আম, আদমী আর ক্রিকেট!
রুয়েটের বিশাল মাঠের সবুজ ঘাসগুলোর পূর্বপুরুষেরা(!) সবাই চেনে আমাদের মানে আমাকে আর আমার ক্রিকেট খেলার সাথীদের। স্কুল আর কলেজ জীবনের কত সোনালি সময়ের সাক্ষি যে মাঠের সেই ঘাসগুলো,বাস্কেটবল গ্রাউন্ডটা, চারপাশের ইউক্যালিপ্টাস অথবা দেবদারু গাছের সারি আর বিশাল মাঠের মাঝে বুক চিতিয়ে দাড়িয়ে থাকা ৬ টা আমগাছ। আমের মুকুল আসার সময় আশপাশে খেলা নিষেধ ছিল তবে আম একটু বড় হয়ে গেলে সেই নিষেধাজ্ঞা শিথিল হয়ে যেত। যেন জাটকা আর ইলিশ ধরার মত ব্যাপার। স্কুলের মাঠেও খেলতাম। খেলা শুরু হলে আমাদের স্কুলের দারোয়ান চাচা আমগাছের দায়িত্ব আমাদের দিয়ে চলে যেতেন। খেলায় একটা সিক্রেট রুল ছিল, ব্যাটসম্যান বল মেরে আম ফেলতে পারলে ডাবল ছক্কা অর্থাৎ ১২ হবে তবে দারোয়ান চাচা দেখে ফেললে আউট। শুধু তাই না তখন বেচারা ব্যাটসম্যানকেই সরি বলে আমটাও দিয়ে আসতে হত। আমগুলা বড় হলে আবার স্কুলের সবাইকে ভাগ দেয়া হত। আমরা কখনও কয়েকটা বেশিও পেতাম। তখন ছেলেমেয়েদেরা ঈর্ষা দেখে স্যার বলতেন,ওরা সারাদিন ক্রিকেট খেলে গাছ পাহারা না দিলে তোরা কি এই আমও পেতিস!
বাঘের প্রথম গর্জন আর রঙ ছড়ানো দিন:
সাল ১৯৯৭। মালয়েশিয়ার কিলাত কিলাব মাঠে আইসিসি ট্রফি তে স্কটল্যান্ডকে হারানোর পর যখন চৌধুরি জাফরুল্লাহ শরাফত ঝাপিয়ে পড়লেন তার কথার ঝুড়ি নিয়ে "বাংলাদেশ বিশ্বকাপে চলে গেলওওওওওওওওওওওওওও....সাথে সাথে দেশের মানুষ ঝাপিয়ে পড়েছিল অভূতপূর্ব এক আনন্দযজ্ঞে। ১৬ ডিসেম্বর '৭১ এর পর সম্ভবত এত আনন্দময় দিন বাঙালীর জীবনে আর আসেনি কখনো্। পাড়ার ছেলেরা সমগ্র জাতিকে রং মাখিয়ে রঙিন করার দায়িত্ব নিয়েছিল সেদিন । বাইরে আসা আবালবৃদ্ধবনিতা প্রায় সবারই রং মাখা অদ্ভূতুরে চেহারা নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছিল। আমাদের এক স্কুল শিক্ষিকার রাগী চেহারাটাও হাসিমুখে রঙিন হয়েছিল সেদিন। সাথে থাকা পিচ্চিটা বায়না ধরল, আম্মু, আমি অনেক রং লাগাবো। মায়ের মৌন সম্মতি পেয়ে পিচ্চিটাকে রঙের বালতিতে চুবিয়ে আনা হলো। সবার ভাব ছিল এমন যেন রং থেকে যদি ভাল কিছু হয়, হোকনা। ঘরে সার্ফ এক্সেল আছে কি নাই হু কেয়ারস!
"রং ছড়িয়ে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ যাত্রা" শিরোনামে আমার সেদিনের সেই অভিজ্ঞতার গল্প ছাপা হয়েছিল একটা খেলার পত্রিকায়। সম্মানী হিসেবে ২০০ টাকা প্রাপ্তি লেখালেখি থেকে আমার প্রথম আয়। এর কদিন পর সৌদি আরব থেকে শুভেচ্ছা উপহারসহ এক প্রবাসী বাঙালীর অনেক আবেগ আর ভালবাসা মোড়ানো একটা চিঠি পেলাম। সেই লেখার জন্য আমাকে প্রশংসায় ভাসানো এবং পাশাপাশি ওই দিন দেশে থাকতে না পারার দুঃখে দীর্ঘশ্বাস মেশানো চিঠি। দেশের বাইরে বেশ কিছুদিন থাকার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝি প্রিয়জন ফেলে রেখে যাওয়া এসব বাংলাদেশীরা তাদের বুকের মাঝে কি ভীষণ মমতা লালন করেন প্রিয় দেশের জন্য!
আমার এক চায়নীজ-আমেরিকান কলমবন্ধু ছিল। তাকেও চিঠিতে সেই রঙিন দিনের গল্প বললাম। চিঠি পড়ে তারও নাকি ভীষণ ইচ্ছা হয়েছিল রঙ মাখার আর বাংলাদেশে এসে এরকম একটা দিন দেখার। পরের চিঠির সাথে তাই একটু রং কিনে পাঠিয়ে দিলাম । গালে রং লাগানো মেয়েকে মা যখন জিজ্ঞেস করেছিলেন হোয়াট ইজ দিস ফর?...শী রিপ্লাইড.... দিস ইজ ফর বাংলাদেশ উইনস ওয়ার্লল্ড কাপ....


আমি অপার হয়ে বসে আছি...ওহে দয়াময়....আসুক আবার ফিরে সেই রং ছড়ানো, রং মাখানোর দিন। সুদীর্ঘ দুঃসময়ে ক্লান্ত জাতির জন্য 'তিনটা' জয় নিদেনপক্ষে একটা-দু'টা জয় ভীষণ দরকার! ভীষণ!
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মার্চ, ২০১৫ বিকাল ৫:৪৭