
জেনারেল ওয়াকার একটা ফ্রাংকেনস্টাইন
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা ও ক্ষমতার লড়াই যেন এক অনন্ত চক্র। প্রতিবারই কোনো না কোনো ‘নায়ক’ তৈরি হয়—যে শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে নিজস্ব ক্ষমতার দানব। সময়ের পরিক্রমায় ইতিহাস এই দানবদের চিহ্নিত করেছে নানা নামে—কেউ হয়েছে জিয়া, কেউ এরশাদ, কেউ হয়েছে ছায়ার মতো স্বৈরাচার। আর আজ, সেই ধারাবাহিকতায় যে নামটি ঘুরে বেড়াচ্ছে রাজধানীর ক্ষমতার করিডরে, তিনি জেনারেল ওয়াকার।
শুরুতে ওয়াকারকে দেখা গিয়েছিল একজন কার্যকর সেনা কর্মকর্তা হিসেবে—সংগঠিত, দৃঢ়, কিন্তু অতিমাত্রায় উচ্চাকাঙ্ক্ষী। কিন্তু সময়ের সঙ্গে এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা পরিণত হয়েছে এক ভয়ংকর মোহে—ক্ষমতার মোহে। জাতিসংঘের মিশন বন্ধের হুমকিকে কেন্দ্র করে শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্রে তার ভূমিকা নিয়ে এখন নানা গুঞ্জন। তবে, শুধু জাতিসংঘ মিশনই নয়—ওয়াকারের উদ্দেশ্য ছিল অনেক গভীর ও সুদূরপ্রসারী।
যারা ১৯৭৫ সালের পটভূমি মনে রেখেছেন, তারা জানেন—যেভাবে জিয়া বা এরশাদ নিজেদের ‘রক্ষাকর্তা’ রূপে হাজির করেছিলেন, ওয়াকারও সেই পুরনো স্ক্রিপ্টের নতুন সংস্করণ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। ইতিহাস যেন নিজের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চেয়েছিল—কিন্তু এবার শেখ হাসিনা বেঁচে যান। সেই এক মুহূর্তের ঘটনাই পুরো খেলাটা উল্টে দেয়।
বিশ্বাসযোগ্য সূত্র বলছে, শেখ হাসিনার দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে ওয়াকার কিছুই জানতেন না। ৫ আগস্টের সকালে শেখ হাসিনা জীবিত অবস্থায় নিরাপদে ভারতে পৌঁছে যাওয়ায় ওয়াকারের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। ক্যান্টনমেন্টে বসে জুস খাওয়া ওয়াকার ও তার রাজনৈতিক সহযোগীরা তখনও ভাবতে পারেননি—তাদের ১৮ থেকে ২৩ বছরের প্রস্তুত ষড়যন্ত্র মুহূর্তেই ধুলিস্যাৎ হয়ে যাবে।
যদি কেউ ভাবেন, ওয়াকার শুধুমাত্র কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠীর পুতুল—তাহলে সেটি হবে বিশাল ভুল। বরং তিনি নিজের তৈরি ফ্রেমে নিজেই নায়ক হতে চেয়েছেন। শেখ হাসিনা যদি নিহত হতেন, তাহলে রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগ নিয়ে ওয়াকার নিজেকে “জাতির রক্ষক” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার রূপরেখা আঁকছিলেন। ইতিহাসে জিয়া যেভাবে ‘সামরিক রক্ষক’ হয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করেছিলেন, ওয়াকারের চিন্তায়ও সেই ছায়া ছিল।
কিন্তু ইতিহাস কখনও সরলরেখায় চলে না। শেখ হাসিনা বেঁচে যাওয়ার মধ্য দিয়ে তার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়, আর সেই ব্যর্থতাই এখন তার ভয়ঙ্করতম শত্রু। বলা হয়, যে দানব সে তৈরি করেছিল—জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ ও রাজনৈতিক চক্রান্তের ফ্রেমওয়ার্ক—এখন সেই দানবই তাকে গিলে খাওয়ার অপেক্ষায়।
গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উপর গণহত্যায় ওয়াকার বাহিনীর সম্পৃক্ততা নিয়ে নানা রিপোর্ট ঘুরছে। ভাঙ্গা ও ৩২ নম্বর এলাকাতেও তার বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহায়তার অভিযোগ রয়েছে। ওয়াকার মনে করেছিল, আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে ফেললে জামায়াতসহ নানা আন্তর্জাতিক শক্তি খুশি হবে, আর সেই খুশির বিনিময়ে সে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে পারবে।
তারপরও, বাংলাদেশ সেই পুরনো দেশ নয় যেখানে এক জিয়া বা এক এরশাদ রাতারাতি ক্ষমতার সিংহাসনে বসে যেতে পারে। এখানে প্রতিদিন রাজনৈতিক ঋতু বদলায়, মিত্ররা শত্রু হয়, আর যারা মনে করে তারা অজেয়—তারা ইতিহাসের পাদটীকা হয়ে যায়।
ওয়াকারের বর্তমান অবস্থা অনেকটা ফ্রাংকেনস্টাইন উপন্যাসের দানবের মতো। মেরি শেলির ক্লাসিক সেই কাহিনীতে বিজ্ঞানী ভিক্টর ফ্রাংকেনস্টাইন নিজের হাতে এক দানব তৈরি করেছিলেন, যে পরবর্তীতে নিজের স্রষ্টাকেই ধ্বংস করে দেয়। ওয়াকারের গল্পও অনেকটা তেমন—সে যে জঙ্গি ও ষড়যন্ত্রের ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করেছে, সেটিই এখন তার অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত এক সপ্তাহ ধরে ওয়াকার নাকি ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়নি। বিশেষ নিরাপত্তায়, প্যারা কমান্ডো দ্বারা পরিবেষ্টিত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। কোনো অফিসিয়াল মিটিং বা কার্যক্রমেও অংশ নিচ্ছেন না। সামরিক বৃত্তে এটি অস্বাভাবিক ঘটনা। সূত্রগুলো বলছে—ভয় এখন তার নিজের জন্যই।
যেভাবে এক সময় জিয়া বা এরশাদ নিজেদের তৈরি রাজনৈতিক কাঠামোর বন্দি হয়ে গিয়েছিলেন, ওয়াকারের পরিণতিও এখন সেই দিকেই গড়াচ্ছে। বিদেশে “সেইফ এক্সিট” নেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়—যে দেশ ও যে জনগণকে বিশ্বাসঘাতকতা করেছ, তারা কি কখনো নিরাপদ আশ্রয় দেয়?
ওয়াকার ভুলে গেছে—বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো, এখানে দেশবিরোধীদের পরিণতি কখনও গৌরবময় হয় না। মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে যত ষড়যন্ত্রই হোক, যত সামরিক দমনই ঘটুক, এই দেশের মানুষ প্রতিবারই তাদের প্রতিরোধ করেছে।
আজ ওয়াকার যে ফ্রাংকেনস্টাইন তৈরি করেছে—তার রাজনৈতিক দানবেরা, ধর্মীয় উগ্রবাদীরা, বিদেশি অভিভাবকেরা—তারা এখন নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে একে অপরকেই ধ্বংস করছে। সেই সংঘাতের মাঝেই ওয়াকার হয়তো বুঝতে পারছে, ক্ষমতার দানবের কোনো বন্ধু নেই, কোনো মিত্র নেই, শুধু ক্ষুধা আছে—আর সেই ক্ষুধা একদিন তাকে গিলে ফেলবেই।
বাংলাদেশের ইতিহাসের এই নতুন অধ্যায় এখনো লেখা শেষ হয়নি। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত—এই ভূমিতে যারা নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থে রাষ্ট্রকে বন্দি করতে চায়, তাদের শেষ ঠিকানা হয় পরিত্যক্ত, বেওয়ারিশ, অবিশ্বাসের প্রান্তে।
জেনারেল ওয়াকার সেই দিকেই হাঁটছেন—নিজের তৈরি ফ্রাংকেনস্টাইনের মুখের ভেতর।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১০:০৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




