক মানুষ গুলো মানে যারা দিন আনে দিন খায় তাদের কি অবস্থা? কিভাবে বেচে আছে বড় জানতে ইচ্ছে হয়। বড় জানতে ইচ্ছে হয়। বুলি দিয়ে যদি করোনা মারা যেত তবে এত দিনে করোনার চৌদ্দগুষ্ঠি নিপাত হয়ে যেত এই দেশে, যে সব বুলি চলছে, কিন্তু বুলিতে কি আদৌ করোনা আর পেটের ক্ষুধা মারা যায়? কেউ কি জানেন?
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মার্চ, ২০২০ রাত ৩:১৮