
আমেরিকা যে-দেশের বন্ধু হয়, সে-দেশের আর শত্রুর দরকার হয় না
রাশিয়ান জাহাজ উরসা মেজর (স্পার্টা-৩) ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সরঞ্জাম নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিল। কিন্তু মার্কিন আপত্তির কারণে জাহাজটি পণ্য খালাস করতে পারেনি, ফেরত গিয়েছিল খালি হাতে। সেটাই ছিল এক প্রতীকী বার্তা — বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে, তা তখন থেকেই নির্ধারিত হতে শুরু করেছিল।
এর ঠিক দেড় বছর পর, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে শেখ হাসিনা চীন সফরে যান। এই সফর শুধু রাজনৈতিক ছিল না; এটি ছিল বাংলাদেশের এক স্বপ্নযাত্রার শুরু — এশিয়ান ঐক্যের দিকে, শিল্পায়নের দিকে, আর আত্মনির্ভরতার পথে।
আমেরিকা ও চীন—দুটোই সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র, কিন্তু তাদের চরিত্র ভিন্ন। আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস করে জয় করতে চায়; চীনের সাম্রাজ্যবাদ ব্যবসা করে, উভয়ের স্বার্থ রেখে এগোয়। আমেরিকা আগুন লাগিয়ে, যুদ্ধ বাধিয়ে, সরকার বদলে তার প্রভাব বিস্তার করে; চীন এখনো পর্যন্ত কাউকে ধ্বংস না করেই তার প্রভাব বাড়িয়েছে। শেখ হাসিনা সেই দ্বিতীয় ধারার সঙ্গে হাত মেলাতে চেয়েছিলেন।
রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প, ইকোনমিক জোন, ব্লু ইকোনমি—সবই ছিল একটি বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ। লক্ষ্য ছিল, বাংলাদেশের শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থান।
বিদ্যুৎ: উন্নয়নের মেরুদণ্ড
৯০-এর দশকে রাজনীতির আলোচনায় প্রায়ই শোনা যেত—“সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো চায় না আমরা বিদ্যুতে স্বনির্ভর হই।” কারণ, বিদ্যুৎ মানেই শিল্পায়ন; শিল্পায়ন মানেই কর্মসংস্থান; আর কর্মসংস্থান মানেই স্বাধীন চিন্তা। সেই স্বাধীন চিন্তাই সাম্রাজ্যবাদীদের সবচেয়ে বড় ভয়।
২০০৯ সালের আগে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল খুঁড়িয়ে চলা এক যাত্রা। কিন্তু শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসেই এই খাতে বিপ্লব ঘটান। ২০১০ সালের পর থেকে ছোট ছোট প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়তে থাকে, আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে শিল্প, কৃষি ও প্রযুক্তি বিকাশ।
২০০৯ সালে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৩,২৬৮ মেগাওয়াট। ২০২৫ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৩১,৭৭০ মেগাওয়াটে। এর সাথে যোগ হতে যাচ্ছিল রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের ২.৪ গিগাওয়াট। অর্থাৎ, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন তখন দেশের চাহিদার দ্বিগুণ।
বিদ্যুৎ মানেই শিল্প। শিল্প মানেই কর্মসংস্থান। কর্মসংস্থান মানেই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও রাষ্ট্রীয় আত্মবিশ্বাস। এই ত্রিভুজটা ঠিক তখনই ভেঙে দিতে হয়, যখন একটি দেশ নিজেকে “নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের বাইরে” নিতে শুরু করে।
১৩৯টি ইকোনমিক জোনের স্বপ্ন
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিকল্পনা ছিল ১৩৯টি ইকোনমিক জোন গড়ে তোলার—যেখানে দেশি-বিদেশি শিল্পকারখানা স্থাপন হবে, তৈরি হবে ৭২ লাখ নতুন কর্মসংস্থান। এর জন্যই রূপপুর প্রকল্পের মতো বিশাল বিদ্যুৎ উৎপাদন উদ্যোগ নেয়া হয়।
এই ইকোনমিক জোনগুলো পুরোপুরি চালু হলে বাংলাদেশ শিল্পায়নের এক নতুন যুগে প্রবেশ করত। মধ্যবিত্ত শ্রেণি শক্তিশালী হতো, কৃষক ও শ্রমিকের আয় বাড়ত, বিদেশি মুদ্রা অর্জন বহুগুণে বৃদ্ধি পেত।
কিন্তু আমেরিকার ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে সেই অগ্রযাত্রা সহ্য করা সম্ভব ছিল না।
সাম্রাজ্যবাদের পুরোনো কৌশল
ইতিহাস সাক্ষী—যে দেশ উন্নয়ন ও আত্মনির্ভরতার পথে হাঁটতে শুরু করে, সেই দেশেই আমেরিকা হঠাৎ ‘গণতন্ত্র’, ‘মানবাধিকার’ বা ‘স্বচ্ছতা’র প্রশ্ন তোলে। লাতিন আমেরিকা থেকে আফ্রিকা—যেখানে তারা বন্ধু হয়ে ঢুকেছে, সেখানেই ছড়িয়েছে অস্থিরতা, যুদ্ধ, গৃহদ্বন্দ্ব।
বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। শেখ হাসিনার চীন-রাশিয়া ঘনিষ্ঠ নীতি, এশিয়ান ইউনিয়নের ধারণা, বঙ্গোপসাগরের তলদেশের সম্পদ ব্যবহারের পরিকল্পনা—এসবই পশ্চিমা স্বার্থের বিপরীতে দাঁড়িয়েছিল।
আর ঠিক তখনই আমেরিকা তার পুরনো খেলা খেলেছে—অভ্যুত্থান, বিভাজন, “নতুন মিত্র” বানানোর নামে পুরোনো শত্রুদের মাঠে নামানো।
মুহাম্মদ ইউনুস ও পশ্চিমা ঘনিষ্ঠ শক্তিগুলো সেই খেলায় নিখুঁতভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। তারা বোঝানোর চেষ্টা করছে, আমেরিকা বাংলাদেশের বন্ধু। অথচ ইতিহাস বারবার দেখিয়েছে—আমেরিকা যে-দেশের বন্ধু হয়, সে-দেশের আর শত্রুর দরকার হয় না।
এখন কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ
আজ দেশের সব ইকোনমিক জোনের কাজ থেমে গেছে। বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প স্থগিত। দেশের সম্পদ একে একে বিদেশি কর্পোরেশনের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে “পুনর্গঠনের” নামে।
যে দেশ বিদ্যুৎ রপ্তানির সক্ষমতা অর্জন করেছিল, আজ সেখানে ঘন ঘন লোডশেডিং।
যে দেশ শিল্পায়নের দোরগোড়ায় পৌঁছেছিল, আজ সেখানে বেকারত্ব বাড়ছে।
অর্জন ভেঙে ফেলা, পরিকল্পনা থামিয়ে দেওয়া—এসব কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটি সেই ভূরাজনীতির ফল, যেখানে উন্নয়ন মানে অপরাধ, আত্মনির্ভরতা মানে বিদ্রোহ, আর স্বাধীন চিন্তা মানে হুমকি।
আমেরিকার বন্ধুত্ব এক ধরনের আগুন—যা প্রথমে আলোর মতো লাগে, পরে পুড়িয়ে ফেলে সব।
শেষ কথা
শেখ হাসিনার বিদ্যুৎনীতি, ইকোনমিক জোন পরিকল্পনা কিংবা চীন-রাশিয়া সহযোগিতা—সবই ছিল একটি স্বাধীন ও আত্মনির্ভর বাংলাদেশের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন এখন ধ্বংসস্তূপে।
এখন যারা আমেরিকার ছায়ায় দাঁড়িয়ে “উন্নয়ন”, “গণতন্ত্র” আর “নতুন সূর্যোদয়ের” কথা বলছে—তাদের উদ্দেশে ইতিহাস একটাই কথা বলে যায়:
আমেরিকা যে-দেশের বন্ধু হয়, সে-দেশের আর শত্রুর দরকার হয় না।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে অক্টোবর, ২০২৫ সকাল ১০:৩৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




